উপন্যাস: দিকু 

  সালেহ রনক 

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৩, ১৭:১৩ |  আপডেট  : ৪ মে ২০২৪, ২২:৫১

'দিকু' এবারের বইমেলা-২০২৩ এর আলোচিত একটি উপন্যাস। বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি সরদার ফারুকের প্রথম উপন্যাস, যা ঢাকা, কোলকাতা ও আগরতলা থেকে একযোগে আলাদা তিনটি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশনী। ৯০ পৃষ্ঠার বইটির মুদ্রিত মূল্য তিনশত টাকা। 

'দিকু' উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে আমান নামক এক যুবকের আখ্যান। যে নিজ রাস্ট্র, সমাজ ও সংসারে এক বহিরাগত। বাম চরমপন্থার বিপ্লবী জীবন পেছনে ফেলে, মিথ্যে খুনের মামলা থেকে বাঁচতে ঢাকায় পালিয়ে এসেছে।কিন্তু প্রতিনিয়তই তার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ছিন্নভিন্ন হয়। অধঃপতিত কবি জীবনে একসময় ভালোবাসাও আসে, পূর্ণতা আর পায় না। উপন্যাসের মূল চরিত্র আমানকে ( আসলে দিকু) ঘিরেই আবর্তিত হয় বাকি সকল চরিত্র। শিপ্রা, মোতালেব সাহেব, শিহাব, গুল নাহার ও রিনিতা মুর্মু, যাকে দিয়ে যখন যা বলাতে চেয়েছেন লেখক যথাযথভাবে তা পেরেছেন বলে মনে হয়েছে। 

একবসায় পড়ে শেষ করার মতো উপন্যাস,' দিকু'। একজন কবি যখন কথাসাহিত্যিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তখন তাকে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যেতে হয়; উপন্যাসের ভাষা, চরিত্রগুলোর ঠিকঠাক উপস্থাপন, চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক, পর্ব বিন্যাস ও পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার দক্ষতা ইত্যাদি। কবি সরদার ফারুক তাঁর প্রথম উপন্যাসে দারুণ দক্ষতার সাথে উতরে গেছেন এ সকল পর্যায়। তাই কবি সরদার ফারুককে একজন কথাসাহিত্যিক হিসাবে স্বাগত জানাতেই পারি।

উপন্যাসটি পড়া শেষেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে একজন লেখকের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, নানান অভিজ্ঞতা ও মননের সুস্পষ্ট ছাপ। মাত্র নব্বই পৃষ্ঠার উপন্যাসের ক্যানভাস কিন্তু বিশাল ও বিস্তৃত। কি নেই এই উপন্যাসে! সমাজ ও রাষ্ট্র চরিত্রের পোস্টমর্টেম থেকে শুরু করে উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন বেকারত্বের অভিশাপ, বিত্তবানদের যৌনবিলাস, বিপ্লবীদের ক্ষয়ে যাওয়া চরিত্র ও উদ্দেশ্য, নষ্ট রাজনীতি ও রাজনীতিক, ইতিহাসের পরম্পরা, আদিবাসীদের অধিকার ও বঞ্চনার পুঁথি, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও তাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগ, বাঙালি ও তাদের বিবর্তনসহ আরও কতকিছু! এক একটি চরিত্র যেন আমাদেরই চেনা-জানা কেউ হয়ে কথা বলছে!

এবার পাতায় পাতায় একটু বেড়ায়ে আসা যাক...

"কেউ যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রীসভায় ঢুকিয়েছে, কেউ আবার তলে তলে মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়ে দেশটিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে এখন আত্মপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছাড়া আর অন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। কেউ বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, কেউ কেউ  বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে। বুদ্ধিমানেরা সরকারি  দলে ঢুকে লুটপাটে সামিল। একসময়ের আন্দোলনকারী বামকর্মীদের ব্যক্তিগত দুর্দশা দেখে কেউ আর ঐ পথে হাঁটতে চাইছিল না।"
লেখক যখন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আমানের মুখে এসব কথা তুলে দেন তখন তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও রাষ্ট্রের চলমান অবস্থা তীব্রভাবে ফুটে ওঠে। এই দৃশ্য কি আমাদের অচেনা?

"শ্রমিকদের অধিকাংশের সঙ্গে নামাজ-রোজার তেমন সম্পর্ক না থাকলেও ধর্মের ব্যাপারে তারা ভীষণ অনুভূতিপ্রবণ। ডেমরায় বিশাল প্যান্ডেল সাজিয়ে ওয়াজ মাহফিল হলে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। বেঙ্গল গ্লাসের সামাদ ভাই শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সেক্রেটারি ছিলেন। পার্টির নির্দেশে ধর্মঘট করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে চাকরি হারিয়েছেন। শেষমেশ এখন একটা মুদি দোকানের কর্মচারী। ওদিকে শুনেছি পার্টির মূল নেতা ঢাকার একটা আবাসিক এলাকায় চারতলা দালানের মালিক ।"
উপরের বক্তব্যে কী এই চিত্রই ফুটে ওঠেনি যে, রাজনীতি এখন নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার সবচেয়ে মোক্ষম পেশা?

"কনকর্ড মার্কেটের আড্ডায় তরুণ কবিরা নতুন সময়ের কবিতা নিয়ে কথা বলে, কতো কতো নাম উঠে আসে। ................এখানে সবধরনের কবিরই দেখা পাওয়া যায়--- আমলা কবি, বিখাউজ কবি, উড়াধুড়া কবি, সবাই একসঙ্গে বসে আড্ডা দেয়।"
কবি আমানের এই মন্তব্যে এই সঙ্গে তীব্র শ্লেষ ও স্যাটায়ার মূর্ত হয়ে উঠেছে। পরিচিত ছবিকেই যেন আবার চোখের সামনে তুলে ধরলেন লেখক।

" জীবন থেকে নেগেটিভ লোকদের ছেঁটে না ফেললে বিরক্তি থেকে মুক্তি নেই। বিষাক্ত ফোঁড়ার যন্ত্রণার সঙ্গে চুলকানি সহ্য করা কঠিন। "
লেখক এখানে সহজ কথায় দারুণ ও দরকারি এক দর্শন তুলে ধরেছেন। যাপিত জীবনে এর প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে পারি না বলেই এতো বিড়ম্বনা। 

"শরীরকে আমি অত বড় মনে করি না,কিন্তু মন? শারীরিক শুচিতা দিয়ে সীতার সতীত্ব বিচার করা হয় না,বিচার করা হয় তাঁর মনের শুদ্ধতা দিয়ে।" 
সমাজ মানুষকে বিচার করে শরীর দিয়ে। শরীরের 'শুদ্ধতা' সতীত্বের মাপকাঠি। এই শুদ্ধতাও বিরাট এক প্রশ্নবোধক শব্দ, তার ব্যাখ্যাও ততটাই জটিল। তাই সমাজ মনের খোঁজ নেয় না। অথচ মনের শুচিতাই হওয়া উচিত একজন মানুষের ভালো মন্দের নির্ণায়ক। লেখক চমৎকারভাবে এই বিষয়টির অবতারণা করেছেন। যেমন বলেছেন, ধর্মের টনটনা অনুভূতি আর তা চর্চার বিস্তর ফারাক এর কথা।

"আমাদের এই যৌথ বসবাসকে অনেকটা মিথোজীবিতা বলা চলে। পরস্পরের প্রয়োজনে  জীবজগতে এমন অনেক সহাবস্থান দেখা যায়, যেমন শৈবাল আর ছত্রাক মিলে তৈরি করে লাইকেন।  আমরা একটা কাপল হতে না পারলেও সেই লাইকেন হয়েছি। এখানে কে শৈবাল, আর কে ছত্রাক সেটা অবশ্য ভেবে দেখিনি।"
চমৎকার উপমা ও যুক্তিতে লেখক আনাম ও শ্রিপার সহাবস্থানকে তুলে ধরেছেন। এই যুক্তিকে অকাট্য বলেই মনে হয়েছে। দুজন মানুষের ভালোমন্দ, কমতি খামতি পার হয়েই তো মিথোজীবি হয়ে উঠতে হয়। 

" এখানে যারা মুক্তির কথা ,স্বাধীনতার কথা বলে,তারা-ই আবার শেকল পরাতে চায়, হত্যায় উদ্যত হয়ে ওঠে। হিংস্র পশুর হাত থেকেও হয়তো বাঁচা যায়, তবুও মানুষের হাত থেকে মানুষের নিস্তার নেই।"
চিরকাল মানুষের হাতেই মানুষের পরাজয় হয়েছে। মানুষ আধুনিক হতে গিয়ে মূলত আরও নির্মম, হন্তারক হয়েছে, পশুকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে । এখানে লেখক আবারও মনে করিয়ে দিলেন মানব জাতির ক্রমবিকাশ। 

"রাখো তো ,তোমার কাছে এসব কোন ব্যাপার? হাড্ডি দিলেই কুত্তা ঠান্ডা।"

উপন্যাসের আরেক প্রধান চরিত্র শিপ্রা,যে মায়ের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন ও ছোট ভাইকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মোতালেব সাহেবের রক্ষিতা। তাই সে খুব ভালো করেই জানে মোতালেব সাহেবের ক্ষমতা ও টাকার গরম। সুবিধাবাদীরা টাকার কাছে যে পা- চাটা কুত্তার সমান, লেখক শিপ্রার মুখ দিয়ে সেই সত্যিই প্রকাশ করেছেন। 

" ৭-৮ জন লোক একটা ব্যানার নিয়ে এগিয়ে আসছে।দ্রব্যমূল্য কমানো আর কী কী যেন দাবিতে তাদের এই বিক্ষোভ। সবগুলোই জনগণের ভালোর জন্য, কিন্তু তাদের মিছিলে লোক নেই কেন, সেটাই ভাবছিলাম। কারো কারো পরিবারের সদস্য সংখ্যাও এরচেয়ে বেশি হয়।"
এইতো বাস্তব চিত্র! নায্য অধিকারের দাবি আদায়ে আজকাল সাধারণ লোকজন খুঁজে পাওয়া যায় না। সকল অন্যায় মেনে নেয়া যেন গা সওয়া করে নিয়েছে! যার ফলশ্রুতিতে পুঁজিপতিরা নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। জনগণের মানসিক দীনতার করুণ ভাষ্যই প্রদর্শিত হয়েছে এই উপন্যাসে।

"তুমি মিয়া তলে তলে টেম্পু চালাও।  আমরা কি ভোদাই, কিছুই বুঝি না ?"
শিহাব যখন ইঙ্গিতে  আমান- শ্রিপার ধোঁয়াশা সম্পর্ক নিয়ে খোঁচা দেয় তখন চিরাচরিত বন্ধু আড্ডার চিত্রই ফুটে ওঠে।

" সংসার করবে না , সন্ন্যাস নেয়ারও সাহস নেই,তবে আর উপায় কী? আসলে তুমি কোন দায়িত্ব নিতে চাও না। ফুলে ফুলে মৌমাছি হয়ে মধু খেতে ইচ্ছে হয়?" 
আমান যে আসলে কি চায় তা সে নিজেও জানে না। আর বৈষ্ণবী তা ধরে ফেলে। লেখক একজন বৈষ্ণবীর মুখ দিয়ে যে ভাষায় কথা বলিয়েছেন তা যুক্তিযুক্ত। 

" একটা লেখাতেও কোন কল্পনা, বুদ্ধিমত্তা বা কবিতার রহস্য বলতে কিছুই নেই। সবকিছুই সরাসরিভাবে লেখা। অনেকগুলো তো দেশজাতি নিয়ে নানারকম মতামত আর বিষোদগারে ভরা প্রবন্ধ। যতই চেষ্টা করি এগুলোর একটাও কোনদিন কবিতা হয়ে উঠবে না। গল্পের বইটা আরো অখাদ্য। কাহিনীর কোন আগামাধা নেই।চরিত্রগুলো খুব স্টোরিয়োটাইপ। তবু জানি, এইসব লেখক-লেখিকারাই নানারকম সাহিত্য পুরস্কার পেয়ে যাবে, এমনকি রাস্ট্রীয় কোন পুরস্কার পেয়ে গেলেও অবাক হবো না। যোগাযোগটাই আসল কথা।"
সাহিত্য চর্চার নামে এইতো চলছে সর্বত্র। লেখক সুনিপুণভাবে বাস্তব চিত্রটি চিত্রণ করেছেন। 

"কারো সঙ্গে সাধারণ অনর্থক আলাপ করি না, তবু কেন যেন লোকটাকে একটা প্রশ্ন করে বসলাম। 
"আচ্ছা আপনাদের রংপুরের সবাই কি লাঙ্গল মার্কার সাপোর্টার?
"এরশাদ হামার ঘরের ছাওয়া। হামার জ্বালা তোমরা বুঝিবেন না,ওমরা না থাকিলে কি যমুনা ব্রিজ হবার কথা?"
"সে না-কি ওপারের লোক। হলদিবাড়ি থেকে এসেছে?"
"কথাটা একই, বাহে।আগতে হামরা সোগাই কুচবিহার জেলাতেই আছিনু।"
"না মানে বলছিলাম, এই যে লোকে তার চরিত্র নিয়ে কথা বলে...."
"রাজা-বাদশার ঐগুলা দোষ কিছু থাকিবেই। "-- লোকটার তড়িৎ জবাব। "
আমাদের দেশে বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ প্রবাদের মতো করে জ্ঞান করে রাজা-বাদশাদের সকল অপকর্ম ধর্তব্যের বাইরে। লেখক এখানে কোন প্রকার আড়ালে না গিয়ে কথোপকথনে একটি বিতর্কিত মানুষ ও তার ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন।

"ভেবে দ্যাখ, লোকটা ছিল একজন ঠান্ডা মাথার খুনি আর আত্মস্বীকৃত লম্পট। তবু রাস্ট্রধর্ম চালু করে আর শুক্রবার ছুটির দিন ঘোষণা করে সে এখন লোকজনের কাছে নায়ক হয়ে গেছে। আঞ্চলিকতার ব্যাপার তো নিজেই শুনলি। এইসব ডিক্টেটর কিছু অবকাঠামোর উন্নয়ন করে, কিছু লোককে সুবিধা দেয় আর ধর্ম নিয়ে সুড়সুড়ি দিয়ে সব জায়েজ করে নেয়। "
"হ্যাঁ, এখন তো ক্ষমতার জন্য কেউ আর তাকে স্বৈরাচার বলে না, সে এখন অতি প্রেয় আমের আচার। সবাই সেই আচার নিয়ে টানাটানি করে।"
শিহাব ও আমানের কথোপকথনে যেসব বয়ান প্রকাশ পেয়েছে ,কথাসাহিত্যিক সরদার ফারুক এখানে বেশ সাহস দেখিয়েছেন। 

"সত্য কি আসলেই সুন্দর? আমি তো দেখি সত্যকে সহ্য করা-ই যায় না।গুহা থেকে বেরোনোর হাজার বছর পরেও নরখাদকের পৈশাচিক নাচ থামেনি। ধর্মের নামে, জাতের নামে কারা এখনও মানুষকে পুড়িয়ে মারছে?"
এ যেন অনন্ত জিজ্ঞাসা! যার কোন উত্তর নেই। অথচ সত্যটা সবাই জানে। সত্য সুন্দর হলেও প্রকাশে সে সকলের চোখের কাঁটা। 

"গুলনাহার রিনরিনে গলায় হেসে উঠে বললেন, "কে কবি, আর কে কবি নয়, আমি কিন্তু চোখ দেখলেই বুঝি।"
"তাই না কি? এ তো এক বিশাল ক্ষমতা।  আমি তো কিছুই বুঝি না। কোনো বিখ্যাত কবিকে দেখে মনে হয় গরুর দালাল, আবার বাসের কন্ডাকটারকে দেখে মনে হয় লোকটা কবি। "
চমৎকার স্যাটায়ারে ভর দিয়ে লেখক তীর ছুুড়ে মারলেন তথাকথিত কবি তকমাধারীদের দিকে।

" অধিকাংশ মানুষের নীতি-নৈতিকতা নিয়ে ভাবনাগুলো বেশ অদ্ভুত লাগে। এরা নিজেদের জন্য একরকম মানদন্ড তৈরি করে রেখেছে, অন্যদের জন্য আলাদা বাটখারা। কিছু লোককে দেখেছি এদের পকেটগুলোর চরিত্র আলাদা। বাম পকেটে ঘুষের টাকা, ডান পকেটে বেতনের।  এদের কারো কারো মুখে শুনেছি, 'ভাইজান, আপ্নে তো জানেন উপরির টাকা আমি পোলা-মাইয়ারে খাওয়াই না।বেতনের টাকায় বাজার করি। হালাল টাকায় হজ্ব করেও এসেছি। "
এই যে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ও প্রকাশ, একজন পোড় খাওয়া মানুষ তথা লেখকের পক্ষেই সম্ভব এমন চমৎকার কথামালায় মুদ্রিত করা। 

"সভ্যতার নামে, ধর্মের নামে মানুষ মানুষকে নিরুদ্ধ করে রেখেছে। কেউ হেরেমের মালিক, কেউ বা সেখানে খোজা প্রহরী। "
ইতিহাস ও তার নির্মম পুনরাবৃত্তি! কথাসাহিত্যিক সহজ কথায় সুন্দরভাবে সভ্যতার ব্যবচ্ছেদ করেছেন।

"বনদেবীর কথা বইয়ে পড়েছি, ওকে দেখে মনে হল এই সেই বনদেবী। কষ্টিপাথরের মূর্তির মতো গড়ন।মসৃণ ত্বকে এক অভূতপূর্ব ঔজ্জ্বল্য। লোকে কেন যে সাদা রঙ দেখে এত পাগল হয় কে জানে! চোখেমুখে একটা রহস্য আর বুদ্ধির ছটা। "
অনিয়মিত প্রুফ রিড ও সম্পাদনার কাজ করে জীবনের ব্যয়ভার কোন রকমে টেনেটুনে পার করা আমানের জীবনেও প্রেম আসে। সাঁওতাল কন্যা 'রিনিতা মুর্মু 'র দৈনিক সৌন্দর্য প্রকাশে তার মুখে যখন লেখক তুলে দেয় নরম ও কোমল শব্দ-সেঁতু তখন তা চমৎকারভাবে মানিয়ে গেছে। 

একজন ঋদ্ধ কবির কথাসাহিত্যিক হিসাবে প্রথম পদক্ষেপ কেমন হয়েছে, এই বিষয়টি আমাকে ভীষণ ভাবে তাড়িত করেছে 'দিকু' উপন্যাসটি পাঠে। আর আমি হতাশ হইনি তাঁর প্রথম সৃষ্টিতে। উপন্যাসটি নিয়ে আলোচনায় আমি যথাসম্ভব নিরপেক্ষ থেকেছি।

তাই একজন পাঠক হিসাবে যেসকল বিষয়ে উপন্যাসটি লেখকের আরও মনোযোগ পেতে পারতো সেসকল বিষয় তুলে না ধরলেই নয়। 

উপন্যাসের শেষের দিকে লেখকের মধ্যে বেশ তাড়াহুড়া কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়েছে। কেবলই মনে হয়েছে একটা ধরা -বাঁধা পৃষ্ঠা  সংখ্যায় তিনি নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন। আর তা করতে গিয়েই যথাসম্ভব উপন্যাসের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র শিপ্রাকে হঠাৎ করেই দৃশ্যের বাইরে নিয়ে গেলেন। সাঁওতাল কন্যা রিনিতা ও আমানের প্রেম ও প্রণয় ছিল রকেট গতির। আদিবাসি ও বাঙালির সাথে কথাবার্তায় প্রথমেই খুব সহজ হতে পারার কথা নয়। তার উপর আছে গোত্র ভেদে কড়া নিয়মের দেয়াল যা ভাঙা কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ।  সেই বিচারে  রিনিতা ও আমানের এতো দ্রুত কাছে আসা ,ঠোঁটে ঠোঁট রাখা কিছুটা অবাস্তব মনে হয়েছে। যদিও লেখক মন ও তাঁর যুক্তিই চূড়ান্ত; হয়তো তাঁর কাছে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত ব্যাখা আছে এই বিষয়ে। এছাড়া উপন্যাসের বেশ কয়েকটি জায়গায় দুর্বল সম্পাদনা চোখে লেগেছে। একই বাক্যে পর পর একই শব্দ ব্যবহার কেবলই প্রিন্টিং মিসটেক বা এডিটরের ব্যর্থতা যা দৃষ্টিকটু লেগেছে। উপন্যাসের নাম 'দিকু' সার্থক করে তুলতে শব্দের অর্থও তুলে দেয়াসহ লেখক উপন্যাসের শেষ দিকে দিকু শব্দটি রিপিটেডলি ব্যবহার করেছেন।বিষয়টি পাঠকের উপরই দেয়া ছেড়ে দেয়াই যুক্তিসঙ্গত হতো বলেই পাঠক হিসাবে মনে হয়েছে।

সবশেষে বলতেই পারি, কবি সরদার ফারুক কথাশিল্পে প্রথম পদক্ষেপেই উপন্যাসের ভাষা ও চরিত্র চিত্রণে বেশ মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন।কথাসাহিত্যে আমি তাঁর দীপ্ত ভ্রমণই দেখতে পাচ্ছি। উপন্যাসটি বহুল প্রচার ও পঠিত হোক।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত