কারা কেড়ে নিল প্রাণবন্ত এই তরুণের প্রাণ!
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৩, ১৬:৫৪ | আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:৪৮
ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের স্নাতক (বোটানি বিভাগ) তৃতীয় বর্ষের ছাত্র প্রান্ত মিত্র এলাকায় ‘দরদি’ হিসেবে খ্যাত ছিলেন। হিন্দু ছাত্র পরিষদের রাজেন্দ্র কলেজ শাখার আহ্বায়ক হিসেবেও দ্বায়িত্বরত ছিলেন। কারও রক্তের প্রয়োজনে হাসপাতালে ছুটে যাওয়া, পথকুকুরের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা ছিল তাঁর দৈনন্দিন রুটিনের অংশ। রোববার দিবাগত মধ্যরাতে বন্ধুর অসুস্থ বোনের জন্য রক্ত দিতে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন প্রান্ত। সেই দরদীকে শাস্তি পেতে হল নৃশংসভাবে। শহরের ওয়্যারলেস পাড়া এলাকা থেকে ফরিদপুর ডা. জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতালে যাওয়ার পথে আলীপুর সেতুর উত্তর পাশে ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রান্ত্র মিত্রকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বত্তরা।
‘আমার ছেলে মানুষের জন্য রক্ত দিতে গিয়েছিল। আর সেই রক্তের ঋণ এভাবে শোধ করল মানুষ?’ মঙ্গলবার মধ্যরাতে ফরিদপুর শহরে নিহত প্রান্ত মিত্রের (২৩) মা পুতুল মিত্রের আহাজারির সামনে সবাই নির্বাক হয়ে বসেছিলেন। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পুরো পরিবারটি শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে।
বুধবার দুপুরে প্রান্তর নানা বাড়ি ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের মালাঙ্গা গ্রামে এমন দৃশ্য দেখা যায়। একমাত্র সন্তানের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে পরিবারটি শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে আত্মীয় বাড়িতে অবস্থান করছে। বাড়িভর্তি পরিবারের ও আত্মীয়দের সবার চোখে-মুখে একইরকম আতঙ্ক ও চাপা ক্ষোভ।
প্রান্তর স্কুলশিক্ষক বাবা বিকাশ মিত্র নিজেকে কিছুটা সামলে নিতে চেষ্টা করছেন দেখা গেল। মা পুতুল মিত্রকে কেউ সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। সংবাদকর্মী পরিচয় জানার পরে ছেলে হারিয়ে নিঃস্ব এই মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে চাইলেন ছেলে হত্যার বিচার।
এলাকায় সবার বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানো ছেলে প্রান্ত মিত্রকে কেউ এমন নির্দয়ভাবে কুপিয়ে হত্যা করতে পারে, বাবা বিকাশ মিত্র তা বিশ্বাস করতে পারছেন না। ছেলে হত্যার বিচার দাবি করে তিনি বললেন, আমি মনে করি, প্রান্তর সঙ্গে কারো বিরোধ থাকতে পারে না। সে জন্ম থেকেই আমার কাছ থেকে শিখেছে কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়, কীভাবে মানুষের উপকার করতে হয়। আমার ছেলের কোনো শত্রু থাকতে পারে, সেটা আমি ভাবতেই পারি না।
কারা তবে এমন ঘটনা ঘটাতে পারেন– এই প্রশ্নের জবাবে বিকাশ মিত্র আরও বললেন, ‘লোকমুখে শুনেছি, ওকে (প্রান্ত) হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তাদের পুলিশ খুঁজে বের করুক। আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
বিকাশ মিত্রের এমন উত্তর কিছুটা সাবধানী মনে হল। সন্তান হারিয়ে সন্তানের হত্যার বিচার চাইতে গিয়েও নিজেই যেন ভীত হয়ে পড়ছেন এই প্রবীণ শিক্ষক।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শহরের অম্বিকাপুর শ্বশানে প্রান্তর সৎকার সম্পন্ন হয়েছে। প্রান্ত হত্যার নেপথ্যে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ধারণা করছেন তার স্বজনরা। ঘটনার পর থেকে প্রান্তর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও পলাতক রয়েছে।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, প্রান্ত স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গত সোমবার (২৪ জুলাই) ফরিদপুরে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতি পদপ্রত্যাশী ছিলেন শহরের ঝিলটুলী মহল্লার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম জনি। প্রান্ত তার অনুসারী হিসেবে মিছিল নিয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার আগে আলীপুরে শেখ রাসেল স্কয়ারে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় উদ্বোধনের সময় তার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের একটি গ্রুপের মারামারি হয়।
এদিকে কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকা থেকে সম্মেলনে যোগ দিলেও রহস্যজনক কারণে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়নি। নতুন কমিটিতে সভাপতি প্রার্থী ছিলেন ২৩ জন। তাদের মধ্যে পদ পাওয়া নিয়ে বিরোধ চলছিল। এরই মধ্যে সোমবার রাতে খুন হন প্রান্ত।
প্রান্ত মিত্র হত্যার (২৩) সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানানো হয়েছে। বুধবার সকালে ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সামনে মুজিব সড়কে জেলা পুজা উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এ দাবি জানানো হয়।
মানববন্ধন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, প্রান্ত মিত্রের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেপ্তার করতে না পারলে কঠোর আন্দোলন কর্মসুচি ঘোষণা করা হবে। প্রান্ত খুনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের সঠিক তদন্তের মাধ্যমে খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। ফরিদপুর শহরকে অশান্ত করার অশুভ চেষ্টাকে প্রতিহত করারও ঘোষণা দেওয়া হয় মানববন্ধন থেকে।
ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী প্রান্ত মিত্র হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
বুধবার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিত্রয় ঊষাতন তালুকদার, ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক, নির্মল রোজারিও এবং সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত এক বিবৃতিতে এই নিন্দা জানান।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, প্রান্ত মিত্র হাসপাতালে তার এক বন্ধুর বোনকে রক্তদান করতে গিয়ে সোমবার গভীর রাতে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এই হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত ও বিচার দাবি করেন নেতারা।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রান্ত হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন এবং হত্যাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত