কৃষকদের দুর্দশা লাঘব ও শস্য নিরাপত্তা রক্ষায় কৃষকদলের ৮ দফা সুপারিশ

কৃষকরা সর্বশান্ত, অপরদিকে সরকারি দলের লোকজন আঙুল ফুলে কলাগাছ: মির্জা ফখরুল

  গ্রামনগর বার্তা রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২২, ১৫:১৪ |  আপডেট  : ২১ এপ্রিল ২০২৪, ২০:১২

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজ আমরা এমন এক বিষয় নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি যখন দেশের লাখ লাখ কৃষককুল বিপর্যস্ত ও দিশেহারা। ১৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশে মানুষের খাদ্যের যোগানদাতা কৃষক পরিবারের সার্বিক অবস্থা খুবই নাজুক এবং দুর্বিষহ। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা এবং কিশোরগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার হাওরের লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল। সেই সঙ্গে ভেসে গেছে প্রান্তিক সেসব জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার স্বপ্ন। হাওর এলাকার সাড়ে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে বছরে কেবলমাত্র একটি ফসল হয়। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের কারণে কোনো বছর সেটি তলিয়ে গেলে সারা দেশে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে। হুমকিতে পড়ে জীবন-জীবিকার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

তিনি আরো বলেন, চলতি বছরে সুনামগঞ্জে বাঁধ নির্মাণে সরকারি বরাদ্দ ছিল ১২২ কোটি টাকা। গত ৫ বছরে এই টাকার পরিমাণ ছিল ৬২১ কোটি টাকা, যা বাঁধ রক্ষায় তেমন কোনো কাজেই আসেনি। বরং এই বরাদ্দকৃত টাকা ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রী-এমপি, সরকারিরী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকতারা এই টাকা ভাগাভাগি করে হরিলুট করেছে। যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তা এতই দুর্বল যে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার পানির চাপ সামাল দিতে পারেনি। প্রতি বছর এভাবে বাঁধ নির্মাণের নামে হাওর অঞ্চলে সরকারি অর্থ লুটের মহোৎসব চলে। এর ফলে কৃষকরা হয় সর্বশান্ত, অপরদিকে সরকারি দলের লোকজন ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা হয় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠেছে ।

পরিসংখ্যান তুলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সুনামগঞ্জের হাওর বাঁচাও আন্দোলন কমিটির গবেষণা সূত্র অনুযায়ী, বিভিন্ন উপজেলায় ৭২২টি বাঁধের মধ্যে দৈবচয়ন (র‌্যানডম) পদ্ধতিতে ১০৮টি বাঁধের ওপর পরিচালিত জরিপের ফল অনুযায়ী মাত্র ৮ শতাংশ বাঁধে মাটির কাজ সম্পন্ন হয়, ঘাস লাগানো হয় মাত্র ৩ শতাংশ বাঁধে। সংশোধিত কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) নীতিমালা অনুযায়ী ৫০ মিটার দুর থেকে বাঁধ নির্মাণের মাটি আনার কথা থাকলেও ৩৫ শতাংশ বাঁধেই এই নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে মোট ১ হাজার ৭১৮ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে।

মঙ্গলবার দুপুর ১১টায় রাজধানীর নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সরকারী দুর্নীতিরোধ, হাওরের কৃষকদের দুর্দশা লাঘব ও শস্য নিরাপত্তা রক্ষায় ৭ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।

বর্তমান অবৈধ সরকারের আমলে সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজির কারণে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু দেশের হাওর অঞ্চলই নয়, এই চিত্র দেশের সার্বিক কৃষি খাতের। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আলু চাষিরা তাদের আলুর ন্যূনতম মূল্য না পেয়ে রাস্তায় আলু ফেলে প্রতিবাদ জানানোর খবরও কেউ ভুলে যায়নি। এর আগে কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার প্রতিবাদে পাকা ধানের জমিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কিছু দিন আগে ফসলের জমিতে সেচের পানি না পেয়ে শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে ফসলের ক্ষেতে ফাঁসির মঞ্চ বানিয়ে হতাশাগ্রস্ত কৃষক শফিউদ্দিন আত্মহত্যা করে এক মরমান্তিক ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। একই দাবিতে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২ কৃষক রবি মারন্ডী ও অভিনাথ মারন্ডী কীটনাশক পানে আত্মহত্যার কথাও দেশবাসী ভুলে যায়নি।

মির্জা আলমগীর বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কৃষকদলের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি সুনামগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত হাওর অঞ্চল সরেজমিনে পরিদর্শন ও কৃষকদের দুর্দশার চিত্র দেখে এসেছেন। সরকারী দুর্নীতিরোধ, হাওরের কৃষকদের দুর্দশা লাঘব ও শস্য নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের কিছু সুপারিশ আমি এখন আপনাদের মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরছি।


১. হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এই দুর্নীতির সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
২. বছর বছর বাঁধ নির্মাণ না করে সিমেন্ট ও বালু দিয়ে তৈরিকৃত ব্লক ফেলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
৩. ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিনাসুদে বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. ঋণগ্রস্ত কৃষকের ঋণের সুদ মওকুফ এবং স্বাভাবিক অবস্থা না ফেরা পর্যন্ত ঋণের কিস্তি নেয়া বন্ধ করতে হবে।
৫. হাওর অঞ্চলে শস্যবীমা চালু করতে হবে।
৬. হাওর অঞ্চলের কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য গণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
৭. দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৮. কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুলের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমান উল্লাহ আমান, কেন্দ্রীয় নেতা নাজিম উদ্দিন আলম, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, মীর সরফত আলী সপু, কৃষক দলের গৌতম চক্রবর্তী, জামাল উদ্দিন খান মিলন, এসএম ফয়সাল, ভিপি ইব্রাহিম, সৈয়দ অলিউল্লা্হ সিদ্দিকী,  ফেরদৌস পাটোয়ারি, মাহুমদা হাবিবা, ইউসুফ আলী মোল্লা, মেহেদি হাসান পলাশ, ইশতিয়াক আহমেদ নাসির, জাহাঙ্গীর আলম, কাদের সিদ্দিকীসহ কৃষক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত