"কম চেনা মানুষ" - ওমর ফারুক
প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২৪, ১২:৫১ | আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫০
সমাজ কেবল অর্থবিত্তের লোক দ্বারা চালিত হয়না। বড় একটা অংশে ভাগ থাকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। এই প্রান্তিক লোকজন কিন্তু পিকচারে থাকে না, দৃশ্যপটে থাকে না। সব সময় আড়ালে আবডালেই থেকে যায়। এদের কথা কোথাও নেই। ইতিহাসে নেই, বইয়ের পাতায় নেই, গল্প-উপন্যাসে নেই। এমনকি মানুষের মুখেও থাকে না বেশিদিন। সভ্য হিসেবে এদের পরিচিতি নেই। তারা হারিয়ে যায় মৃত্যুর সাথে সাথে।
প্রত্যেকটি গ্রামে, মহল্লায় প্রান্তিক মানুষের দেখা পাওয়া যাবে। বাজারের এক কোণে বসে হয়তো শাপলা শালুক বিক্রি করছে। কেউ কিছু পাঁচমিশালি শাক নিয়ে হয়তো বসে আছে। কেউ হাতে লাঠি নিয়ে হয়তো রাস্তাটা পরিস্কার করছে। রোদে ভিজে ফসল ফলাচ্ছে। নদীর জলে মাছ মারছে। কেউ ইমারত গড়ে তুলছে। আবার কেউ চায়ের পাত্রে জল গরম করছে। মানুষের উদরপূর্তি করতে, মানুষের জন্য খাদ্যের বন্দোবস্ত করতে রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছে শ্রমজীবী মানুষেরা।
এলিট শ্রেণির লোকজন মনে করে আমরা ত টাকার বিনিময়ে শ্রম কিনে নিয়েছি। স্বল্প মূল্যে শ্রম কিনে নিয়ে এলিট শ্রেণি পুস্তকে অমর হচ্ছে। আর যারা স্বল্পমূল্যে শ্রম বিক্রি করছে তাদের নামটুকু নেয়ার মতো কেউ নেই। বড় বড় ইমারতগুলোতে কারা শ্রম দিয়েছে এ কথা কেউ জানেনা। কারণ তাদের নাম কোথাও লেখা নেই। তারা খরচের খাতায়। পিরামিড, তাজমহল শ্রম দিয়ে যারা গড়েছে তাদের কথা কেউ জানেনা। জানে কেবল ফিতা কেটে উদ্বোধন করেছে যারা তাদের নাম।
আমাদের পূর্ব পুরুষদের কথাই ত আমরা জানিনা। কেউ লিখে রাখেনি। আপনার চারপাশে বসত করা লোকটা একদিন মরে যায়, আপনি মরে যাবেন। কয়েকদিন পরেই আপনার স্মৃতি চিহ্ন মুছে যাবে। আপনার বাবা কিংবা দাদা পর্যন্ত হয়তো কদাচিৎ আপনি মনে রাখবেন কিন্তু এর পরের সিঁড়ি আপনার অজানা। আমাদের চারপাশের লোকগুলো আমাদের সাথেই সমাজ করে, আমাদের সাথেই তাদের নানা স্মৃতি। অথচ এদের আর খুঁজে পাওয়া যায়না মৃত্যুর পরে।
আমার চারপাশে এমন হাজারো লোক আছে, ছিলো। যারা হারিয়ে গেছে। এরা কিন্তু ব্যাংক ডাকাতি করেনি, করোনার সার্টিফিকেট জাল করেনি, খাদ্যপণ্য ভেজাল মেশায়নি, রাজস্ব নির্মূল করেনি, সুইস ব্যাংকে টাকা সরায়নি। এরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে কোনো কিছু না ভেবেই। কোনো বিনিময় জোটেনি তাদের ললাটে। মুক্তিযুদ্ধের বইগুলোতে তাদের কথা নেই। তারা কেবল দেশের মাটি বাঁচাতে সংগ্রাম করেছে।
আমাদের শৈশবে যে লোকটি আচার বিক্রি করত, যে লোকটি মুড়ি মুরকি বিক্রি করত, যে লোকটি আমাদের বাড়ির সামনে এসে আইসক্রিম বিক্রি করত তাদের নাম কিন্তু আমরা জানিনা। আমাদের শৈশব হারিয়ে গেছে সেসব লোকদের মতোই। যার হাতে আমাদের হাতেখড়ি, শিক্ষাজীবন শুরু থেকে শেষ অবধি যাদের কাছে বিদ্যাশিক্ষা করেছি তাদের নাম কি আমরা মনে রেখেছে। কে আমাদের ভালো অংক শেখাতেন, কে আমাদের নীতিবান হতে উৎসাহ দিয়েছেন, কাকে আমি প্রিয় শিক্ষক মনে করতাম। আজ হয়তো অনেকেই তাদের নাম পর্যন্ত মনে রাখিনি।
প্রত্যেকটি গ্রামে নরসুন্দর আছে, ছিলো। ডাকঘরে পোস্টমাস্টার ছিলো। গ্রামের বাজারে পানের দোকান, চায়ের দোকান, ঝারফুক করা লোক, নৌকা বাওয়া লোক, মাইক ছাড়া মাইকে আজান দেওয়া সেই মানুষটি, গভীর রাতে গ্রামে চোর তাড়ানো লোকটি, গ্রাম্য পঞ্চায়েত পরিচালনা করা দাপুটে মানুষটি, কিছু পাগল গোছের মানুষ যাকে দেখে কিংবা যার থেকে আপনি বিনোদন পেয়েছেন, সব আজ নিস্প্রভ, সব মুছে গেছে। আপনি কাউকেই মনে রাখেননি হয়তো। আর এ কারণেই আপনার আমার শৈশব চুরি হয়ে গেছে।
আমাকে আপনাকে নিশ্চিত কোনো ডাক্তারের হাতে জন্ম নিতে হয়নি। যে ধাই কিংবা ধাত্রী আঁতুড় ঘরে আমাকে আপনাকে জন্মদিতে, পৃথিবীতে আসতে সহযোগিতা করেছেন আমরা কিন্তু তাদের মনে রাখিনি। তাদের নাম হয়তো আমরা জানিনা। আমরা আমাদের চাচা, মামা, ফুফু তাদের সাথে কাটানো সময়গুলো পর্যন্ত মনে রাখিনি। আমাদের বাবা-মা আশৈশব আমাদের জন্য যে শ্রম দিয়েছেন আমরা কজনই বা সে কথা মনে রেখেছি।
আমাকে শৈশবে রোজ নৌকায় করে স্কুলে যেতে হতো। যে লোকটি আমাকেসহ অন্যদের স্কুলে পৌঁছে দিত তাঁকে আমি রোজ দেখি। আমাকে যিনি হাতেখড়ি দিয়েছেন সে প্রিয় শিক্ষক এখন কবর দেশের বাসিন্দা। আমার বাবার সাথে খুব সখ্যতা ছিলো। মৃত্যুর পরও বাবার পাশেই শুয়ে আছেন। আমাকে জন্মদিতে যেসব ধাত্রী আঁতুড় ঘরে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের দুইজন এখন আর পৃথিবীতে নেই। আমাদের গ্রামের সেই পুরনো পানের দোকানদার শচি কাপালি আজ আর নেই। আজ আর নেই দীর্ঘদিন নরসুন্দরের কাজ করা লোকটি। গ্রামে চৌকিদার ধনঞ্জয়। আমাকে প্রথম বালিশ গড়ে দেয়া লোকটি আজ আর নেই। সেই হাসিহাসি মুখের পোস্টমাস্টার নানু ঢালী যার কাছ থেকে শিখেছি, কাইট কাইট ফাইট কিংবা কাট ইউর টি ডট ইউর আই এর গল্প। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান আব্দুল হাই হাওলাদার, পটাই বেপারী। মুখে আজান দেওয়া সেই শাহজাহান হাওলাদার আজ বয়সের ভারে নুজ্ব। আজান শেখানো সেই মওলবি, বাড়িতে জাইগির মাস্টার কেউ আজ আর নেই।
আমাদের শৈশবে যা ছিলো, শিক্ষা জীবনে যা ছিলো জুড়ে সব ছেড়েছে আমাদের। আমরা কিছুই সাথে নিয়ে চলতে পারিনি। আজ তাই আমাদের জীবনে আনন্দের উপকরণ কমে গেছে।
সান
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত