সিডরের কথা মনে হইলে আইজও কইলজাটা মোচড় দিয়া ওডে!

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২১, ১০:৫০ |  আপডেট  : ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১৪:১২

‘সিডরের কথা মনে হইলে আইজও কইলজাটা মোচড় দিয়া ওডে। হারা রাইত ঘুমাতে পারি না। চোহের হোম্মে দিয়া মোর ঘরটা পালকের মতো উঠাইয়া নিয়ে গ্যালো। চাইর দিকে পানি আর পানি। কত মানুষ যে মরল! ছাগল আর গরু পানিতে ভাইষ্যা গ্যালো...। ’ সিডরের দিনের ভয়াল স্মৃতি এমনভাবেই প্রকাশ করছিলেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের তাহেরপুরের মো. বাশার। তার মতো এমন দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়ান উপকূল অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ। অথচ সিডরের ১৪ বছর পার হলেও নির্মিত হয়নি উপকূলীয় রক্ষাবাঁধ। ভাঙা বেড়িবাঁধ দিয়ে অতিবর্ষণ কিংবা আমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে যায় ফসল-ফলাদি। তলিয়ে যায় মাছের ঘেরসহ পুকুর। আমনচাষে সমস্যা হয়। লবণ পানি উঠে নষ্ট হয় ফসল। শক্ত বেড়িবাঁধ না হওয়ায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের খবরে আতঙ্কে থাকে উপকূলবাসী।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন সিডর। প্রাণ হারায় বহু মানুষ। ল-ভ- করে দেয় উপকূলবাসীর জীবন মান। তাদের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তা। ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয় অসংখ্য মানুষ।

সরকারি হিসাবে সিডরে বাগেরহাট জেলায় নিহত হয়েছেন ৯০৮ জন, আহত ১১ হাজার ৪২৮ জন। সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় ৬৩ হাজার ৬০০ বাড়িঘর। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় পাকা ৫ কিমি. এবং কাঁচা প্রায় ৫০ কিমি.। ১৬.৫ কিমি বাঁধ, ২০৬টি স্কুল ও মাদ্রাসা, ৫টি কলেজ, ৪ হাজার ৭৬৯টি নৌকা ও ট্রলার ধ্বংস হয়। মারা যায় ১৭ হাজার ৪২৩টি গবাদিপশু। বিনষ্ট হয় ১২ হাজার হেক্টর ক্ষেতের ফসল ও ৮ হাজার ৮৮৯ হেক্টর চিংড়ি ঘের।

সিডরে পটুয়াখালীর নিজামপুর গ্রামের পাউবোর ৪৭/১ পোল্ডারের বেরিবাঁধের বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দেয়। এর পর ২০০৮ ঘূর্ণিঝড় নার্গিস, ২০০৯ আইলা, ২০১৩ মহাসেন, ২০১৫ কোমেন, ২০১৬ রোয়ানু, ২০১৭ মোরা, ২০১৯ ফণী ও বুলবুলের তা-বে নিজামপুর বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কয়েকবার সংস্কারসহ তিনবার পুনর্নির্মাণ হলেও সাগর মোহনা আন্ধারমানিক নদীর অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ারে পানি ভাঙনকবলিত অংশ দিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করে। দফায় দফায় প্লাবিত হয় ওই ইউনিয়নের পুরান মহিপুর, ইউসুফপুর, নিজামপুর, কোমরপুর ও সুধিরপুর গ্রামের অন্তত তিন হাজার একর জমি। দীর্ঘ ১৪ বছরে কাক্সিক্ষত ফসল পায়নি কৃষকরা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নদীভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্মাণ করে রিং বেড়িবাঁধ। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ফের এ বাঁধটির বিভিন্ন স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

নিজামপুর গ্রামের বাসিন্দা প্রভাষক শাহ আলম বলেন, সিডরের পর থেকে পাঁচ গ্রামের মানুষ ১০ বছর ধরে জমিতে কোনো চাষ করতে পারেনি। এর পর পানি উন্নয়ন বোর্ড রিং বেড়িবাঁধ করে। কিন্তু যে কোনো ঘূর্ণিঝড়ে তা বিলীন হয়ে যায়।

মহিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলু গাজী জানান, এ ইউনিয়নের নিজামপুর ও সুধীরপুর গ্রাম সাগর মোহনাসংলগ্ন। শুধু অমাবস্যা-পূর্ণিমাই নয়, জোয়ার-ভাটার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয় তাদের। পূর্বের বেড়িবাঁধ নেই। এখানে সাড়ে আটশ মিটার রিং বেড়িবাঁধ হয়েছে। তাও আবার আম্ফানে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, সিইইপি প্রজেক্ট বর্তমানে চলমান আছে। ৪৮ ও ৪৭/২ পোল্ডারের কাজ এগিয়ে চলছে। ৪৮ পোল্ডারে প্রায় ৩৮ কিমি. ও ৪৭/২ পোল্ডারে ১৭ কিমি. কাজ সম্পন্ন হলে অনেক জায়গাই সুরক্ষিত হবে। মাঝে মাঝে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাগুলো আমরা মেরামত করি।

এদিকে সিডরের আঘাতে বরগুনায় ৯০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৫০ কিলোমিটার। সিডরের পর উপকূলীয় মানুষের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণই ছিল তাদের মূল দাবি, তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এখনো দুর্যোগকালীন বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। তলিয়ে যায় বসতিভিটা, ফসলি জমি, মাছের ঘের, ফসলের ক্ষেত। মানুষের পাশাপাশি সীমাহীন দুর্ভোগ নেমে আসে গবাদিপশুর। ভাঙনের কবলে চোখের সামনে বিলীন হয় শেষ সম্বলটুকু। তাই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ জরুরি প্রয়োজন উপকূলের জনপদে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বরগুনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার বলেন, ২০০৭ সালের সিডরের পর প্রায় ২৮০ একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে আনুমানিক ১০০-১২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বর্তমানে ৩০ কিলোমিটার বাঁধ ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে বর্তমানে দুটি প্রকল্প প্রি একনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়ে বর্তমানে প্ল্যানিং কমিশনে রয়েছে। এ ছাড়া আরও দুটি প্রকল্প বর্তমানে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যাচাইয়ের পরে প্ল্যানিং কমিশনে রয়েছে। ভাঙন রোধে ৫-৬ হাজার কোটি টাকা হলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত