দুঃসাহসিক অভিযান

সাইপ্রাং ঝরনা

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ১ অক্টোবর ২০২১, ১০:১৪ |  আপডেট  : ৪ মে ২০২৪, ০০:০৯

কাওসার পলাশ
 -------------------
 
পর্ব ১

পাহাড়ের সৌন্দর্য এবং নেশা আমাকে কাবু করছিলো সেই ২০১৩ সালে ঘুরতে যাওয়া নীলগিরির থেকেই। নীলগিরির পরেও যে আরো পাহাড় আছে এবং সেখানেও যাওয়া যায়, সেটা জানার পর আমার মাথায় ভিতর পাহাড় যেনো একটা পোকার মতো স্থায়ীভাবে বাসা বাধে, তখন থেকেই যেনো আমার মনের ভিতর লালিত স্বপ্নটা দিন দিন বড় হতেই লাগলো। কিন্তু সেই স্বপ্নটা স্বপ্নের জায়গায় যেনো ঘুরপাক খেতে থাকলো। কোন ভাবেই আমার দ্বারা নীলগিরির বেশি যাওয়া হয়ে উঠছে না।
যাই, হোক হটাৎ করেই ফেবুতে পাহাড় নিয়ে এক বড় ভাইয়ের একটা চমৎকার পোস্ট চোখে পড়লো। সাথে সাথেই ইনবক্সে গিয়ে সেই ভাইকে নক দিলাম। সময়টা  ২০১৭ সালের মে মাস হবে। সেই ভাইয়াও আমার রিপ্লাই দিলেন, আমি তাকে পাহাড় নিয়ে আমার আগ্রহ জানালাম।উনি বললেন,  মতিঝিলে উনার অফিসে গিয়ে একদিন উনার সাথে দেখা করার জন্য, আমিও তাই করলাম। দেখা করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে উনি উনি বললেন " আপনাকে নিয়ে সাইংপ্রা যাবো ভাবছি"।
আমি ফাস্ট টাইম নাম শুনলাম। জানতে চাইলাম, এটা কোথায়? তিনি বললেন আমাদের দেশেই।
 
 আমার ইচ্ছা ছিলো কোন এক কঠিন ট্রেইলে যাবো, কিন্তু এই নামটা যেহেতু ফাস্ট টাইম শুনলাম তাই ভাবলাম এতটা সহজ জায়গায় যাবো। মনে মনে হ্যাপি ছিলাম না। ভাবলাম  আমিয়াখুম নাফাখুম যেতে পারলে কতটা মজা হতো। আমার ইচ্ছা উনাকে জানানোর পর উনি আমাকে যা বললেন, তাতে করে রীতিমতো আমার শরীরে শিহরণ চলে আসলো। আমাদের তারিখও ফিক্সড হয়ে গেলো। আমার অপেক্ষাও যেনো আর শেষ হয় না। এর মাঝেই একদিন পৃথিল ভাই আমাকে অদ্রি থেকে প্রকাশিত সাইংপ্রা নিয়ে একটা পোস্ট দেখালেন। সেই পোস্ট পড়ে আমার মনে অতি ভয়ংকর এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি প্রবেশ ঘটে। সেই পোস্ট দেখার পর আমি রীতিমতো ভয়ে ছিলাম আমি পারবো কিনা? অন্যদিকে আবার টাইগার জোকের নামও প্রথম শুনলাম। এমনিতেই জোক আমার ভীষণ ভয়, তার মধ্যে আবার টাইগার জোকের বর্ণনা শুনে আমার ঘুম হারাম। একটা অজানা আতংক যেনো আমাকে বারবার তাড়া দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোন এক কঠিন বিপদের দিকে যেন আমি আস্তে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। জল্পনা কল্পনার মাঝে হাজারো অজানা প্রশ্ন গুলোও যেনো আমার আগ্রহের মাত্রা শতগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। 
 
যাই হোক, লিস্ট অনুযায়ী যা যা দরকার সব কিছুই কেনা-কাটা শেষ করলাম। পৃথিল ভাইয়ের থেকে আমি জানালাম সেখানে কোন খাবার নাই, তাই আমাদেরকে পর্যাপ্ত খাবার নিয়েই সেখানে যেতে হবে। চাল, ডাল, আলু, পেয়াজ, তেল, খেজুর এবং কিসমিস কিনে প্যাকেট করে আমরা তৈরি। এর মধ্যেই পৃথিল ভাই জানালেন আমাদের সাথে একটা মেয়েও জয়েন করবে এবং সে পাহাড় সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞ। তার নাম  ইফফাত আরা নার্গিস । সে আসবে দিনাজপুর থেকে। যথাসময়ে সে চলেও আসলো।  অবশেষে সেই অপেক্ষার পালা শেষ হলো। আমাদের কাংখিত সময় চলে আসলো। 
সময়টা ছিলো ২০১৭ সালের ৯ অগাস্ট। মনে অজানা আশংকা নিয়ে চিটাগং রুটে বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়ে। বাস চলে আসলে পৃথিল ভাই আর একটা মেয়ে নেমে আসলেন বাস থেকে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটা সবার সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। যা হজম করতে কিছু সময় লাগলো আমার!। বাসে উঠে পরিচয় হলাম ইফফাত আরা নার্গিস (Iffat Ara Nargis) এর সাথে। তারপর নারগিস তার টাকাগুলা আমার ধরিয়ে দিয়ে বললো আমার কাছে  রেখে দিতাম। কিছুসময় আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করে যে যার যার সীটে বসে রেস্ট করতে লাগলাম। 

এদিক দিয়ে এটাই ছিলো আমার লাইফের ফাস্ট টাইম ট্রেকিং এ যাওয়া। বলতে গেলে ট্রেকিং কি তা সম্পর্কে  আমার জ্ঞান একদম শূন্যের কোটায়!। যার ফলে মনে অনেক ভয় ভীতি কাজ করছিলো। আসলে সম্বল হলো আমার মনের জোর আর সাহস। কারণ যেখানে যাচ্ছি তখনও সেটা এই দেশের  অধিকাংশ ট্রেকারদের কাছে অজানাই বলা যেতে পারে, অথবা অন্যভাবে বলা যায়,  এই দেশের অল্প কিছু ট্রেকাররাই সাইপ্রাং দর্শন করতে পেরেছে। এ-সব কিছু ভাবতে ভাবতে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাচ্ছিলাম মনে মনে। ভাবতে ভাবতেই হটাৎ আমার ক্লান্ত শরীর ঘুমের  জগতে চলে গেলো। সুপার ভাইজারের ডকে আমার ঘুম চলে গেলো। আমরা কুমিল্লায় বিরতিতে এসে থামলাম। আমরা ৩ জন দ্রুতই বাস থেকে নেমে আসলাম। নেমেই আমরা হোটেলে চলে গেলাম, ফ্রেশ হয়ে খাবার অর্ডার করলাম। খাবার শেষ করে আমার প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে নিমিষেই আমার চোখে মুখে অন্ধকার নেমে আসে। আমার পকেটে মানিব্যাগ নাই!!, আমি তাদেরকে কিছু বুঝতে না দিয়ে দ্রুতই বাসে উঠে আমার সীটে ভালো খোঁজাখুঁজি করলাম। কোথাও মানিব্যাগ পাইলাম না!

মুহূর্তেই মানসিক ভাবে প্রচন্ডরকম হতাশ হয়ে গেলাম।  বাসের সবাইকে বললাম আমার মানিব্যাগ কেউ দেখছে কিনা?, সবাই অস্বীকার করলো। মন একদম নষ্ট হয়ে যায়। 
পৃথিল ভাই আর নারগিসকে বললাম "আমি যাবো না"। ২ জন কোন ভাবেই আমার কথা শুনতে রাজি না। তারপর চুপচাপ সীটে গিয়ে বসে পড়লাম, মনে মনে ভাবতে লাগলাম কি করে টাকা ম্যানেজ করা যায়?? হুট করেই মনে পড়ল, কয়েকজনের থেকে কিছু টাকা পাই। তাদের বলবো আমাকে এই মুহূর্তে টাকা দিয়ে উদ্ধার করতে। ফজরের নামাজ পড়ার জন্য একটা মসজিদে ব্রেক দিলে আমি নামাজ শেষ করে, আমার বড় ভাইকে কল দিয়ে বললাম, জরুরী ভিত্তিতে যেনো আমাকে কিছু টাকা দেন।ভাই একটা বিকাশ নাম্বার চাইলেন। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। বাসে উঠে তাদেরকে কল দিলাম যাদের থেকে আমি কিছু টাকা পাবো। তারা ২জন টাকা দিবে বলে রাজি হয়ে বিকাশ নাম্বার চাইলো বাস চকোরিয়া এসে থামলো। আমাদের নামার পালা। আমরা বাস থেকে নেমেই দেখি মুষলধারে বৃষ্টি। কোনমতে একটা দোকানে গিয়ে আশ্রয় নিলাম, বৃষ্টি শেষ হবার অপেক্ষায় কিন্তু এই বৃষ্টি যেনো শেষ হবার জন্য আসেনি। তা আস্তে আস্তে বেড়েই চলছে। আমার মনে ভয়ও বাড়ছে। হঠাৎ মনে প্রশ্ন আসলো আমার "কেনো  চারদিক থেকে এত বাধার সম্মুখীন হচ্ছি ?’’

কিছুক্ষণ পরে একটা রেস্টুরেন্ট খুললে আমরা দৌঁড়ে সেটাতে গেলাম, ব্যাগগুলো রেখে নাস্তা খেয়ে অপেক্ষায় থাকলাম আলীকদমের বাস কাউন্টার খোলার। সকাল ৭:৩০ মিনিট বাস কাউন্টার খুলে, আমরা টিকেট কেটে বাসে উঠে বসলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা পরে আমরা আলীকদম পৌঁছালাম। আলীকদম গিয়েই ম্যানিয়াং পাড়ার মাঝি পাপ্পুদাকে কল দিলাম, এই প্রথম আমাদের ভাগ্য যেনো আমাদের পক্ষ নিয়ে কাজ করলো!। দাদাকে দ্রুত পেয়ে গেলাম। পাপ্পুদা আসার পরে একটা বিকাশের দোকানে গিয়ে টাকা নিলাম। আমাদের টাকার প্রব্লেমও সলভ হয়ে গেলো। যথা সময়ে প্রিয় বড় ভাই আর ঐ ২ জন টাকা না দিলে হয়তো আমাদেরকে ব্যাক করতে হতো। দাদার বাজারের কাজ শেষ হলে আমরা বোটে গেলাম।
বোট চলতে লাগলো দুসরী বাজারের উদ্দেশ্যে। এটাই ছিলো আমার লাইফের প্রথম বান্দরবানের কোন জায়গা বোট জার্নি। দুই পাশের অমায়িক সৌন্দর্য যেন, মুহূর্তেই আমার হারিয়ে যাওয়া টাকার শোক, এমনকি পথের সকল কষ্ট নিমিষেই উধাও করে দিলো। পাহাড়ে ভরা বর্ষা থাকায় আমার মনে হচ্ছিলো আমি মনে হয় ঝর্ণার রাজ্যে চলে আসছি। দুই দিকের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে আমি ভাবছিলাম আমি মনে হয় অন্ধকারের বাসিন্দা, যে কিনা হঠাৎ আলোর ভূমিতে বিচরণ করতে আসলাম। প্রকৃতির অসাধারণ দৃশ্য অবলোকন করতে করতে কখন যে আমরা দুসরী বাজারে চলে আসলাম টেরই পাইলাম না। 


বাজারে নেমে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে দেখলাম এখানে অনেক মানুষের আগমন  এবং অত্যন্ত চমৎকার একটা বাজার । আমরা চা খেয়ে হাঁটা শুরু করলাম ম্যানিয়াং পাড়ার উদ্দেশ্যে। আমাদেরকে ঝিরিপথ ধরে যেতে হচ্ছিলো। পানির স্রোত অত্যন্ত বেশি হওয়াতে সামনের দিকে যাওয়াটা খুবই কষ্টকর ছিলো। যাওয়ার পথে হটাৎ করেই নারগিসের জুতা পা থেকে খুলে পানিতে ভেসে যাইতেছিলো। আমি ভালো সাঁতার জানি, তাই টিম লিডার নিষেধ করার পরেও আমি গিয়ে সেই জুতা উদ্ধার করে নিয়ে আসলাম। টিম লিডার আমার উপর বেজায় খুশি। তিনি আমার খুবই প্রশংসা কর‍তে লাগলেন। অনেক্ক্ষণ ট্রেকিং করে আমরা ম্যানিয়াং পাড়ার আসলাম, অত্যন্ত সুন্দর একটা পাড়া। এখানে একটা স্কুলও আছে। পাড়ায় এসে আমরা আমাদের ব্যাগ রেখে পাপ্পুদার পরিবারের সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিলাম। তারা তখন অধিকাংশই আমাদের বাংলা ভাষা বুঝতেন না। যারা বাংলা না বুঝতেন, তাদেরকে স্কুল শিক্ষিকা অনুদিদি বাংলা বুঝাতে সাহায্য করছিলেন। রাতে খেয়ে ঘুমাতে যাওয়ার আগে রনি নামক একজন দাদাকে, আমাদের গাইড হিসাবে ঠিক করে দিলেন। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে আমরা ঘুমাতে গেলাম।

 চলবে...

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত