কোভিড-১৯: পোষা প্রাণীকেও টিকা দিতে হবে
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২১, ১৩:২৪ | আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৪
করোনাভাইরাসের মহামারীর গোড়া থেকেই প্রাণীর শরীরে এ ভাইরাস কী প্রভাব ফেলে তা নিয়ে শঙ্কা জানিয়ে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবদেহে করোনাভাইরাস সংক্রমিত করার ক্ষেত্রে প্রাণীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার প্রমাণ মেলেনি। তবে প্রাণীদের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণের নিশ্চিত তথ্য এরই মধ্যে তাদের হাতে পৌঁছেছে। এসব প্রাণীর মধ্যে কুকুর, বিড়াল, শিম্পাঞ্জি, এমনকি মিংকও রয়েছে।
এ ধরনের সংক্রমণ আমলে নিয়ে বিজ্ঞানীরা শুধু প্রাণীদেহে প্রয়োগের জন্য উদ্ভাবন করেছেন কোভিড-১৯ টিকা। গত সপ্তাহে প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিশেষ টিকা উদ্ভাবনের ঘোষণা দেয়। তবে প্রাণীদের জন্য আদৌ টিকা জরুরি কিনা- তা জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
গত বছর জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যে একটি বিড়ালের শরীরের প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। ওই সময় যুক্তরাজ্যের প্রধান ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ক্রিস্টিন মিডলমিস বলেন, “এটা আসলে খুবই বিরল ঘটনা। এ পর্যন্ত যেসব প্রাণীদেহে ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে তাদের সামান্য উপসর্গ দেখা গেছে এবং সেরেও উঠেছে কয়েক দিনের মধ্যে।”
পোষা প্রাণীর বাইরে চিড়িয়াখানায় থাকা বেশ কয়েকটি প্রাণী শরীরেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
নিউ ইয়র্কের ব্রংক্স চিড়িয়াখানার একটি বাঘের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণীর শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঘটনা সেটি। এরপর সান ডিয়েগো চিড়িয়াখানাতে ৮টি গরিলার শরীরেও ধরা পড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ।
দুটো ঘটনাতেই ধারণা করা হয়, চিড়িয়াখানায় প্রাণীদের যিনি দেখভাল করতেন, তার সংস্পর্শে এসেই এসব প্রাণী সংক্রমিত হয়েছিল। তবে এদের উপসর্গ ছিল সামান্য, সেরেও ওঠে দ্রুত।
স্তন্যপায়ী প্রাণী মিংকের বেলায় কোভিড-১৯ গুরুতর হয়ে দেখা দেয়। কয়েকটি দেশে খামারের মিংকের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভালোই কাবু করে। অনেক মিংকের মৃত্যু হয়।
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি হয় ডেনমার্কে। সেদেশের সরকার লাখে লাখে মিংক নিধন করে এবং ২০২২ সাল পর্যন্ত এসব মিংক খামার বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মিংক থেকে মানুষের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছেন গবেষকরা।
পোষা প্রাণীর জন্য তাহলে টিকার দরকার আছে?
এ নিয়ে দুই রকম মত রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বিড়াল ও কুকুরের কথাই ধরা যাক। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন না যে মানবদেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে এসব প্রাণীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে।
গত বছর অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইকোহেলথ অ্যালায়েন্স-এর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম কারেশ বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী সায়েন্সকে বলেন, “জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার দৃষ্টিকোণ বিবেচনায় এসব প্রাণীর শরীরে টিকার প্রয়োগ জরুরি না।”
যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণিদেহে টিকা প্রয়োগের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার (ইউএসডিএ) একই ধরনের অবস্থান নিয়েছে।
অন্য প্রাণীদের বেলায়, বিশেষ করে মিংকের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বিজ্ঞানীরা অবশ্য এদের ক্ষেত্রে টিকা উদ্ভাবন নিয়ে ভেবেছেন।
মানুষের থেকে শ্বাসতন্ত্রের রোগে সংক্রমিত হতে পারে গরিলা প্রজাতি। তাই এদের নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে বিজ্ঞানীদের। বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে গরিলারা।
গরিলার দেহে সংক্রমণ এরইমধ্যে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ডেনমার্কে মিংক হত্যার ঘটনায় বোঝা যায়, সেখানে পরিস্থিতি কতটা বেসামাল হয়েছিল।
বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, যদি করোনাভাইরাস ব্যাপক হারে প্রাণীর শরীরে ছড়াতে থাকে তবে এর বিবর্তন ঘটতে পারে। তারপর এই রূপান্তরিত ভাইরাসের বিরুদ্ধে হয়ত এখনকার টিকা আর কাজ নাও করতে পারে।
গত জানুয়ারিতে ভাইরুলেন্স সাময়িকীর এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “সংক্রমণ রোধে কিছু পোষা প্রাণীকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনার কথা ভেবে দেখতে হবে।”
সাময়িকীর সম্পাদক কেভিন টেইলার বিবিসিকে বলেন, “প্রাণীদেহে বিবর্তিত হওয়া করোনাভাইরাস আবার মানবদেহে সংক্রমিত হতে পারে আরেকটি ধরন নিয়ে যা ভবিষ্যতে সঙ্কট হয়ে উঠতে পারে। আর এটা মোকাবেলার সবচেয়ে ভালো উপায় হতে পারে টিকা।”
প্রাণীদের জন্য করোনাভাইরাসের আর কোনো টিকা আসছে?
বেশ কয়েকটি দেশ ও প্রতিষ্ঠান এ ধরনের টিকা উদ্ভাবনে কাজ করছে বলে জানা গেছে। এ ধরনের একটি টিকা নিয়ে কাজ করছে রাশিয়া ভেটেরিনারি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান রোসেলখোজনাদজর। তারা দাবি করেছে, তাদের উদ্ভাবিত কারনিভ্যাক-কোভ টিকা কুকুর, বিড়াল, মিংক, শিয়াল ও অন্য প্রাণীর শরীরে আশানুরূপ ফল দেখিয়েছে। গত অক্টোবর থেকে তারা এই টিকার পরীক্ষা চালিয়ে আসছে।
প্রতিষ্ঠানটির উপপ্রধান কনস্টাইন সাভেনকভ জানান, টিকাপ্রাপ্ত সব প্রাণীর দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এই টিকা উৎপাদনের অনুমোদনও পেয়েছেন তারা।
যুক্তরাষ্ট্রেও প্রাণীদেহে প্রয়োগের জন্য টিকা উদ্ভাবনে কাজ করেছে ভেটেরিনারি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান জোয়েটিস। হংকংয়ে একটি কুকুর কোভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার খবর প্রচারের পর গত বছর থেকেই এ নিয়ে কাজ শুরু করে তারা।
প্রাথমিকভাবে কুকুর ও বিড়ালের জন্য এই টিকা নিরাপদ মনে করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে সান ডিয়েগো চিড়িয়াখানায় গরিলার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হলে এই টিকা অন্যান্য প্রণীর শরীরেও পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ মেলে।
চারটি ওরাংওটাং ও পাঁচটি বুবুনের শরীরে জোয়েটিস-এর টিকা প্রয়োগ করা হয়। তাদের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। শিগগিরই এই প্রাণীদের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
এ পর্যন্ত শুধু প্রাণীদেহে প্রয়োগের জন্য টিকা উদ্ভাবনের কাজ চলছে। তবে শিগগিরই পোষা প্রাণীকে ব্যাপক হারে টিকা দেওয়ার দরকার হবে না বলেই আশা করছেন ভাইরুলেন্স সম্পাদক কেভিন টেইলার।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত