অজানা রবীন্দ্রনাথ

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ৭ আগস্ট ২০২২, ১০:১৯ |  আপডেট  : ২ মে ২০২৪, ১৭:৪৯

উপস্থাপিত পদ্যচিত্রলিপিটি ১৯১৮ সালে কবিগুরু স্বহস্তে লিখে জাপানি বন্ধু চিত্রশিল্পী আরাই কানপোকে উপহার দেন, যখন বিচিত্রা ভবন ছেড়ে শিল্পী জাপানে প্রত্যাবর্তন করবেন তখন। মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে তোচিগি-প্রিফেকচারস্থ মিউজিয়াম উজিয়ে ভবনে সংরক্ষিত আছে।

প্রবির বিকাশ সরকার 
----------------------------
 

 

আজ ২২শে শ্রাবণ। 
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বজগৎ ছেড়ে দিয়ে অদৃশ্য জগতে চিরদিনের জন্য চলে যাওয়ার দিন। বহু ভক্তকে কাঁদিয়ে-ভাসিয়ে তাঁর মহাপ্রস্থান অবিস্মরণীয়। এই বিদায়ের দিন স্মরণ করে তাঁর প্রতি আনত শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি। 

সম্ভবত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই একমাত্র কবি যাঁর প্রয়াণদিবসটিকে আমরা বিভিন্নভাবে উদযাপন করে থাকি। তাঁর গান গেয়ে তাঁকে স্মরণ করি। তাঁর গীতিনাট্য মঞ্চস্থ করি।তাঁর আলোকচিত্র প্রদর্শন করি। সাহিত্যসভার আয়োজন করি। সেমিনার বা আলোচনা সভা করি। এসব রবীন্দ্রসংস্কৃতিরই অঙ্গ। তাঁর জন্মদিনের ক্ষেত্রেও তাই হয়ে থাকে দেশ-বিদেশে। একজন কবিকে কেন্দ্র করে একটি সংস্কৃতি গড়ে ওঠার নজির বিশ্বের আর কোনো দেশে পরিলক্ষিত হয় না। সংস্কৃতি মানে একটা বিশালত্বের ব্যাপার আছে। নানা কর্মকাণ্ড, আচার-আচরণের বিষয়-আশয় আছে। রবীন্দ্রনাথের জীবন, কর্মযজ্ঞ এবং সৃষ্টকর্মে সেসব বিস্তর আছে বলেই "রবীন্দ্রসংস্কৃতি" আলাদা মাধুর্য, সম্প্রীতি এবং গভীর ভালোবাসার সঙ্গে বাঙালির জীবনাচারে উজ্জ্বল স্থান দখল করে আছে। আর এই রবীন্দ্রসংস্কৃতি যে কত গভীর এবং আলোকিত বৈচিত্র‍্যময় তা আর না বললেও চলে। 

রবীন্দ্রসংস্কৃতির একটি অজানা বা অল্পজানা দিক হচ্ছে বাংলা লিপিচিত্র। বাংলায় লিপিচিত্র অঙ্কনের প্রতি তাঁর কেন আগ্রহ হল সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তবে ধারণা করি, তিনি চিনা ও জাপানি কানজি অক্ষরের লিপিচিত্র বা ক্যালিওগ্রাফি কলকাতায় জাপানি মনীষী শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন অথবা জাপানি চিত্রশিল্পীদ্বয় য়োকোয়ামা তাইকান ও হিশিদা শুনসোওর কাছ থেকে জেনেছিলেন অথবা লিখিত, মুদ্রিত কিছু দেখেছিলেন সর্বপ্রথম। চিরনতুনের পিয়াসী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সাধারণত কানজি লিপিচিত্র তুলির সাহায্যে হাতেতৈরি ওয়াশি পেপার এবং সিল্ক কাপড়ের ওপর আঁকতে বা লিখতে হয়। যা আদৌ সহজ কাজ নয়। যথেষ্ট কষ্টসাধ্য একটি চর্চা এই লিপিচিত্রকলা। সাধারণত লিপিচিত্রকলা কোনো না কোনো গুরুগৃহে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। এইসব স্কুলকে বলা হয় "শোদোওশিৎসু", এবং ঐতিহ্যবাহী একটি সংস্কৃতি জাপানে। এখনো এর চর্চা হচ্ছে জাপানে। জানি না চিনে হয় কি না? টোকিওর অনেক জায়গায় লিপিচিত্রকলার গুরুগৃহ রয়েছে। অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষা দেয়া হয়। প্রতিবছর প্রতিযোগিতাও অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। 

রীতি অনুসারে স্বাক্ষর, প্রবাদ-প্রবচন, বাণী, হাইকু, শুভেচ্ছাবার্তা, অভিনন্দনজ্ঞাপন, প্রসংশাপত্র ইত্যাদি লিপিচিত্রের মাধ্যমে চিত্রিত হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে। কবিগুরু ১৯১৬ সালে প্রথম জাপান ভ্রমণকালে কানজি লিপিচিত্র অজস্র দেখতে পেয়েছিলেন পথেঘাটে, গৃহে-ভবনে, প্রতিষ্ঠানে, বিদ্যালয়ে, মন্দিরে এবং নানা ধরনের প্রকাশনায়। যা তাঁকে আরও আগ্রহী করে তুলেছিল বাংলা ভাষায় একটা সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণে বলে আমার বিশ্বাস। জাপানি বন্ধুদের সহযোগিতায় তিনি শুভেচ্চাবার্তা ও বাণী ছন্দের মাধ্যমে কবিতাকারে ওয়াশি পেপার এবং সিল্কের ফিনফিনে কাপড়ে তুলি দিয়ে সুমি ইরো বা কালোকালিতে লিখে একাধিক বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে উপহার দিয়েছেন।এগুলো "শিশো" বা "পদ্যচিত্রলিপি" নামে পরিচিত। 

পাঁচবার জাপান ভ্রমণকালে কবিগুরু কতজনকে এরকম পদ্যলিপিচিত্র উপহার দিয়েছেন তার হিসেব পাওয়া যায় না। অনেক হারিয়েও গিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সংরক্ষিত আছে এমন কয়েকটি স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি যথাক্রমে ওওকুরায়ামা কিনেনকান ভবন, মিউজিয়াম উজিয়ে এবং মুসাশিনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হচ্ছে যাতে নষ্ট না হয়। মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য।এতেই বোঝা যায় কতখানি গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথকে জাপানে। অথচ, কতিপয় অবিবেচক, মিথ্যা অপপ্রচারকারী, পরশ্রীকাতর বাঙালি গবেষক রবীন্দ্রনাথকে সিফিলিসের রোগী পর্যন্ত বানিয়ে গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে ফেলছে নির্দ্বিধায়! ছড়িয়ে দিচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। ভাবতেও রুচিবোধে বাধছে। এসব অপপ্রচার করে কি রবিচ্ছটাকে কলঙ্কিত করা যাবে হে নরাধম! 

 

 
শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সভাপতি, জাপান-বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব


 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত