পুরাণ থেকে বর্তমান

ইতিহাসের পাতায় দুর্গাপূজা

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২১, ১২:০০ |  আপডেট  : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:২৫

(চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত এই ভাস্কর্যটি ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা বারবারা মিউজিয়াম অভ আর্ট-এ আছে। সময়কাল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক। গঙ্গাল সভ্যতার রণহস্তীর বৃংহণ এবং মাতৃকাদের সাবলীল উল্লাস ভাস্কর্যটিকে মহিমান্বিত করেছে।)

 

 

শাশ্বত স্বপন 
--------------
১ম পর্ব
ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্থান--ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীতে দুর্গোৎসবের কালক্রমিক ইতিহাস তৈরি করা এখনো সম্ভব হয়নি। এ কাজের উপযোগী সুস্পষ্ট ও অনুপুঙ্খ ধারাবাহিক তথ্য-উপাত্তও পাওয়া যায়নি। কোন ইতিহাসবিদ বা সমাজবিজ্ঞানী ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীতে দুর্গোৎসব উদ্ভবের ইতিহাস ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপঞ্জি নির্ভরযোগ্য দলিলপত্র ঘেঁটে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি। ফলে কখন, কীভাবে দুর্গোৎসব শুরু হলো--তা এখনো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে পুরাণ, মহাভারত, রামায়ন, ধর্মীয় কাব্য, নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও সূত্র থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। বাঙালী, ওড়িয়া, মৈথিলী ও অসমীয়া, ত্রিপুরা জাতি ছাড়াও আরো কিছু জাতি নানান রূপ চেতনায়, নানা উপাচারে শরতে বা বসন্তে দুর্গাদেবীর উপাসনার আয়োজন করে থাকে।

দুর্গাপূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল--তা নিয়ে ভারতীয় ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানা মতভেদ আছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন  ছিল। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের, আর অনার্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবীদের, তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতা শক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারনা। 

ভারতে অবশ্য মাতৃরূপে দেবী সংস্কৃতির ধারনা অতি প্রাচীন। ইতিহাস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রায় ২২,০০০ বছর পূর্বে ভারতে প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠি থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত শুরু হয়েছিল। হরপ্পা ও মহেন্জোদারো সভ্যতা তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরো গ্রহণযোগ্য, আধুনিক ও বিস্তৃত হয়। মাতৃপ্রধান পরিবারের মা-ই প্রধান শক্তি, তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়, তার নেতৃত্বে শত্রু নাশ হয়, আর তাই মাকে সামনে রেখে দেবী বিশ্বাসে গড়ে উঠে, গড়ে ওঠে শাক্ত সম্প্রদায় মতামত। এই মত অনুসারে দেবী হলেন, শক্তির রূপ, তিনি পরমব্রহ্ম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। অন্যান্য দেব দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপে প্রকাশ মাত্র। মহাভারত অনুসারে, দুর্গা বিবেচিত হন কালী শক্তির আরেক রূপে। নানা অমিল ও বৈচিত্র থাকা সত্বেও কিভাবে কালী দুর্গা রূপের সাথে মিশে এক হয়ে গেল, সে রহস্য আজও অজানা। কেউ কেউ ধারনা করেন, সিন্ধু সভ্যতায় (হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা) দেবীমাতার, ত্রিমস্তক দেবতা, পশুপতি শিবের পূজার প্রচলন ছিল। যদিও কোন কোন গবেষক মনে করেন, কালী ও দুর্গাদেবীর সাথে কোন এক সময় শিবকে জুড়ে  দেওয়া হয়েছে।

পুরাণ মতে, দুর্গাপূজার ইতিহাস আছে কিন্ত ভক্তদের কাছে সেই ইতিহাস প্রামানিক নয়, বিশ্বাসের। উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু ও বেলুচিস্তানে শিবকে দিয়ে যে হিন্দুধর্মের যাত্রা শুরু হয়েছিল, পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলায় দুর্গা ও কালীকে দিয়ে সে ধর্মযাত্রার সমাপ্ত হয়...। এরপর সম্ভবত আর কোন অলৌকিক দেবতার জন্ম হয়নি।

অস্ট্রিকভাষী নিষাদেরা প্রাচীন বাংলার গভীর অরণ্যে, বোঙ্গা দেবতার পূজা করত । কোনও কোনও পন্ডিতের ধারণা ওই বোঙ্গা থেকেই বঙ্গ, বাংলা শব্দের উদ্ভব। পৌরাণিক আর্যদের ব্যাখ্যায়, দুর্গা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবকর্তৃক সৃষ্ট দেবী এবং দুর্গা কিছুটা উগ্র, স্বাধীন, কারও স্ত্রী নন। বাংলার হিন্দুধর্মটি হল তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম। তন্ত্র হল বেদবিরোধী এবং সাধনার বিষয়। যে কারণে বাঙালি তান্ত্রিকেরা দুর্গাকে পরমা প্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

প্রাচীন বাংঙ্গালীরা ছিল অবৈদিক আর অনার্য। তারা সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহু লোকিক-অলৌলিক দেবদেবীর পূর্জা-অর্চনা করত। প্রাচীনকালে দুর্গাপূজা শস্য পূজারূপে বিরাজমান ছিল। পার্বতী-উমা ছিল শস্যপূজার দেবী। পার্বতী-উমা দুর্গারই ভিন্ন ভি্ন্ন নাম। উমাকে বলা হয় হিমালয়-দুহিতা। যার বাহন সিংহ। সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীই ভারতবর্ষের শক্তি দেবীর প্রাচীন রূপ। এই সিংহবাহিনী পর্বতকন্যা উমা-পার্বতীর সঙ্গে শস্য  পূজার ধারা মিশে এক মহাদেবীর সৃষ্টি হয়েছে-- ইনিই দুর্গা। আবার দুর্গাকে মহিষমর্দিনী, মহিষাসুরমর্দিনীও বলা হয়। এই প্রসংগে দুর্গা গবেষক তমাল দাসগুপ্ত মনে করেন, ‘মহিষমেধ হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে চলে আসছে। এই মহিষটাই পরে অসুররূপ নিয়েছে। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে হরপ্পা সভ্যতায় মহিষমেধ একটি ধর্মীয় ঐতিহ্য বহন করত। হরপ্পা সভ্যতা মাতৃকা উপাসক ছিল, সেখানে মহিষকে বলি দিয়ে মাতৃকাকে তুষ্ট করা হত মনে করা যায়। এর সঙ্গে আর্য আগ্রাসনের সম্পর্ক নেই, কারণ এটি আর্যপূর্ব ঐতিহ্য বলেই বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ একমত। এর সঙ্গে কোনও অসুরের সম্পর্ক নেই। মহিষ থেকে অ্যান্থ্রোপোমর্ফিক মহিষাসুরের উৎপত্তি। মহিষমর্দিনীর উৎসব ভারতে অত্যন্ত প্রাচীন। মহিষঘাতিনী মাতৃকার মূর্তি বাংলায় পঞ্চম শতকে প্রথম পাওয়া গেছে। মহিষাসুরমর্দিনীর উপাসনা পালযুগে শুরু হয় নবম শতকে, এই উপাসনা কর্ণাটক থেকে এসেছিল, পালদের সঙ্গে রাষ্ট্রকূটদের বৈবাহিক সংযোগ একটি কারণ হতে পারে, তাছাড়া কর্ণাট-কোঙ্কন উপকূলে বাঙালিদের আগমন (গৌড় সারস্বত মাইগ্রেশন), ফলে একটা চলাচল ঘটেছিল। ধর্মপাল তাঁর সৈন্যদের নিয়ে গোকর্ণ তীর্থে তর্পণ করেছিলেন বলা হয়েছে। কাজেই, মহিষাসুরমর্দিনী রূপ দক্ষিণ থেকে বাংলায় আসার ইতিহাসটি নথিবদ্ধ। মহিষাসুরের সঙ্গে পূর্ব ভারতের অস্ট্রো-এশিয়াটিক অসুর উপজাতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।’
 

ছবিতে দেখছেন হরপ্পা সভ্যতায় মহিষমেধ-এর ধর্মীয় রিচুয়ালঃ গ্র্যাফিক বর্ণনাসহ টেরাকোটা ফলক। harappa.com-এর buffalo sacrifice শীর্ষক অনুচ্ছেদ থেকে ছবিটা সংগৃহীত

 

গবেষক ডি ডি কোসাম্বি তার গবেষণায় উল্লেখ করেছেন, হরপ্পা সভ্যতার ঊষা নামে এক মাতৃকাদেবীর ছিল। গবেষক সুকুমার সেন মনে করেন, ঊষা দেবীর উপাসনা শরৎকালে হত। সেক্ষেত্রে এই শারদীয়া মাতৃকা উপাসনা উপমহাদেশে অন্তত সাড়ে চার হাজার বছর ধরে প্রচলিত বলা যায়।  তবে এটাও সত্য, হাজার হাজার বছর ধরে মাতৃকা দেবীপ্রধান এই ভারতে শরৎকালে অনেক দেবীর পূজাই হত।

প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা।
বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদ্যৌ গোলকে রাগমণ্ডলে।
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ।
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।।
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা।
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈর্দেবৈশ্চ মুনিমানবৈঃ।
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভূব সর্ব্বতঃ সদা। (ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ)

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দুর্গাপূজার প্রথম প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ, তিনি বৈকুন্ঠের আদি বৃন্দাবনের মহারাস মণ্ডলে প্রথম পূজা করেন, এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে দ্বিতীয় বার দুর্গাপূজা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে  তৃতীয়বার দুর্গা পূজার আয়োজন করেন মহাদেব। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনিঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষেরা নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গাপূজা করে আসছে।

(বৈষ্ণবী ও বারাহী দেবী শুম্ভ-নিশুম্ভের অসুরসৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধরতা, সপ্তদশ শতাব্দীর পুঁথিচিত্রণ)


               

আবার দেবী ভাগবত পুরান অনুসারে জানতে পারি, ব্রহ্মার মানস পুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন। দুর্গা তার রাজ্যশাসনের পথ নিষ্কণ্টক করেন এবং মনুকে পুত্রলাভের বরও দেন। 

 দুর্গা ও দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যতগুলি পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি পাওয়া যায়  শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্মম-এ । এই গল্পটি হিন্দুরা এতটাই মান্য করে যে,  শ্রীশ্রীচণ্ডীর পাঠ দুর্গাপূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। দেবীমাহাত্মম  আসলে মার্কণ্ডেয় পুরান-এর একটি নির্বাচিত অংশ। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি শ্লোক আছে। এই বইতে দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প ও দুর্গাপূজা প্রচলনের একটি গল্প রয়েছে। 

পুরাণ মতে, দুর্গা পর্ণশবরী ৷ তিনি শবরদের দেবী, পর্ণশবরী ৷ দেবী ভাগবতে হলেন, সর্বশবরানাং ভগবতী৷ ঝাড়খণ্ডের বনবাসী শবর মেয়েরা এখনও দুর্গা মূর্তি বিসর্জনের শোভাযাত্রায় আকণ্ঠ মদ্যপানের পর উর্ধাঙ্গ অনাবৃত রেখেই নাচতে নাচতে বিসর্জনে যান৷ মহাভারতের পরিশিষ্ট হরিবংশ-এর আর্যাস্তব-এ বলা হয়েছে, শিখীপিচ্ছধ্বজাধরা ও ময়ূরপিচ্ছধ্বজিনী এই বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর মদ্য ও মাংসে ছিল অপরিসীম আসক্তি। সপ্তম ও অষ্টম শতকের কবি বাণদেব ভট্ট ও বাকপতিও এই মতেই বিন্ধ্যবাসিনী দেবীর পুজোর উল্লেখ করে বলেছেন, দেবী পশু ও নররক্তের পিপাসু ছিলেন। কথাসরিৎসাগর-এর বেতালপঞ্চবিংশতি অংশে একাদশ শতকের পণ্ডিত সোমদেব ভট্ট বলেছেন, রাজা যশকেতুর রাজ্যে মহিষের কাটা মুণ্ড-র উপর নৃত্যরতা আঠারো হাত বিশিষ্ট এক দেবীর কথা, দস্যু ও ডাকাতরা যার কাছে নরবলি দিত।শাস্ত্র মতে, এই দেবীর নাম পাতালভৈরবী। আসলে দুর্গা-কালী-চন্ডী-পাতালভৈরবী সহ আরো নানা দেবীকে দুর্গার সাথে গুলিয়ে ফেলে নানা কথা বলা হয়েছে। হয়তো সুপ্রাচীন কালে দুর্গাকে এরূপেই পূজা করা হত এবং এগুলোই ছিল দুর্গার আদিরূপ।   
                                                                                         

( চলবে)

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত