মামলার ৪ দিনেও মূল আসামীদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ

আদমদীঘিতে শালিশে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে পিটিয়ে হত্যা

  মোঃ হেদায়েতুল ইসলাম (উজ্জল)

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৩, ১৫:০৭ |  আপডেট  : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৪৮

 

৭১ এর সহযোদ্ধা বন্ধু মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের হারিয়ে যে দুঃখ বেদনা যন্ত্রনা হয়েছিল। আজ ২২ বছর পর নিজপুত্র হত্যার পর আবার নতুন করে সেই শোক যন্ত্রনা জাপটে ধরেছে কমান্ডার আবুল হোসেনকে। ৭১এর ঘাতকদের চেয়েও নির্মম ওরা, বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হোসেনকে শান্তনা দেওয়ার যেন কেউ নেই। কিছুদিন আগেই হারিয়েছে স্ত্রীকে। এবার হারালো যুবক পুত্রকে। কোন রোগে শোকে পুত্রের মৃত্যু নয়। ঘন্টার পর ঘন্টা নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা। পুত্র শোকে মুহ্যমান এই বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুল হোসেন। আরো হৃদয় বিদারক আমিনুলের শিশু পুত্র/কন্যার বুক ফাটা আর্তনাদ। কেউ তাদের বাড়িতে গেলেই বাবা বাবা বলে চিৎকার করে কাঁদছে। আর বাবাকে খুঁজছে। গ্রামের নাম লক্ষীপুর, এই গ্রামের লক্ষীকে  বিদায় করে দিয়ে দখলে নিয়েছে অশুর। এটা এখন অশুরপুর, অশুর দলের ভয়ে আতংকে আতংকিত, ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামের সব মানুষ। এই গ্রাম কে শাসন করবে?

এই নিয়ে বিবাদ দীর্ঘ দিনের। গ্রামের মসজিদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও মসজিদ কমিটি পরিচালনা নিয়ে শুরু হয় দন্দ্ব। এই দ্বন্দে আধিপত্য হারায় ওই গ্রামের মরহুম গফুর হাজীর দল। আধিপত্য অর্জন কর তহিদুল-শাহিন বাহিনী। গ্রামের মানুষকে নতুন করে শাসন করতে শুরু করে তারা। এদের শ্লোগান ‘মাইরের উপর ঔষধ নাই’। আগে মার তারপর জরিমানা। এই ধারাবাহিকতা চালিয়ে আসছে তহিদুল-শাহিন ক্ল্যাস কমিটি। এদের ১৪ সদস্যের বিচারক কমিটির আদেশই এ গ্রামের আইন। সরজমিনে লক্ষীপুর গ্রাম ঘুরে জানা যায়, নিহত আমিনুলও স্থানীয়ভাবে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য ছিল। লক্ষীপুর গ্রামে শাহীনের নেতৃত্বে এই চক্রের ১৪ জন সদস্য কাজ করেন। তারা সবাই স্থানীয়ভাবে জমি বেচা-কেনাসহ নানা বিচার সালিসে তদবিরের কাজ করতেন। সম্প্রতি এক জমি বেচা-কেনা নিয়ে এই চক্রের হাতে আসে দুই লাখ টাকা। এ টাকা গুলো তাদের দলনেতা শাহিনের কাছেই গচ্ছিত ছিল। এই টাকার ভাগাভাগি নিয়ে গত ২২ মার্চ বুধবার রাতে লক্ষীপুর গ্রামে ক্লাব ঘরের সামনে একটি শালিসী বৈঠক বসে। ওই শালিসে আমিনুলের সাথে শাহিনের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দন্দ্ব দেখা দেয়। এর জেরে শালিস বৈঠক শেষে শাহিন ও তার সহযোগীরা মিলে ধারালো অস্ত্র দিয় কুপিয়ে হত্যা করে বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেমের ছেলে আমিনুর ইসলাম (৪০) কে।

এ ব্যাপারে আমিনুরের বড় বোন আফরোজা বেগম বাদী হয়ে তহিদুল-শাহীন সহ ৩৭ জন ও অজ্ঞাতদের আসামী করে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ মামলার পর ওই গ্রামের আইয়ুবের ছেলে ইসলাম ও আবু বক্কর এবং আফজালের ছেলে ওয়াহেদকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। কিন্তু ঘটনার ৪ দিন অতিবাহিত হলেও হত্যা মামলার মূল আসামীদের এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। বর্তমানে হত্যা মূল আসামী সহ অন্যান্য গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে রয়েছে। সরজমিনে ওই গ্রামে গেলে একের পর এক মানুষের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে তহিদুল-শাহিন গ্রুপের লুটপাট, চাঁদাবাজি ও নির্যাতনের কাহিনী। ওই গ্রামে কারো না কারো চুন থেকে পান খুসলেই তহিদুল-শাহিন গ্রুপটি আমলে নিয়ে নেয় ঘটনা এবং ওই গ্রামে বিচার শালিস বসিয়ে মোটা অংকের জরিমানা আদায় সহ বিভিন্ন চাঁদাবাজীর টাকার ভাগবাটোয়ারা করে নেয় তারা। এ নিয়ে গ্রামবাসী অতিষ্ট হয়ে ওই গ্রামের প্রায় ৩০/৪০ টি পরিবার প্রাণ ভয়ে নিজ গ্রাম ছেড়ে আদমদীঘি, মুরইল, সান্তাহার, নওগাঁ সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। এই হত্যা কান্ড ঘটার পর আদমদীঘি থানায় মামলা হলে আসামীরা পলাতক থাকার কারণে গ্রামের লোকজনদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে এবং গ্রামছাড়া লোকজন একের পর এক নিজ গ্রামে ফিরতে শুরু করেছে। 

গ্রামছাড়া লোকজন বাড়ি ফিরে দেখেন তাদের বাড়িতে দরজা, জানালা ভাঙ্গা এবং বাড়িতে বড় ঘাস জন্মে গেছে। বাড়ি গুলো যেন পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে। নিহতের স্ত্রী রুখসানা বেগম জানান, গ্রামের দুই গ্রুপের মধ্যে তার স্বামী প্রথম দিকে ছেদ্দা গ্রুপে ছিল। পরে শাহিন গ্রুপে যোগ দেয়। গত ২২ মার্চ বুধবার মোবাইল ফোনে তার স্বামীকে ডেকে যাওয়ার পর সে আর বাড়ি ফেরেনি। ওই দিন রাত সাড়ে ১০ টার সময় আমি মোবাইল ফোনে জানতে পারি আমার স্বামীকে খুন করে লক্ষীপুর গ্রামের ক্লাব ঘরের পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে দেখি আমার স্বামীর শরীরে বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে হত্যা করা হয়েছে। লক্ষীপুর গ্রামের আলিম উদ্দিন জানান, তিনি তহিদুল-শাহীন গ্রুপের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার খবর
পেয়ে দীর্ঘ এক বছর পর গত শুক্রবারে বাড়ি ফিরেছেন। এক বছর ধরে তিনি নওগাঁয় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিলেন। তার কাছ থেকে তহিদুল-শাহিন গ্রুপ ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবী করেছিল। চাঁদা না দেয়ায় তাকে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। ওই গ্রামের গামেন্টর্স ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম ও তার মা হাজেরা জানান, ওই গ্রুপের অত্যাচারে তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি এখন নিঃস্ব। আফজাল হোসেন নামের একজন জানালের তিনি শুক্রবার বাড়ি ফিরছেন। ফেরার পথে তাদের সাথে কথা হলে তিনি জানালেন, দীর্ঘ ১৮ মাস পর তিনি বাড়ি ফিরছেন। তার কাছে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবী করা হয়েছিল। তিনি ১৮ মাস আগে নিজ গ্রাম ছেড়ে আদমদীঘি সদরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। গ্রামের লোকজন সমস্বরে জানালের তহিদ-শাহিন গ্রুপের চাঁদাবাজী, লুটপাট ও মারপিটের ভয়ে প্রায় ৩০/৪০ টি পরিবার গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করছেন। ওই গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে তহিদ ও বীরমুক্তিযোদ্ধা মৃত জাফের আকন্দের ছেলে শহিদ এবং জনৈক রুবেল সহ অনেকেই জানালেন, তহিদ-শাহিন গ্রুপের লোকজন এই ক্লাব ঘরটি তারা টর্চার সেল হিসাবে ব্যবহার করতো।

এ ব্যাপারে আদমদীঘি থানার অফিসার ইনচার্জ রেজাউল করিম রেজা জানান, হত্যার মামলার ৩ জনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়েছে এবং বাকি আসামীদের গ্রেফতারের তৎপরতা চলছে।
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত