সময়ের বিবর্তনে পাল্টেছে বাংলা সিনেমার নাম, বদলেছে দর্শকের রুচি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩ মে ২০২৫, ১০:৪৯ |  আপডেট  : ৪ মে ২০২৫, ১২:৫৬

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে সিনেমার নাম বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সিনেমার নাম শুধু একটি পরিচয় নয়, বরং গল্পের আবহ, দর্শকের প্রত্যাশা এবং সময়ের ভাষাও প্রকাশ করে। প্রথমদিকের বাংলা সিনেমার নামগুলো ছিল আবেগঘন,সাবলীল এবং সাহিত্যিক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বদলেছে দর্শকের চাহিদা, সমাজের ভাষা এবং সিনেমার গল্প বলার ধরণ। সেই বদলের ছাপ স্পষ্টভাবে পড়েছে সিনেমার নামেও।

১৯৫৬ সালে আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত ‘মুখ ও মুখোশ’ দিয়ে যে বাংলা সিনেমার যাত্রা শুরু হয়, তার নামই ছিল প্রতীকের মতো — মুখের আড়ালে মুখোশ, সমাজের অন্তর্নিহিত অসংগতি। এরপরের দশকগুলোতে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, ‘আশার আলো’-র মতো নামগুলো সাহিত্য, জীবনঘনিষ্ঠতা এবং আবেগঘন বাস্তবতাকে সামনে এনেছিল। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সিনেমার নামগুলোতে এক ধরনের জাতীয়তাবাদী আবেগ দেখা যায়। ‘ওরা ১১ জন’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘রক্তাক্ত বাংলা’র মতো নামগুলো ছিল সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের প্রতীক। এসব নাম গল্পের আবহ ও দর্শক আবেগের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল।

অন্যদিকে, নব্বইয়ের দশকে ঢালিউডের কমার্শিয়াল ঢেউয়ের সময় সিনেমার নামেও পরিবর্তন আসে। ‘কুলি’, ‘ভণ্ড’, ‘’-এর মতো নামগুলো সরাসরি অ্যাকশনধর্মী ইঙ্গিত দেয়। ২০০০ সালের পর থেকে এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট হয়। ‘কঠিন বাস্তব’, ‘পিতার আসন’, ‘চাচ্চু’র মতো নামগুলো পারিবারিক আবেগ বা সামাজিক বাস্তবতাকে সামনে রাখে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সামাজিক ও দর্শক পরিবর্তনের ফলে সিনেমার নাম আরও ছোট ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। ২০২৫ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোর নাম দেখলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে- য়েমন- ‘বরবাদ’, ‘দাগি’, ‘জংলি’, ‘জ্বীন-৩’, ‘চক্কর ৩০২’, ‘অন্তরাত্মা’। এসব নাম এখনকার সময়ের ভাষা, দর্শকদের আকর্ষণের ধরন এবং দ্রুত মনোযোগ কাড়ার কৌশলকে সামনে নিয়ে এসেছে। সিনেমার নাম এখন শুধু গল্পের প্রতিনিধিত্ব করে না, বরং মার্কেটিংয়েরও বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

বাংলা চলচ্চিত্রের নাম পরিবর্তনের এই ধারা নিয়ে চ্যানেল 24 অনলাইনের সঙ্গে কথা হয় দেশের গুণী নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে তার ভাবনা জানতে চাইলে এই নির্মাতা বলেন, ‘সিনেমার নাম  নির্ধারণ করা হয় ধরণ অনুযায়ী। এখন সারা বিশ্বেই ভায়োলেন্স ও অ্যাকশন ধাঁচের সিনেমাগুলোর প্রতি দর্শকের আগ্রহ রয়েছে। সে ধারা আমাদের দেশের সিনেমাগুলোতে দেখতে পাচ্ছি। আর সে কারণেই সিনেমার নামগুলো এমন হচ্ছে। পাশাপাশি সিনেমার পোস্টারেও এখন ভায়োলেন্স দেখা যাচ্ছে। সিনেমার চরিত্র অনুযায়ী নাম নির্ধারণ করা হয়। যেমন ‘পথের পাঁচালী’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ কিংবা ‘অবুঝ মন’ এই নামগুলো সিনেমার চরিত্র বহন করে বলেই কিন্তু এমন নাম দেয়া হয়েছিল। একইভাবে এখন আমাদের দেশে ভায়োলেন্সের সিনেমা বেশি হচ্ছে বলেই নামে সেরকম একটা ভাব রাখা হয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আগে আমরা দেখেছি নায়ক মার খেতেন। এমনকি অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় নায়ককে অনেক অত্যাচার করা হতো। আর এখন দেখা যায় নায়ক এবং ভিলেন দুই ভূমিকাতেই হিরো। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হবেই। এখন আমরা যেটা দেখছি এটা আসলে সময়ের পরিবর্তনেই হচ্ছে।’

অন্যদিকে দেশের জনপ্রিয় চিত্রনাট্যকার নাজিম উদ দৌলার সঙ্গেও সিনেমার নাম পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে কথা হয়। ‘শান’ ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ‘দামাল’, এবং ‘সুড়ঙ্গ’-এর মতো বেশ কিছু আলোচিত সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন তিনি।  সিনেমার নাম প্রসঙ্গে কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সহজভাবে বলা যায় এখন আমরা বিভিন্ন আক্রমণাত্মক নামের সিনেমা দেখছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই নামগুলোর পক্ষে না। আমি সম্প্রতি সময়ে যে সিনেমাগুলো করেছি তার মধ্যে ‘দামাল’, এবং ‘সুড়ঙ্গ’-এ বিষয়ভিত্তিক নাম ছিল। এই সিনেমার নামগুলো গল্পের মূল বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে দেয়া হয়েছিল। অন্যদিকে সামনে ‘নীলচক্র’, ‘ইনসাফ’ মুক্তি পাবে। এই সিনেমাগুলো কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের। আর এগুলোর নাম সুন্দর বাংলা শব্দ।’

তিনি আরও বলেন, ‘নির্মাতা-প্রযোজকদের বিষয়টাও আমরা চিত্রনাট্যকাররা বুঝি। তারা মনে করেন দর্শক অ্যাকশন সিনেমা পছন্দ করে। কমার্শিয়াল সিনেমা মানেই অ্যাকশন থাকে। আর সিনেমার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন নাম দেয়া হয় যেটা শুনলেই দর্শক অ্যাকশনের ইঙ্গিত বুঝতে পারেন। কমার্শিয়াল সিনেমার ক্ষেত্রে অ্যাকশন এবং ভায়োলেন্স উপস্থাপন করা স্বাভাবিক বিষয়। নামের মাধ্যমে দর্শকে অ্যাকশন সিন রয়েছে এই বার্তা দেয়া হয়।’

কমার্শিয়াল সিনেমার ঢেউয়ে বলিউড হলিউডে অ্যাকশন ধাঁচের সিনেমার প্রচলন বহু বছর ধরেই। আমাদের দেশের সিনেমাতে এখন অ্যাকশন অন্যতম উপাদানে পরিণত হয়েছে। আর এই ধারা লক্ষ করা যায় আমাদের দেশের সিনেমার নামের ক্ষেত্রেও। এই পরিবর্তনকে নির্মাতা এবং চিত্রনাট্যকারা কিছুটা সময়ের প্রতিফলন এবং কিছুটা প্রযোজক ও নির্মাতার চিন্তার প্রতিফলন বলছেন। সিনেমার নাম পরিবর্তনের এই ধারা নিয়ে চ্যানেল 24 অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ মো. নিসতার জাহান কবীর।  

সিনেমার নাম পরিবর্তনের এই ধারা নিয়ে চ্যানেল 24 অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ মো. নিসতার জাহান কবীর। 
সিনেমার নাম পরিবর্তনের এই ধারা নিয়ে চ্যানেল 24 অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ মো. নিসতার জাহান কবীর। 

সিনেমার নাম পরিবর্তনের ধারা বদল নিয়ে ড. শাহ মো. নিসতার জাহান কবীর বলেন, ‘মানুষ সামাজিক জীব, সে সমাজে যেটা দেখে এবং সমাজ নিয়ে যে চিন্তা করে তার প্রতিফলন কাজে উঠে আসে। যেমন দীর্ঘক্ষণ রাস্তার যানজটে থাকলে আপনার মেজাজ বিগড়ে যাবে। আপনি তখন হয়তো রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করবেন কিংবা বাসায় গিয়ে পার্টনারের সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে ঝামেলা করবেন। রাজনীতি কিংবা সামাজিক প্রেক্ষাপট বহু বছর ধরেই আমাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রকাশ করার অভ্যাস রয়েছে। তাই মানুষ সবসময় তার ক্ষমতা প্রকাশ করতে চায়। সে কারণে একটা  বিষয় নিয়ে বিরক্ত থাকলে সে অন্য একটি কাজে সেটা প্রকাশ করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একজন মানুষ তার ক্ষমতা প্রকাশ করতে গিয়ে তার মনে এই বিষয়টা স্থায়ী হয়ে যায়। সে কারণে দেখা যায়, ফেসবুক, সাহিত্য কিংবা নতুন প্রজন্মের মাঝে নিজেকে জাহির করার বিষয়টা রয়ে গেছে। সমাজে এখন নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করাই মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি ছাত্র থাকা অবস্থায় দেখেছি শিক্ষকদের নিজেদের গাড়ি থাকলেও সেটা তারা প্রকাশ করতেন না। তবে এখন চিত্র ভিন্ন। এখন নিজেকে শো করতেই আমরা ব্যস্ত। ফেসবুকে আমরা প্রতিনিয়ত এমন পোস্ট করি। মূলত নিজের পাওয়ার কিংবা ক্ষমতা দেখানোর জন্য এমন করা হয়।’

সিনেমার প্রসঙ্গ টেনে ড. শাহ মো. নিসতার জাহান কবীর বলেন, ‘ক্ষমতার প্রকাশের বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রকাশ পায় বিভিন্ন জায়গায়, যার মধ্যে অন্যতম সিনেমা। আর এটা করতে গিয়েই সিনেমার নাম ‘তুফান’, ‘বরবাদ’, ‘দাগী’ কিংবা ‘তাণ্ডব’ হয়ে যাচ্ছে। যদিও ‘তুফান’ নামের সিনেমা আগেও হয়েছিল। অন্যদিকে, রোমান্টিক সিনেমার ক্ষেত্রেও আমরা আক্রমণাত্মক নাম দেখতে পাই। অথচ এই সিনেমাগুলোর অন্যরকম নাম হতে পারতো। মূলত দর্শক টানতে গিয়েই নামগুলো এমন হয়ে যাচ্ছে। দর্শক সমাজেই অংশ, সেও তো সমাজের চিত্র দেখতে চায়। আর কারণেই চলচ্চিত্র নির্মাতা ভেবে নেন সিনেমায় আক্রমণাত্মক বিষয় দেখানো গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্মাতা যে টার্গেট অডিয়েন্সের জন্য সিনেমা নির্মাণ করেন তিনি ধরেই নেন দর্শক এই নামগুলো পছন্দ করবে। আসলে কিন্তু দর্শক টানতে নাম এভাবে দেয়া মূল বিষয় হওয়া উচিত না। শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে সিনেমার নাম দেয়া উচিত।’

সব শেষে এটা বলা যায়, বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রসার, তরুণ দর্শকদের মনস্তত্ত্ব, এবং আন্তর্জাতিক সিনেমার ট্রেন্ডের প্রভাব রয়েছে এই পরিবর্তনের পেছনে। আগামী দিনে বাংলা সিনেমার নাম আরও কীভাবে বিবর্তিত হয়, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে একথা নিশ্চিত — সময় বদলেছে, গল্প বলার ধরন বদলেছে, আর তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে সিনেমার নামেও। তবে শিল্পের মানের দিক বিবেচনা করে সিনেমার নাম নির্ধারণ করা যেতে পারে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত