ইতিহাসের পাতায় বাংলা সনঃ নববর্ষ উৎসব ও উৎযাপন

  শাশ্বত স্বপন    

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২১, ১০:২৩ |  আপডেট  : ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:২৬

‘বাজ ণাব পাড়ী পঁউআ খালে বাহিউ
অদব বঙ্গালে দেশ লুড়িউ
আজি ভুসুক বঙ্গালী ভইলী...।’ (পদ ৪৯)

 
       
হাজার বছর আগে রচিত সিদ্ধাচার্য ভুসুক পা এর চর্যাপদ পাঠ করলে বোঝা যায়, বাংলা, বাংলাভাষা ও বাঙালী জাতির অস্তিত্ব অতি প্রাচীন। প্রাচীন যুগে বাংলা  কোন অখণ্ড রাজ্য ছিল না। সমগ্র বাংলা বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল। বাংলার সেই  অংশগুলো তখন অঙ্গ,বঙ্গ, পুণ্ড্র, গৌড়, হরিকেল, সমতট, বরেন্দ্র এ রকম প্রায় ১৬টি জনপদে বিভক্ত ছিল--যার সীমা ও বিস্তৃতি সঠিকভাবে নির্ণয় করা অসম্ভব। কেননা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন রাজন্যের শাসনামলে এর সীমা ও পরিধির পরিবর্তন ঘটেছে। তাই প্রাচীন বাংলার কোনো সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল না। বাংলার জনপদগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম হলো পুণ্ড্র।
      
বাংলার ইতিহাসের প্রথম প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় রাজা শশাঙ্কের আমল হতে। শশাঙ্ক ছিলেন প্রাচীন বাংলার একজন শাসক। তিনি বাংলার বিভিন্ন ক্ষূদ্র রাজ্যগুলোকে একত্র করে গৌড় নামের জনপদ গড়ে তোলেন। খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে তিনি রাজত্ব করেছেন বলে ধারণা করা হয়। কারো কারো মতে, তিনি ৫৯০ হতে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন। তাঁর রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা।

সেই খণ্ড ও অখণ্ড রাজ্যগুলোতে  প্রাচীন কাল  থেকেই বাঙালি জাতির বর্ষবরণ প্রথা প্রচলিত ছিল। বর্ষবরণ ছাড়াও তারা পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় নানান  রীতি-নীতি-আচার অনুষ্ঠান পালন করত। তবে বাংলা নববর্ষ  উৎসব আকারে কখন, কীভাবে  প্রথম শুরু হয়েছিল তার দিনক্ষণ ঠিক করে বলা কঠিন। ইতিহাসেও তথ্যাদিসহ তেমনভাবে কিছু লেখা নেই। তবে প্রাচীনকাল থেকেই গ্রামীণ বাংলাদেশে বৈশাখ মাসের শুরুতে হালখাতা, পূণ্যাহ, আমানি, লাঠিখেলা, কবিগান, ষাড়ের লড়াই,  বৈশাখী মেলা ইত্যাদি নামে নানা রকম পারিবারিক, সামাজিক উৎসব চালু ছিল।
    
সৌর পঞ্জিকা অনুসারে, বাংলা বার মাস অনেককাল আগে থেকেই পালিত হতো। এই  সৌর পঞ্জিকা শুরু হতো গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। সৌর বছরের  প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরালা, মনিপুর,  নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়– এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনায় একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ, কারণ প্রযুক্তি প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত কৃষকদের ঋতুর ওপরই নির্ভর করতে হত।
     
ঐতিহাসিকদের মতে, পহেলা বৈশাখ উৎসবটি ঐতিহ্যগত হিন্দু নববর্ষ উৎসবের সাথে সম্পর্কিত। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই দিনে এই উৎসব পালিত হয়। শিখগণও এই উৎসব পালন করে। তবে বর্তমানে, বাংলাদেশ ও বহিবিশ্বে এটা বাঙালিদের সার্বজনীন উৎসব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত।
      
ভারতের পূর্বাঞ্চল ও উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে এবং নেপালে নববর্ষের উৎসবগুলো হিন্দু বিক্রমী দিনপঞ্জির সাথে সম্পর্কিত। এই দিনপঞ্জির নামকরণ করা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে। কিন্তু সেই অঞ্চলগুলোর মত বাংলায় বঙ্গাব্দের সূচনা ৫৭ খ্রিস্টপূর্বে হয়নি, বরং ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে সূচণা হয়েছিল, এবং সেই সূচনা  কোন এক সময় পরিবর্তন করা হয়েছে এবং শশাঙ্কের শাসনামলেই এই পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করা হয়।
     
ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলোতে যে বাংলা দিনপঞ্জি ব্যবহার করা হয় তা সংস্কৃত গ্রন্থ ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ এর উপর ভিত্তি করে লেখা। এখানে মাসগুলোর ঐতিহাসিক সংস্কৃত নামগুলো রাখা হয়েছে যার প্রথম মাসের নাম হল বৈশাখ। তাদের দিনপঞ্জিটি হিন্দু দিনপঞ্জি ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত এবং  বাঙালিদের হিন্দু উৎসবের দিন নির্ধারণে সেটি ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের বাঙালিদের জন্য প্রতি বছর ১৪ বা ১৫ এপ্রিলে এই উৎসব হয়ে থাকে। 
       
কবি, লেখক ও গবেষক ড. নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, ‘সুবেহ বাংলায় ফসল ওঠার সঙ্গে রাজস্ব সংগ্রহের একটা যোগ রয়েছে। সম্রাট আকবরের সময় আরবি চন্দ্র মাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান এবং বাংলার ফসলি চক্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলা সনের প্রচলন/সংস্কার করা হয়। কয়েকশ বছর যাবত এ সন গণনাই স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রচলিত আছে। চান্দ্র মাসের হিসাব এবং  গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান ইত্যাদিকে ভিত্তি  করে পঞ্জিকা বর্ষ বা বঙ্গাব্দ চলে আসছে। পঞ্জিকা বর্ষে মাস গণনার নির্ধারিত দিনক্ষণ অনুসৃত হতো না। ফলে সৌরবর্ষ বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারের বেশ বড় ধরনের গড়মিল ছিল। তদুপরি বাংলা সন গণনার  কোন লিপইয়ারও ছিল না। এর ফলে বর্ষ গণনায় বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটি প্রায়শ এড়িয়ে যাওয়া হতো। আমাদের বাংলা একাডেমি এই সমস্যারটির একটি বিজ্ঞানসন্মত সমাধানের লক্ষে  ড. মুহম্মদ শহীদ্ল্লুাহর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ  কমিটি গঠন করে। এই কমিটিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের পন্ডিতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ষাটের দশকের গোড়ার দিকেই বাংলা একাডেমির এই কমিটির সিদ্ধান্ত ও সুপারিশক্রমে বাংলা সন গণনার সংস্করণ করা হয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল থেকে ১ বৈশাখ নির্ধারিত হয়।’
 
ইংরেজ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে জমিদারি প্রথা চালু করা হয়। জমিদাররা খাজনা আদায়ের জন্য বছরের  প্রথম দিনে তাদের বাড়িতে ‘পুণ্যাহ’ উৎসব করতেন। লোক গবেষক শামসুজ্জামান খানের মতে, বাংলার মুঘল সুবাদার মুর্শিদ কুলি খান প্রথম পুণ্যাহ এর রীতি শুরু করেন, যার অর্থ হচ্ছে "ভূমি রাজস্ব আদায়ের উৎসবের দিন" এবং তিনি বাংলা দিনপঞ্জির সূচনা করার জন্য আকবরের রাজস্ব নীতি ব্যবহার করেন। সেই উৎসবে চাষি-প্রজারা জমিদারির খাজনা পরিশোধ করত এবং মিষ্টি দ্বারা আপ্যায়িত হতো। 
     
 আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে পহেলা বৈশাখে ঘর-কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকাণ্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। 
      
বর্ষবরণ উপলক্ষে শান্তির  বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম যে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়, তার  পূর্বে এর নাম ছিল বর্ষবরণ আনন্দ  শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল  শোভাযাত্রা’ হিসেবে  নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক আয়োজিত এই উৎসব শোভাযাত্রাকে "মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য" হিসেবে ঘোষণা করে। 
 
বর্ষবরণ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও বাংলা নববর্ষের ইতিহাস বহু পুরানো। ১৯৬৭ সালে ছায়ানটের উদ্যোগে ঢাকার রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উৎসব শুরু হয়। সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট পহেলা বৈশাখে সূর্যোদয়ের পর সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানায়।
 
বাংলাদেশে আধুনিক ধারার নববর্ষ চালু হয়েছে ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে। ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়ার পরই শুধু যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে বাঙালির জাতিগঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে একটি সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দান করেন এবং সে বছর বিপুল উৎসাহে বাঙালি তার নববর্ষ উদযাপন করে। সেই সময় থেকে ঢাকাসহ পূর্ববাংলার বিভিন্ন শহরে নববর্ষ উৎসব চালু হয়।  ঢাকার মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকের উদ্যোগে কার্জন হলে নববর্ষ উৎসব উদযাপন করা হয়। এছাড়াও ঐকতানসহ কয়েকটি সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এবং উয়ারীর  র্যাং কিন স্ট্রিটেও  এই উৎসবের সূচনা করে। তবে বর্তমানে ঢাকা শহরে নববর্ষের উৎসব যে বর্ণাঢ্য অবয়ব, নব আঙ্গিক ও বিপুল আয়তনে চালু হয়েছে তার ইতিহাস রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের এই জাতীয় উৎসবটি পাকিস্তান সরকার করতে দিতে চাইত না। তারা এটাকে হিন্দুয়ানী উৎসব মনে করত। অথচ ‘বাংলা নববর্ষ উৎসব’ আর ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাংলাদেশের সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের মহান জাতীয় উৎসব। 
       
প্রতি বছরই বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষের উৎসব হয়ে ওঠে। নানা রঙ ও ডিজাইনের পাঞ্জাবি-পাজামা-শাড়িতে সজ্জিত বাঙালি নারী-পুরুষ-শিশুর বিপুল সমাগমে এ উৎসব এখন বাঙালির সর্ববৃহৎ জাতীয় অনুষ্ঠানের রূপলাভ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে  প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্তি¡ক জাতিসত্তার বাঙালি রাষ্ট্রে এ ধরনের একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসবের  প্রয়োজন ছিল। এ উৎসব এক সময় গ্রাম থেকে শুরু হয়েছিল কিন্তু পরে আর খুব বড় আকার গ্রহণ করেনি। এখন এ উৎসব আধুনিক বাঙালির গ্রামীণ সামান্যতা থেকে রাজধানী ছাড়িয়ে বিভাগ, জেলা, উপজেলা এবং গ্রাম পর্যন্ত গরিব ঘরের কন্যাকে নব আঙ্গিকে বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত করেছে। এ উৎসব বাঙালি জীবনে যে আনন্দ বয়ে আনে, তার তুলনা বিরল।
 
নববর্ষ ও নারী যেন সমার্থক। প্রাচীন যুগে নারীরাই এর সূচনা করেছিল বলে মনে করা হয়। কারণ কৃষি আবিষ্কারে নারীই পথিকৃৎ, ফলে নারীতান্ত্রিক সমাজের স্মৃতিচিহ্নবাহী ‘আমান’ বা ‘আমানি’ নামক  মেয়েলি উৎসব প্রাচীনকাল থেকেই বছরের শুরুতে  প্রচলিত ছিল। প্রতি বছর  পহেলা  বৈশাখের আগের রাতে বাড়ির গৃহিণী একটি ঘটে পানি  ঢেলে তাতে  অল্প পরিমাণ চাল ঢেলে দিতো, তারপর কচি পাতাসহ আম গাছের একটি ডাল বসিয়ে রাখতেন। আমাদের গ্রামবাংলায় সন্ধ্যার পরই রাত নেমে আসত বলে সন্ধ্যা রাতেই এই কাজটি করা হত এবং  কোন  কোন বাড়ির গৃহিণীরা,  বিশেষ করে সনাতন হিন্দুরা আতপ চাল ব্যবহার করতেন। পহেলা বৈশাখের সূর্যোদয়ের আগে বা ভোর সকালে  সেই বসিয়ে রাখা আমপাতার ডালটি ঘটের পানিতে পাতাসহ বারবার ডুবিয়ে এবং তুলে এনে পাতায়  লেগে থাকা জল বাড়ির গৃহিণী সবার শরীরে ছিটিয়ে দিতেন এবং ঘটে ভেজানো চাল বাড়ির সবাইকে খেতে দিতেন। গৃহকর্তা এই ভেজা চাল খেয়ে ক্ষেতে হালচাষ করতে যেতো। লোকবিশ্বাস ছিল এতে মাঠ ও ফসলের  কোনো ক্ষতি হবে না এবং সারা বছর সবার মঙ্গল হবে। এ বিষয়টি পরবর্তীকালে বাংলা নববর্ষের উৎসবের একটি অংশ হয়ে যায়। 
       
আরেকটি বড় ব্যাপার ছিল মেলা। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এবং পহেলা বৈশাখ সকালে  মেলা বসত। এই মেলার খুব প্রয়োজন ছিল। কারণ কৃষিভিত্তিক বাংলায় মানুষের হাতে কাঁচা পয়সা ছিল না। আর কাছে পিঠে এখনকার মতো এত দোকানপাটও ছিল না। তাই অতি  প্রয়োজনের জিনিসটি কিনে এনে ব্যবহার করাও ছিল সময় সাপেক্ষ্য। তাই প্রতি বছরের এই  মেলা থেকেই গ্রামের মানুষ হাঁড়ি-পাতিল, দা-কাঁচি থেকে শুরু করে সংসারের সারা বছরের যাবতীয়  দ্রব্যাদি বা তৈজসপত্র  কিনে রাখত। এই ছিল গ্রামীণ  মেলার আদি কাঠামো এবং উপায়-উপকরণ।  আরও পরে ইংরেজ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে জমিদারি প্রথা চালু করা হয়। জমিদাররা খাজনা আদায়ের জন্য বছরের প্রথম দিনে তাদের বাড়িতে 'পুণ্যাহ' উৎসব করতেন। সেই উৎসবে চাষি-প্রজারা জমিদারির খাজনা পরিশোধ করতেন। সেই সময়ে জমিদারের বাড়ি বা জমিদারের নির্দিষ্ট করে দেওয়া কোন জায়গায়, কোন নদীর শুকনো মোহনায় অথবা কোন অশ্বত্থ, বটবৃক্ষের ছায়ায় কিছু কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠত। দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিস দোকানিরা বেচাকেনাও করতেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের হাতে তো নগদ পয়সা ছিল না। তাই তাঁরা বাকিতে দোকান থেকে জিনিস কিনতেন। কিন্তু এই যে ধারে কেনা জিনিস, এই ধার তো শোধ করতে হবে। মহাজন ও ব্যবসায়ীরা তাই বছরের প্রথম দিনে হালখাতা অনুষ্ঠান চালু করেন।  হালখাতা হল যে বছরটি চলে গেলে সেই বছরের হিসাবের যোগ বিয়োগ করে পুরনো খাতাটি তুলে রেখে নতুন বছরের প্রথম দিন নতুন খাতায় হিসাব চালু করা। প্রবীণরা বলেন, লাল সালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো নতুন এই হিসাব খাতায় উপরে মুসলমান বাঙালিরা  লিখত ‘এলাহী ভরসা।’ এই এলাহী শব্দটিও সম্রাট আকবরের ‘তারিখ-ই-এলাহী’থেকে এসেছে বলে জানা যায়। এদিকে বাঙালী  হিন্দু পরিবারে বর্ষশেষের দিন অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তিতে টক এবং তিতা ব্যঞ্জন ভক্ষণ করে সম্পর্কের সকল তিক্ততা ও অম্লতা বর্জন করার প্রতীকী প্রথা পালন করে। পরের দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ প্রতিটি পরিবারে স্নান  সেরে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করার রীতি বহুল প্রচলিত। বাড়িতে বাড়িতে এবং সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে মিষ্টান্ন  ভোজন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশই এদিন থেকে তাদের ব্যবসায়িক হিসেবের নতুন খাতার উদ্বোধন করে। এই উপলক্ষে যে ব্যবসায়িক হিন্দু প্রতিষ্ঠানগুলিতে মঙ্গলদাত্রী লক্ষী ও সিদ্ধিদাতা গণেশের আরাধনা করা হয়। নতুন খাতায় মঙ্গলচিহ্ন স্বস্তিকা আঁকা হয়ে থাকে। হালখাতার দিনে ক্রেতারা দোকানির দেনা পরিশোধ করে মিষ্টিমুখ করে যেতেন। দোকানিরা তাঁদের দোকান সাজাতেন রঙিন কাগজের ঝালর বানিয়ে, আর আগরবাতি-ধূপ জ্বালিয়ে। একটা ছিমছাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ক্রেতা-বিক্রেতার এই সম্মেলন বেশ আনন্দপূর্ণই হতো। 
       
প্রাচীন গ্রামীণ বাঙলার পহেলা বৈশাখের মূল কাঠামো এই কয়েকটি উপাদানে গঠিত ছিল। পরে ইতিহাস এগিয়েছে। মোগল বাদশাহ দিল্লিতে চালু করলেন ইরানের নববর্ষ উৎসব 'নওরোজ'-এর অনুকরণে উৎসব ও মীনা বাজার। সেও ছিল রাজরাজড়া, অভিজাত ধনী বণিকদের নববর্ষের উৎসব। বাংলা নববর্ষ সেখান থেকেও কিছু অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। এরও পরে ইংরেজ আমলে এসে কলকাতায় বাঙালি বাবুরা ঔপনিবেশিক শাসকদের বড়দিন ও নিউ ইয়ার্স ডে পালন করতে শুরু করেন। অন্যদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারে ইংরেজদের নববর্ষ উদযাপনের আদলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের রীতি চালু হয়। ১৮৯৪ সালে বেশ ঘটা করেই ঠাকুর পরিবারে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়। সেই থেকে কতক ঐতিহ্যপ্রেমিক নগরবাসী শিক্ষিত পরিবারে কলকাতা শহর, শান্তি নিকেতনসহ পশ্চিম বাংলার নানা শহরে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের রীতি চালু হয়।
     
বর্তমানে যে বাংলা ক্যালেন্ডারটি আমরা ব্যবহার করি তার প্রচলক হিসাবে ধরা হয় মোগল সম্রাট আকবরকে। ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। এ কারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। সে সময় দেশের মূল অর্থনীতি ছিলো কৃষিনির্ভর। চাষাবাদ ছাড়াও আরো অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। তাই  ক্ষমতাসীন সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জীতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। আমির ফতুল্লাহ্ শিরাজির সুপারিশে পারস্যে প্রচলিত  সৌর বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরী  মোতাবেক  ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। তবে তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তার সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এ পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরী সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে গণনা প্রচলিত করা হয়। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলাবর্ষ নামে পরিচিত হয়। সম্রাট আকবরের আগে অগ্রহায়ণ মাসে বছর শুরু হত। অনেক স্থানে চৈত্র অথবা পৌষেও সন শুরুর কথা জানা যায়। তবে খাজনা প্রদানের শেষ দিন ছিলো খুব সম্ভবত চৈত্রের শেষ দিনেই। পহেলা বৈশাখ বছরের প্রথম দিন হিসেবে ধরা হচ্ছে আকবর পরবর্তী সময় থেকে।
      
৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস, এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ধরা হয়। মূলতঃ কৃষকের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সনের (নতুন করে)আবিষ্কার হয়েছে বলে মনে করা হয়। ১৫৬৩ সালে আকবরের সভাসদ আবুল ফজল ও আমির সিরাজী  বৈশাখের প্রথম দিনটি খাজনা আদায়ের জন্য ধার্য করেন। কৃষকরা এই সময় আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল থাকে, ধার দেনা শোধ করেন। ব্যবসায়ীরা হিসাবের খাতা হালনাগাদ করে। হালনাগাদের এই হালখাতাকে ঘিরেই উৎসবে রূপান্তরিত হয় পহেলা বৈশাখ। এদিন সকালে সনাতন ধর্মের প্রতি বাড়িতে বিন্নি ধানের খই, দই, চিড়া, মুড়ি, মিষ্টি বিভিন্ন খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।  ব্যবসায়ীরা বৈশাখের দিনে  ক্রেতাদের / দেনাদারদের  মিষ্টিদ্রব্য দিয়ে আপ্যায়ন করেন।
     
ইতোপূর্বে বঙ্গে প্রচলিত শকাব্দ বা শক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ছিল চৈত্র।  ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে(১৮৭৯ শকাব্দ) ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে একটি “পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি” গঠন করেন। এই কমিটির ঘোষণা অনুসারে প্রত্যেক গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির  ২২ মার্চ তারিখে শকাব্দ আরম্ভ হয় এবং শকাব্দের তারিখ অনুসারে সেই দিনটি হল ১ চৈত্র। বর্তমান ভারতের জাতীয় সন হচ্ছে শকাব্দ। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ  (১ চৈত্র ১৮৭৯ শক) ভারত সরকার এই সংস্কারপ্রাপ্ত শকাব্দকে ভারতের জাতীয় অব্দ হিসাবে গ্রহণ করে এবং কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সর্বস্তরে গ্রেগরিয়ান অব্দের সাথে “ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের” ব্যবহার প্রচলন করে।
    
বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় বাংলা সন তারিখে যে অসামঞ্জস্য দেখা দিয়েছে, সে প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা দরকার। এ অসামঞ্জস্যের ফলে নববর্ষ, রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী দুই অঞ্চলে একদিন আগে পরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর দায় বাংলাদেশের নয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমিটি বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহার সংস্কার প্রস্তাবকেই কিছু সংযোজন বিয়োজন করে বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা সংস্কারে  গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে ভারতে ড. সাহার প্রস্তাবের কিছু সংশোধন করে এসপি পাণ্ডে কমিটি ১৪ এপ্রিলে পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ভারত সরকার কর্তৃক গৃহীত পাণ্ডে শীর্ষক কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, ‘ঞযব ণবধৎ ংযধষষ ংঃধৎঃ রিঃয ঃযব সড়হঃয ড়ভ াধরংধশধ যিবহ ঃযব ংঁহ বহঃবৎং হরৎধহধুধহধ সবংধ ৎধংর যিরপয রিষষ নব ১৪ঃয অঢ়ৎরষ ড়ভ ঃযব মৎবমড়ৎরধহ পধষবহফধৎ. (ওহফরধহ ঔড়ঁৎহধষ ড়ভ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ংপরবহপবং ৩৯.৪(২০০৪) ৫১৯-৫৩৪). বাংলা একাডেমির টাস্কফোর্সও একই তারিখে পহেলা বৈশাখ নির্দিষ্ট করেছেন এবং বাংলাদেশে সরকারিভাবে তা চালু হয়েছে। কিন্তু ভারতে সেখানকার পঞ্জিকাকারদের ব্যবসায়িক স্বার্থে পাণ্ডে কমিটির রিপোর্ট কার্যকর হয়নি।
 
পশ্চিম বাংলায় মেঘনাদ সাহার বৈজ্ঞানিক সংস্কারকে উপেক্ষা করে পঞ্জিকাকারদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ভবিষ্যতে সন তারিখের ক্ষেত্রে তারা আরও গুরুতর সংকটের মধ্যে পড়বে। এ বিষয়ে পশ্চিম বঙ্গের বিখ্যাত পঞ্জিকা বিশারদ অধ্যাপক ক্ষেত্রমোহন বসু বলেছেন, ‘হিন্দু পঞ্জিকাকারদের নিরয়ণ গণনা নিতান্ত মান্ধাতা আমলের সেকেলের হইয়া দাঁড়াইয়াছে। নিরয়ণ গণনা পদ্ধতির ফলে অধিবর্ষের সংখ্যা প্রতি ১০০ ও ৪০০ বছরে যথাক্রমে ২৬ ও ১০৩টিতে পৌঁছে যাচ্ছে। বঙ্গদেশের ঋতুচক্রের সঙ্গে তার মাসের চিরন্তন সম্পর্কে ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে কয়েক হাজার বছর পর বৈশাখ মাসের শুরু আর গ্রীষ্মে হবে না, হবে বর্ষায় অর্থাৎ জুন মাসে। তাই বাংলা পঞ্জিকায় নিরয়ণ বর্ষমানের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক সৌর বর্ষমানের ব্যবহার আশু প্রয়োজন।’
      
লোক গবেষক শামসুজ্জামান খান বলেছেন, ‘নবান্ন উৎসব বা বাংলা নববর্ষের দিনের আমানি উৎসব-এর পেছনে আদিম সংস্কার বা জাদুবিশ্বাসের প্রভাব থাকতে পারে। এমনকি এর সঙ্গে উর্বরতার শক্তিপূজার সম্পর্ক থাকাও অস্বাভাবিক নয়। এই উর্বরতার শক্তিপূজার সঙ্গে অস্ট্রিকদের অধিক শষ্য উৎপাদন--বিশ্বাসের সম্পর্ক ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। আমানি, নবান্নের মতোই আরেক কৃষি উৎসবের নাম ‘আখের-বাখার’। এটি রাঢ়বাংলার, বিশেষ করে বীরভূম অঞ্চলের অনুষ্ঠান। পয়লা মাঘ সন্ধ্যায় এ উৎসব অনুষ্ঠান হয়। এ অনুষ্ঠানে  কোনো দেবতার পুজো নেই। এই অনুষ্ঠানটি একই সঙ্গে জাদুবিশ্বাসমূলক এবং প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানের। এর শব্দ বন্ধে মুসলিম অনুষঙ্গ লক্ষণীয়। বলা হয়, আখের বাখার অর্থ শস্যভাণ্ডার মাড়াই। এই উৎসবের মধ্য দিয়ে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ের একটি চিত্র পাওয়া যায়।’
       
অগ্র’ মানে প্রথম আর ‘হায়ণ’ মানে মাস অর্থাৎ বছরের প্রথম মাস। এক সময় অগ্রহায়ণই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। নবান্ন কৃষিভিত্তিক উৎসব হলেও এটি একটি ঋতুভিত্তিক উৎসবও। লক্ষণীয় যে, বিশ্বের অধিকাংশ নবান্ন উৎসব প্রায় সর্বত্রই শীতের আগমনী সময়ে বা হেমন্তে উদযাপিত হয়। এক সময় বঙ্গে অগ্রহায়ণ মাসে ফসল তোলার উৎসব ও নববর্ষের উৎসব দুটাই হত।  অস্ট্রিক জনগোষ্ঠী আমাদের এ অঞ্চলে কৃষিকাজের সূচনা করেছিল। কাজেই এই উৎসবও যে তাদের হাত ধরেই যাত্রা শুরু করেছিল, তাতে তেমন সন্দেহ নেই।
 

লেখক-গবেষক আহমদ রফিকের মতে, ‘অগ্রহায়ণকে বছর শুরুর মাসের মর্যাদা ছেড়ে দিতে হল মুঘল সম্রাটের হিসাব-নিকাশের কারণে। জয়ের টিপ পরানো হলো রুদ্র  বৈশাখের কপালে। সম্রাটের খাজনা আদায়ের হিসাবে পাল্লা ভারী হোক বা না হোক আবহাওয়া ও পরিবেশ বিচারে বৈশাখ কিন্তু এ দেশে উৎসব-অনুষ্ঠানের উপযোগী মাস নয়। কড়া রোদ, গুমোট গরম, মাঝে মধ্যে কালবৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব নিয়ে সময়টা মোটেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অনুকূল নয়, উপভোগ্য তো নয়ই। তুলনায় অগ্রহায়ণে শীতের আমেজমাখা রোদ, আকাশে গাঢ় নীলের বিস্তার, অনার্দ্র বাতাসের নরম ছোঁয়া সব কিছুই যেন নববর্ষ অনুষ্ঠানের অনুকূল। সব দিক বিচারে অগ্রহায়ণকে বছর শুরুর মাস হিসেবে ফিরিয়ে এনে পূর্ব-মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করাই বোধ হয় যুক্তিসংগত। নববর্ষ ও নবান্ন তখন আগের মত উৎসবে আনন্দে একাকার হয়ে যেতে পারে।’ এ কথা সত্য যে, বৈশাখ মাস থেকে বছর গণনার চিন্তাধারা এসেছিল শুধু খাজনা আদায়ের ওপর ভিত্তি করে, যেমনটি এখন সর্বত্রই আর্থিক বৎসর হিসেবে জুলাই থেকে জুন হিসাব করা হয়।
      
যে কারণেই হোক, পরবর্তীতে বৈশাখকে প্রথম মাস ধরে সরকারিভাবে ১লা তারিখে বাংলা নববর্ষ উৎসব চালু হয়। কিন্ত বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে গ্রাম বাংলায় এর একদিন পর বাংলা নববর্ষ শুরু হয়। রাজধানী-বিভাগীয় শহর-জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন- গ্রাম এমনকি জাত-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলার ঘরে ঘরে এখন পান্তা উৎসব তথা নববর্ষ উৎযাপিত হয়। 
     
লোক গবেষক আতোয়ার রহমান 'বৈশাখ' শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, বৈশাখ তার নামের জন্য বৈশাখ নক্ষত্রের কাছে কাছে ঋণী। পুরাণের মতে, বিশাখা চন্দ্রের সপ্তবিংশ পতদীর অন্যতম। হিন্দু মিথ অনুযায়ি, ‘মাস হিসেবে বৈশাখের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় আছে, যা প্রকৃতিতে ও মানবজীবনে প্রত্যাশা করা যায়-খররৌদ্র, দাবদাহ, ধু-ধু মাঠ, জলাভাব, কালবৈশাখীর ঝড় ইত্যাদি। এ সকল অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য বৈশাখের প্রথম দিন হিন্দুরা মঙ্গল শোভাযাত্রা করতো এবং  সন্ধ্যাবেলা মঙ্গলদীপ জ্বালাত। 
     
গ্রামে দেখা যেত, এই দিনে বকেয়া আদায় করা হতো, গরম ভাতের সাথে থাকত  ১৩/২১ ধরণের শাক মিশিয়ে রান্না করা একটা তরকারী, হরেক রকমের দেশি মাছ আর ডাল, সাথে বাজার হতে আনা মিষ্টি, দই।  
      
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে (পহেলা বৈশাখ এর আগের দিন) হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে তেলবিহীন নিরামিষ তরকারী রান্না করার রীতির প্রচলন ছিল, যা এখনো আছে। সমাজে শত্রু নিধনের আচার পালন করার রীতি ছিল বছরের প্রথম দিনে। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে, আমাদের  ছোটবেলায় বছরের প্রথম দিন দুপুরের স্নান  শেষে পূর্বদিকে তাকিয়ে মাথা নিচু  করে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে পশ্চিম  দিকে তাকিয়ে মুড়ির ছাতু ছুড়ে  মেরে ঘরে ফিরতাম এবং পশ্চিম দিকে  ফিরে তাকানো নিষেধ ছিল। গ্রাম-বাংলার মানুষের বিশ্বাস ছিল, এতে সারা বছর শত্রুর আক্রমণ ও অনিষ্ট থেকে  রক্ষা পাওয়া যাবে। বিগত বছরের গ্লানি মুছে ফেলার কামনায় নববর্ষের সঙ্গে উদযাপন করা হতো কিছু আচার-অনুষ্ঠানও যা হিন্দু বাঙালীরা এখনো পালন করে। চৈত্র সংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাখের দিনে গাজন বা চড়ক অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নতুন বছরের শুভ কামনা। মানুষের ধারণা চড়কের বাণফোঁড়ের কষ্টের মধ্য দিয়ে বিগত বছরের পাপক্ষয় হবে। 
 
চৈত্র সংক্রান্তি আর ১ লা বৈশাখ যেন এক সাথে গাঁথা এক পদ্য। একটাকে এড়িয়ে আরেকটা নিয়ে লেখা সম্ভব নয়। চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক পূজা, সঙ্গে চলে গাজনের  মেলা। এই গাজনের  মেলা  চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ী পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলা সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উৎসব। শাস্ত্র ও  লোকাচার অনুসারে এইদিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূণ্য বলে মনে করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির প্রধান উৎসব চড়ক। এই উপলক্ষে একগ্রামের শিবতলা থেকে  শোভাযাত্রা শুরু করে অন্য শিবতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। আবার  কোন স্থানে দেখা যায়, প্রতিটি সনাতন হিন্দু ঘরের উঠানে শিব-গৌরী  নেচে নেচে চাল-ডাল-ফল-অর্থ সংগ্রহ করে। একজন শিব ও একজন  গৌরী  সেজে নৃত্য করে এবং তার সাথে অন্য ভক্তরা নন্দি, ভৃঙ্গী, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব প্রভৃতি  সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নেচে চলে। চৈত্র সংক্রান্তির মেলাতে সনাতন হিন্দু ভক্তরা সাধারণত শূলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছের  ঘোরা, আগুনে হাঁটা প্রভৃতি সব ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য দৈহিক কলাকৌশল  দেখাতো। এখনও কিছুটা গ্রামের  মেলায় দেখা যায়। চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের  তৈজসপত্র ও  খেলনা, বিভিন্ন রকমের ফল ও মিষ্টি ক্রয়-বিক্রয় হয়। বায়াস্কোপ, সার্কাস, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে। তবে যে দিন বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস হয়ে এলো সেদিন হতেই বৈশাখের আনন্দটি চৈত্র সংক্রান্তি ও নবান্নের আনন্দের  চেয়ে আরও বড় আলাদা আঙ্গিক পেতে শুরু করে।  
     
দেশের পার্বত্য তিন জেলায় তিন দিন ব্যাপী বর্ষবরণ ‘বৈসাবী’ উৎসব পালিত হয়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান ৩টি আদিবাসী সমাজের বর্ষবরণ উৎসব। এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি। এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে বৈসুব, বৈসু বা বাইসু , মারমাদের কাছে সাংগ্রাই এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে বিজু নামে পরিচিত।  বৈসাবী নামকরনও করা হয়েছে এই তিনটি উৎসবের প্রথম অক্ষর গুলো নিয়ে। বৈ শব্দটি ত্রিপুরাদের  বৈসু থেকে, সা শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং বি শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো ‘বৈসাবি’।

 
     
পানি উৎসব বৈসাবী উৎসবেরই একটি অংশ। এ উৎসবে আদিবাসীরা সবাই সবার দিকে পানি ছুঁড়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন যেন গত বছরের সকল দুঃখ, পাপ ধুয়ে যায়। এর আগে অনুষ্ঠিত হয় জলপূজা। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়। তা ছাড়া মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা  প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে পরস্পরের বন্ধন দৃঢ় হয়।
     
ধর্মীয় ক্ষেত্রে বাংলায় (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) পূজা এখনো বাংলা বর্ষপঞ্জি নির্ভর। হিন্দু সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো যেমন বিয়ে, গৃহপ্রবেশ, অন্নপ্রাশন, সাধভক্ষণ, জামাই ষষ্ঠী, ভাইফোঁটা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের দিন নির্বাচনে বাংলা মাসের দিনকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। উৎসব পার্বণ যেমন পৌষ সংক্রান্তি, চৈত্র সংক্রান্তি এগুলোও বাংলা মাস নির্ভর। শহরে মানুষরা বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সাম্প্রতিক কালে পহেলা বৈশাখকে একটি সার্বজনীন ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের রূপ দিতে সচেষ্ট এবং অনেকখানি সফলও বলা যায়। 
     
পহেলা বৈশাখ সার্বজনীন উৎসব, পহেলা বৈশাখ আমাদের প্রাণের উৎসব। এ উৎসবের সার্বজনীনতা অসাধারণ। পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি  কোনো না  কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে ধর্মীয় অনুষঙ্গ নেই। কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেই এর প্রচলন। পরে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব মেটানো। এখন পয়লা বৈশাখ সব বাঙালির সার্বজনীন সাংস্কৃতিক আনন্দ-উৎসব। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত