১৯৫২ সালের সময়ের উপর ভিত্তি করে দুই পর্বের ধারবাহিক গল্প

সময়ের লাশ 

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১২:০৫ |  আপডেট  : ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:২০

শাশ্বত স্বপন 
------------------
 

স্বপ্নের হাত ধরে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির অন্ধকারে অনন্তের পথে ছুটে চলা স্মৃতিগুলো প্রত্যেক মানুষের জীবনে জোনাকীর মত জ্বলে আর নিভে। সময়ের লাশ--গল্পে বৃদ্ধ বয়সে নায়িকা, তার নায়কের সাথে প্রেমের কাহিনী এবং ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভুমির কিয়দংশ উত্তম পুরুষের বাচন শৈলীতে বর্ণনা করেছেন। এখানে নায়ক ৫২ সালের সময়ের ধারক, নায়িকা মাতৃভূমির ধারক অর্থাৎ গল্পটি যেন, ৫২ এর সময়ের সাথে লাজুক মাতৃভূমির ভালোবাসার লুকোচুরি-মিছিল-আন্দোলন-যুদ্ধ-মৃত্যুর খেলা।

পর্ব-১
 
দরজার বাইরে বাবার হাসির শব্দ শোনা গেল। বাবার সাথে আর একজনের হাসিও শুনতে পেলাম। আমি রাম প্রসাদের মাথায় জল ঢালতে ঢালতে রামকে জিজ্ঞাসা করলাম--রাম, আরো জল ঢালব| --না, শব্দটি বলেই দৌঁড়ে দরজা খুলতে গেল। আনন্দে নেচে নেচে বলতে লাগল,  বাবা আসছে, বাবা আসছে।আমি প্রায় অপ্রস্তুত ছিলাম। রামকে ডেকেও আর থামানো গেল না। জল বেয়ে পড়ছে সারা শরীরে। জ্বর অথচ দুষ্টামীর শেষ নেই। রাম দরজা খুলে দিল। আমি তো হতভম্ব! কারণ বাবা প্রায়ই দুপুরবেলা একজন অতিথি নিয়ে আসেন। ঘরের ভিতরে আমি না যেতেই রাম দরজা খুলে দিল। তখন আমার শরীরে ছিল পাতলা ধুতি--যা জড়িয়ে কোন রকমে লজ্জা নিবারণ করেছি। রামকে মাথায় জল দেবার আগে দুপুরে প্রতিদিনের মত লক্ষ্মী দেবীর পূজাটুকু মাত্র সেরেছি। পূজা শেষ হতেই মা ডেকে বলল--হাত ব্যথা হয়ে গেছে কল্যাণী, এবার তুই ওর মাথায় আর কতক্ষণ জল দে--। সব জামা-কাপড় ছিল অশুদ্ধ। আলমারীতে শুদ্ধ কাপড় থাকলেও মার ধমকে বের করতে পারিনি। তাই ধুতি পড়েই পূজা দিলাম। ধুতি না ছাড়তেই মার ডাকে রামের মাথায় জল দিতে লাগলাম। ভালই লাগে ধুতি পড়তে; কোন রকমে লজ্জা নিবারণ মাত্র। কিন্তু আমার মনে হয়, আমি যেন নগ্ন হয়ে আছি। বারবার কাঁধের আঁচলটা মাটিতে পড়ে যায়। রাম দরজা খুলতেই দেখি, বাবার আগে একটি ছেলে ঘরে ঢুকেছে। আমি লজ্জায় ড্রয়িং রুম লাগোয়া ছোট ঠাকুর ঘরে ঢুকে পড়েছি। একটু পরে বাবা ঘরের ভিতরে ঢুকেই মাকে ডাকতে ডাকতে ভিতরে চলে গেলেন। রামকে কোলে নিয়ে বাবা মাকে বলছে, একি অবস্থা লক্ষ্মী! ওর মাথাটা মুছে দাওনি? মা বলছে, কল্যাণীতো মাথায় জল দিয়েছে, মেয়েটা মুছেও দেয়নি?’ বোধহয়, মা আঁচল দিয়ে মুছে দিচ্ছে।

এদিকে ছেলেটি ঠাকুর ঘরে ঢুকে প্রণাম করল। পরিধানের কারণে লজ্জায় কিছু বলতেও পারছি না। ছেলেটা বলতে লাগল, মা দেবী, তোমার পূজা যদি স্বল্প পোশাকেই করতে হয়, তবে পোশাক না পরলে হয় না? এরপর আমার দেহের বর্ণনা দিতে দিতে যা বলেছে--তা আর বলার মত না। একটু পরে সরস্বতী দেবী মূতির্র দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল--সরস্বতী মহাভাগে--বিদ্যে কমললোচনে--বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি--বিদ্যাংদেহী নমস্তোতে--। আহা! দেবী, এই মন্ত্র পাঠ করিলে যদি তুমি বিদ্যাই দিতা, তবে এই কিশোরী আর যাই হোক ধর্মে আর অংকে ফেল মারিত না। বুঝতে আর বাকী রইল না, ছেলেটা আমাকে দেখেছে । ঠাকুর ঘরের দরজার কোনায় রোদে শুকানো মায়ের শাড়ী টেনে দিয়ে নিজেকে পর্দার আড়াল করেছি। হঠাৎ করেই সে শাড়ী টান দিয়ে ফেলে দিল। অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে চেয়ে রইল আমার চোখ আর মুখের দিকে। আমি এমন হতভম্ব হয়েছি যে, কাঁধের উপর ধুতির অংশটুকু কখন যে পড়ে গেছে আমার পায়ের কাছে, টেরও পাইনি। নবম শ্রেণীর ছাত্রীর বুকের আকাশটা কি রকম আকর্ষণীয় হতে পারে--সে অভিজ্ঞতার দৃশ্য তখন বুঝিনি। আজ নাতনীর বুক দেখে সে দিনকার কথা মনে পড়ে। আমার মনে পড়ে, ছেলেটা শুধু তাকিয়ে ছিল; হাত দিয়ে কোথাও ছুঁয়ে দেখেনি। শুধু বলেছে, ‘তুমি এত সুন্দর! ইচ্ছে করে রক্ত দিয়ে তোমাকে সাজাই--দেখি, আরো কত সুন্দর দেখায়।’ কি আশ্চর্য! যে বটি দা দিয়ে পূজার ফল কেঁটেছিলাম, সে দা দিয়ে সে তার আঙ্গুল কাঁটা শুরু করতেই হঠাৎ বাবার কণ্ঠস্বরে সে দৌঁড়ে চলে যায়। সে যাত্রা আমার জীবনের...। ছেলেটা বাবার সাথে আবার বাইরে চলে গেল। অবাক হলাম, কি করে জানল, আমি অংকে আর ধর্মে ফেল করেছি। নিশ্চয়, বাবা বলেছে।

এই সেই ছেলে--এই সেই যুবক--এই সেই শহীদ, সুমাদ জাকারিয়া। দাদুর কাছে পড়তে গেলে ওকে প্রতিদিন পলাশ গাছের গোড়ায় বসতে দেখি। প্রায়ই দেখতাম, মায়াময় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। বিগত ষাট বছরে স্বামী তথা সকলের ভয়ে, লোক লজ্জায় এ লেখা প্রকাশ করতে পারিনি। জীবনের গভীর মায়াময় স্মৃতিটা আজো বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছি। ছেলেরা বড় হল, বিয়ে করল, মেয়েদের বিয়ে দিলাম। আজ নিঃসঙ্গ চিত্তে নাতী-নাতনীদের ভিড়ে খুঁজে বেড়াই সুমাদকে। প্রতিবছর খুঁজি বই মেলায়--শহীদ মিনারে--পথে পথে; কোথাও ওকে খুঁজে পাইনি; পাইনি ওকে নিয়ে লেখা কোন গদ্য বা পদ্য। জানিনা, এ লেখা প্রকাশ হবার পর ছেলে-মেয়েরা কি ভাববে। আমি বলব, সবাই আমরা মানুষ। সবারই জীবনে ঘটনা আছে, স্মৃতি আছে। কারোটা গভীর ক্ষত হয়ে আছে, কারোটা ভাসা-ভাসা। আগে একুশের মাঝে ওকে খুঁজে পেতাম; এখন কেমন যেন, ঝাপসা দেখায়। বয়সের ভার বোধহয়, এ নশ্বরদেহ আর বইতে পারছে না।

স্বামীর মৃত্যুর পর কি যেন, হারালাম। আমি শুধু স্বামীই নয়, সুমাদের স্মৃতিও যেন, হারাতে লাগলাম। নিজেকে বড় শূন্য লাগে। বাড়ীতে অনেক লোক থাকা সত্ত্বেও মনে হয়, কেউ নাই। এরকম মনে হয়েছিল সুমাদের মৃত্যুর কয়েক মাস আর বিয়ের পর বিমল বোম্বে চলে গেলে। শূন্যতা যে কি অসহায় অবস্থা--তা আমার মত বৃদ্ধরাই জানে। সময়ের কাছে জীবনের পরাজয় মেনে নিলেও সময়ের সাথে সুমাদের স্মৃতি বিস্মৃত হবে, এ আমি মেনে নিতে পারি না; আর পারি না বলেই, গদ্যের এই স্মৃতিগত ক্ষুদ্র প্রয়াস।

দাদুর কাছে পড়তে গেলে আগে দু’একদিন বন্ধ দিতাম। এখন পারলে দিনে দু’বার যাই। কারণ যখনই পড়তে যাই, তখনই ওকে দেখি। হয়, মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছে; নয়তো, অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। দু’মাস বয়ে গেছে শুধু দেখা-দেখি। আমাদের বাসা থেকে খানিক দূরে দাদুর বাসা। দাদু, দীননাথ চক্রবর্তী আমার বাবারও শিক্ষক, তাই মায়ের কথামত দাদু বলি। আজ মা দাদুর জন্য পিঠা দিয়েছে। আমি পিঠা নিয়ে যাচ্ছি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বুকটা কেঁপে উঠল। যাকে দূর থেকে আড়চোখে দেখতাম, সে আজ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কি করছে? ভয়ে ভয়ে এগোতে লাগলাম। দেখি, একটা কাগজ ইট দ্বারা চাপা দিয়ে ও সরে গেল। বুঝতে আমার বাকী রইল না। হেঁটে সোজা দাদুর বাসায় চলে গেলাম। চিঠির দিকে ভ্রুক্ষেপও নেই আমার। পরের দিনও দেখি চিঠি একই অবস্থায় ইটে চাপা পড়ে আছে। কিছুক্ষণ কাগজটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ কি যেন অনুভূতি জাগল মনে। ভয়ে ভয়ে কাগজটি উঠায়ে চারদিকে তাকালাম। না, কোথাও কেউ নেই। বেশ পাকা হাতে বুকের ভিতর কাগজটা লুকিয়ে রাখলাম। যেন, কেউ না দেখে। 

রাত তখন বারোটা। রাম আমার পাশে শুয়ে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ। কেউ জেগে নেই। ভয়ে ভয়ে বুকের ভিতর থেকে কাগজটি বের করলাম। খুলতে দারুন ভয় করছে, হাত কাঁপছে। সবুজ জমিনের উপর লাল বৃত্তের একটি কাগজ সুন্দর করে ভাঁজ করা। পুরো কাগজটা খুলতেই আরো দু’টি কাগজ বের হয়ে এল। একটা কাগজের ভিতর ওর নিজের আঁকা ছবি। কি সুন্দর হাসছে! আর একটা কাগজে আঁকা একটা মানচিত্র, পূর্ব বাংলার। আরেকটা কাগজে ছোট ছোট করে লেখা। কিন্তু হায়! সব উল্টা করে লেখা। একেবারে উপরে লেখা--take a mirror and...|। আমি আমার পড়ার টেবিল থেকে আয়না আনলাম। বুঝলাম, ও আমাকে কষ্ট দিতে চায়। ও চায়, ওকে নিয়ে আমি ভাবি। আমি আয়নার সাহায্যে পড়তে শুরু করলাম--‘রূপশ্রী, তোমাকে প্রথম থেকেই আমি চিনেছি। আমি কে? তুমি আমাকে চিনবে না। আমাকে চিনতে তোমার অনেক সময় লাগবে। আমি মহাকাশের কোন এক বিদ্রোহী উল্কাপিন্ড। না, এ পৃথিবীরই শুধু আমি বাসিন্দা নই, আমি মহাবিশ্বের। পৃথিবীর মত আরো পৃথিবী আছে, এ মহাবিশ্বে--যেখানে সংঘাত, বিশৃংখলা, দূর্নীতি, জালিয়াতি, অত্যাচারের ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়, সেখানকার অধিবাসী হয়ে জন্ম নিই আমি বারে বারে। তোমাদের এ ভারতবর্ষে আমাকে অনেক বার জন্ম নিতে হয়েছে। ভয় পাচ্ছ? ভয় নেই, তোমাকে মুক্ত করতেই এ মর্ত্যে আমার জন্ম। তোমাকে স্বাধীনতা দেব। তোমার বুকে একটা মানচিত্র আঁকব আর রক্ত দিয়ে মেখে মানচিত্রের পাকা দলিল তোমার হাতে দিয়ে যাব। তুমি সুন্দর। তুমি বাংলার মানে পূর্ববাংলার এক বিমূর্ত প্রতীক। পাগল ভাবছ? সব নারীরা পুরুষদের একটু পাগল ভাবে কারণ নারীরা পুরুষ জাতিকে গর্ভে ধারণ করে এবং তাদের স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দেয়, ফলে পাগল সম্বোধনটা আদর অথবা ভালোবাসার কারণে চলে আসে। কিন্তু তাই বলে তুমি আমার মা, বোন কিবা প্রেমিকা না। তোমাদের কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজে যাদের তোমরা পিসি, মাসী, কাকা, মামা ইত্যাদি ডাক--আমি সে দলের কেউ নই। আমি অন্য রকম আত্মীয়; এ আত্মীয়ের স্বরূপ মধুসূদন, বঙ্কিম কিবা রবীন্দ্র--কেউ বর্ণনা দিয়ে যায়নি। রহস্য লাগছে, থাক পড়তে হবে না আর। কোথাও লুকিয়ে রাখ অথবা ছিঁড়ে ফেল, তারপর ঘুমিয়ে পড়। আমি গভীর রাতে সব বুঝিয়ে দেব। আমাকে বুকে রেখ না, তাহলে হৃদয়ে চলে যাব।’ ইস্! এত সহজ, দুষ্টু, এতক্ষণতো বুকেই ছিলে। যাও বুকেই থাক; হৃদয়ে যাওতো দেখি। 

বালিশে মাথা রেখে চিন্তা করতে লাগলাম। চিন্তার ঘোরে একসময় ঘুমিয়ে গেলাম। হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। সারা দেশ কাঁদছে আমার জন্য। কিন্তু এখানে কারা হাসছে? ওদের হাতে লাঠি, পিস্তল, বোমা, বন্ধুক কেন? আমার হাত যুদ্ধ বিমান হচ্ছে, পা ছুটে চলেছে ট্রেনের গতিতে, মুখ চিৎকার করছে--কেউ শুনছে না। আমার একটা কলঙ্ক আছে। একদল পাখি আমাকে শুনিয়ে দিয়ে গেল। কি সেই কলঙ্ক! আমার হৃদয় সমস্ত দেহের ভালোবাসা চায় অথচ অঙ্গ-পতঙ্গ আমাকে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে কেন? আমার বুকে প্রবাহিত নদীগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। মাথার উপরে পাখিরা কাঁদছে। কাঁদছে আমার হৃদয়। হঠাৎ কোন এক অপরিচিত মহিলা--নিজেকে কবি পরিচয় দিচ্ছে, অনেকটা আমার মত দেখতে। তার লেখা ‘না গদ্য না পদ্য’ আমাকে শুনাচ্ছে--‘একটি মরুভূমি ভালবাসার প্রত্যাশায় যেমন সুদীর্ঘকাল অপেক্ষা করে সাগরের ছোঁয়া পেতে। সময়ের রুদ্র প্রখরে তীব্র তাপে তার হৃদয় যখন গলতে শুরু করে শ্মশানের জ্বলন্ত লাশের মত; তখন সে পাগলিনীর মত ডাকে--সাগর, সাগর--। কেউ তার ডাক শুনে না। শুনতে পায় না কোন মরুযাত্রী। সে ডাক বাজপাখী কিবা বাদুর পাখির ডাকের মত--যে ডাক বারবার প্রতিফলিত হয় খেঁজুর গাছের মাথা থেকে--সে ডাক আকাশকে কম্পিত করে--আকাশের বুকে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়কে ভীতি সঞ্চার করে জাগায়ে তোলে। সময়ের তীব্র ক্রোপানলে, আগুনের মতো জ্বালাময় কষ্টে মরুভূমির বুক খসে খসে ধূলো হয়ে যায়। ধূলো উড়ে যায় আকাশের বুকে, পাহাড়ের শিখরদেশে, বাতাসের নাসারন্ধ্রে, কালো মেঘ কন্যার কাছে। ধূলো-বাতাস পৌঁছে দেয়, মরুদুলালী হতভাগিনীর ব্যর্থ ভালবাসার শ্মশান জ্বালার করুণ হৃদয়স্পর্শী চিত্র; পৌঁছে দেয়, নির্মম বেদনার লেলিহান প্রখর দৃষ্টির ছোবল কাহিনী। আকাশ-বাতাস সবাই শুনে--সবাই দেখে--তারপর বিরহ বেদনায় খানিকক্ষণ আফসোস করে। বেদনা বেদনাই রয়ে যায়। কেউ তাকে ভালবাসে না। তার জ্বালা, তার বেদনা তার নক্ষত্রসমদূর কষ্ট ক্রমোত্তর বাড়তে থাকে। তবুও এক টুকরো জোনাকী আলোর মত ভালবাসা কারো কাছে প্রত্যাশা করেও আশাহত হয় বারবার।

সাগর-নদ-নদী-শাখা নদী সবার কাছে সে ভালবাসা চায়, এক টুকরো লাল ফিতা কিবা এক টুকরো ওড়নার মত ভালোবাসা কিন্তু তার কলঙ্ক জীবন যাকে ছুঁতে চায়, সেই তার মতো মরুময় হয়ে যায়। নদীর বুকে জেগে উঠে চর। তার কলঙ্ক ছোঁয়ায় জেগে উঠে সাগরের বুকে দ্বীপ। তাহলে কোন শতাব্দিতে, কোন সত্য যুগে সে ভালবাসা পেয়েছিল। আবার কত সহস্র কলিযুগ পরে সত্যযুগ আসবে--সে ভালবাসা পাবে। যখন সাগর তাকে বুকে আঁকড়ে ধরবে। সে তখন হবে সাগরিকা কিংবা সাগর কন্যা। তখন নদী, গাছপালা, পথ-প্রান্তর, পশুপাখী সবাই তাকে মুঠি মুঠি ভালোবাসা দেবে। তার বুকের স্রোতে ভাসবে জাহাজ, পাল তোলা নৌকা। তার পায়ে বাজবে ঘুঙ্গুর। তার হৃদয় কণ্ঠ থেকে শিবের শঙ্খ বাজবে। তখন তার প্রেমের গভীরতা সবাই বুঝবে; তার সুদীর্ঘ পরাধীনতার কলঙ্ক চিরতরে দূর হবে।’ কাঁধের পাটের ব্যাগ আমার বিছানায় রেখে মহিলা কবি কি যে বুঝাল--তার কিছুই বুঝলাম না। তবে উক্তিগুলি কেমন যেন রহস্য সৃষ্টি করল। বড় জটিল এর অর্থ কিন্তু শেষ উক্তিটির ‘পরাধীনতা’--শব্দটি আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে চোখ চুলকাতে গিয়ে দেখি আঙ্গুল জলবিন্দুতে ভিজে গেল। আশ্চর্য! চোখে জল কেন! তাহলে এ গদ্যের অর্থ আর যাই হোক, সম্পূর্ণটা বুঝলে যে চোখে ঝর্ণা ঝরবে--এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল--একটি মানুষ। সে প্রতিনিয়ত--সেই কবি হচ্ছে--আবার সুমাদ জাকারিয়া হচ্ছে--কখনো অবিকল আমারি মতো কিশোরী হচ্ছে। ক্রমাগত এই তিন রূপে একটি মানুষ পরিবর্তন হচ্ছে। সুমাদ একজন নেতা, সে আমাকে রক্ষা করার জন্য দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আশ্চর্য! দলে এখন কবি, সুমাদ আরো অনেকে। আর আমি পরাধীনতার শিকলে বন্ধি। কত মিটিং, কত মিছিল, কত রক্ত বয়ে যাচ্ছে আমার জন্য। হঠাৎ গুলিবর্ষণ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ শুরু হয়ে গেল। দলের সবাই মরে যাচ্ছে। সুমাদের বুকে গুলি ...। না--, বলে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। মা-বাবা দু’জনে দৌঁড়ে এল। ভাগ্যিস, চিঠিটা রামের পিঠের নীচে চাপা পড়ে ছিল; তা না হলে, মা কি যে ভাবত! মা লবণ জল নিয়ে এল, আমাকে পান করাল। তারপর মা-বাবার কাছে সব বললাম। মা বলল, ‘তোমাকে কতবার বলছি, ভাল একটা ছেলে দেখ, মেয়ের বিয়ে দেই। না, মেয়েকে পড়াবে, পড়াও। মেয়েটি এত বড় হল। এখনো একা একা...।’
                                                                                                                                       (চলবে)


 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত