সম্প্রীতি

  বিপুল কৃষ্ণ দাস

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২১, ০৯:৪৭ |  আপডেট  : ১ মে ২০২৪, ১৯:২০

সংখ্যাগরিষ্ঠ কাকের দেশে কোকিলেরা বরাবরই সংখ্যালঘু। টিয়ে পাখিরা ঝাঁক ধরে আসে, কোলাহল করে, আম খায় পেয়ারা খায়, আবার চলে যায়। 

বাবুই তাল গাছে খেজুর গাছে বাসা বাঁধে, নিজেদের মত থাকে, নিজের জগতে। তার অপূর্ব শিল্পভাবনা আর নির্মাণ দেখে হিংসায় জ্বলে কাক। 

আর চির শত্রু কোকিলকে তো একদমই সহ্য করতে পারে না। তাই ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে কাক একদিন প্রকাশ্যে জনসভা করে মাইকে ঘোষনা দেয়, "কোকিলের গান শোনা মহাপাপ। যারা কোকিলের গান শুনবে, তারা নরকের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।"

কাকেরা কাক-ধর্মের দোহায় দিয়ে ইতিমধ্যে নিজেদের পক্ষে অনেকগুলি আইন পাশ করিয়ে নিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে। কাকদের হাইকমান্ডের গোপন বৈঠক চলে নিচ্ছিদ্র গোপনীয়তায়। সেখানে সব পাখিদের নিয়েই আলোচনা হয়। 

কাক সম্রাট বলেন, " দেখেছিস কী দুঃসাহস টিয়ে পাখিদের, প্রাসাদে কেল্লায় লোকালয়ে ঢুকে কেমন দল দেঁধে কী অনন্দ উচ্ছ্বাস কোলাহল করে বেড়ায়! লাল টুকটুকে ঠোঁট, কচি ঘাসের মত চকচকে সবুজ গায়ের রঙ। সবাই কেমন মুগ্ধ হয়ে ওদের দেখে, আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না।"

কাক মন্ত্রি বলে, " একদম ঠিক কথা বলেছেন জাঁহাপনা। ইষ্টিকুটুমও কিছু কম যায় না। আর বাংলা মুলুকে ময়ুর নেই ভাগ্যিস, থাকলে আমাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকাতো না।"

উজির কাক বলে, " বাবুই পাখিকে তো মানুষ শ্রেষ্ঠ শিল্পীর শিরোপা দিয়েছে, তাদের নিয়ে কত কবিতা লেখে। একটা ছোট্ট পাখির নামে কী প্রশংসা, তাদের গুনের কত কদর করে লোকে। আর ওই ক্ষুদ্র নাটা টুনটুনি পাখিটা পর্যন্ত বয়ন শিল্পের অংশীদার। কিন্তু হুজুর একবার ভেবে দেখুন, আমাদের কাকদের বাসার অবস্থা। সেখানে যত রাজ্যের নাট বল্টু, জংপরা তার, ভাঙ্গা চশমার ফ্রেম পর্যন্ত ঢুকে পরে।"

রাজ্যের কোতোয়াল কাক চোখ মুখ বিকৃত ভঙ্গীতে রগড় করে বলে, " আহ্ কোকিল, কী মধুর সংগীত তোমার! আমার তো শুনে গা জ্বলে যায়। যতসব ন্যাকামি মনুষ্যকুলের। কিন্তু জাঁহাপনা, এটাও তো সত্য যে, আমাদের কাকদের কর্কশ গলা শুনে লোকে লাঠি নিয়ে তাড়া করে আসে।"

কাক সম্রাট হুংকার দিয়ে বলেন, " এত বড় স্পর্ধা, কালই ডাকো সব পাখিদের। বুলবুলি দোয়েল কোকিল শ্যামা শালিক চড়াই ঘুঘু পায়রা টুনটুনি পানকৌড়ি ইষ্টিকুটুম, বক মুনিরা কেউ যেন বাদ না পরে।"

কাক সম্রাটের কথা শুনে এক বৃদ্ধ উপদেষ্টা কাক উঠে দাঁড়ায়। কাক সম্রাট বলেন, " বলুন, বলুন আপনার মূল্যবান মতামত। অভিজ্ঞতার একটা মূল্য আছ। এটা আমি স্বীকার করি। বলুন, কীভাবে শায়েস্তা করা যায় পাখিদের।"

বৃদ্ধ কাক হাতজোড় করে বললেন, " জাঁহাপনা, অসহিষ্ণুতা ঈর্ষাকাতরতা আর হীনমন্যতা পরিত্যাগ করা  কর্তব্য। দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে দরকার দেশপ্রেম ও সমগ্র পাখিদের প্রতি ভালবাসা। সব পাখিদের জন্য সমান আইন, আর সকলের অধিকার ও কর্তব্য সমান ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।"

শুনে কাক সম্রাট ও সভাসদ তো রেগে আগুন। চারিদিকে ফিসফাস আওয়াজ শুনা যায়, এই নচ্ছার বুড়োর নাকি ভীমরতি হয়েছে। কাক সম্রাট কঠোর স্বরে বলেন, "বটে!"

বৃদ্ধ কাক অত্যন্ত বিনীত অথচ স্পষ্ট ও দৃঢ় ভাষায় তার বিশ্বাসের কথা বলে যান, " আজ্ঞে সেটাই যথার্থ কাজ জাঁহাপনা। সম্প্রীতি শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আমাদের হিংসা ত্যাগ করতে হবে। 

একবার ভেবে দেখুন হুজুর, আমরা পাখিরা বংশ পম্পরায় মিলেমিশে আছি সৃষ্টির আদিকাল থেকে। সব পাখিদের তাড়িয়ে রাজ্য ছাড়া করে, অথবা নির্মূল করে কাক রাজ্য প্রতিষ্ঠায় বৈচিত্র কোথায়, সুখ কোথায়? বহু ধর্ম, বহু মত, বহু ভাষা-- নানা রঙের, নানা বর্ণের পাখি না থাকলে যে বহুত্ববাদে মহিমা বুঝা যায় না। এই ধরুন, আমাদের রাজ্যে কত রকমের গাছ গাছলা, বৃক্ষ লতা, কত রকমের মনোমুগ্ধকর ফুল। কী অপূর্ব নানাবিধ গন্ধে ভরপুর। এমন সব অফুরাণ বৈচিত্রকে নির্মূল করে যদি শুধু মাত্র একটি জাতের গাছকেই বাঁচিয়ে রাখেন, তাহলে সেই সৌন্দর্য কোথায়? তাই দয়া করে আপনার এই সহিংস ভাবনা থেকে বিরত থাকুন।"

বুড়ো কাকের এই লম্বা বক্তৃতা শুনে সভাসদ ঠাট্টা মশকরা করতে থাকে। সম্রাট কিছুটা ক্রোধ দমন করে বলেন, " আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে উপদেষ্টা মহাশয়। আগামীকাল থেকে আপনি অবসর গ্রহণ করুন।"

পরদিন সকালে সব পাখিদের ডেকে এক সভা করা হলো। সভায় এন আর সি ও ব্লাসফেমিসহ অনেকগুলো কঠোর আইনও পাস করে নেয়া হয়। তাতে বলা হয়, কাক চরিত্র নিয়ে কেউ কোন কথা বললে তৎক্ষনাত তাকে সপরিবারে উৎখাত করা হবে। লেখক ব্লগার সাংবাদিকদেরও হুশিয়ায় করে দেয়া হয়। কাক চরিত্রের অনুভূতিতে কেউ আঘাত করলে তাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।

কাক সম্রাটের আদেশ শুনে পাখিরা ভয়ে আতংকে জড়সর হয়ে থাকে। কিছু আত্নসন্মানী পাখি এর প্রতিবাদে সভা ত্যাগ করে উড়ে চলে গেল। শুধু হাজার হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে আসা ক্ষুব্ধ অতিথি পাখিরা বলল, "এমন হলে আমরা আপনার সাম্রাজ্যে আর কোনদিন আসবো না। আপনাদের সঙ্গে সমস্ত কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন যোগার করবো। আমারা অবরোধ করবো। একঘরে করবো আপনাদের।" 

আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে শত শত অতিথি পাখি তক্ষুনি কাক-সাম্রাজ্য ত্যাগ করে।

নতুন আইন হাতে পেয়ে কাকেরা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। তারা দোয়েলের বাসায় ঢুকে তাদের ডিম ভেঙ্গে দিয়ে আসে। টিয়ে পাখির ঝাঁক এলে তাদের ধাওয়া করে। শালিকের ছানা ধরে নিয়ে এসে লাঞ্চ ডিনার করে।  আর কোকিলের গান শুনলেই একদল ক্যাডার কাক তাদের ধাওয়া করে বেড়ায়। মাছরাঙার সুন্দর কালারফুল পাখায় পুরিষ-ময়লা মেখে দেয়। কদম গাছের মাথায় ইষ্টিকুটুমের বাসা ভেঙ্গে দিয়ে আসে। 

সম্রাট ও তার সভাসদ সান্ধ্যভোজে ঘুঘু কবুতর আর চড়াই পাখির ছানা ছাড়া খেতেই পারে না এখন।প্রায়ই বড় ধরণের হামলা হয় নিরীহ পাখিদের উপর। 

এই অবস্থা চলতে থাকলে ক্রমশ রাজ্যে পাখির সংখ্যা কমতে থাকে। চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে তারা ভিন্ দেশে অভিবাসন নেয়। সে কী মর্মান্তিক দৃশ্য! অন্য দেশে গিয়েও রিফিউজি স্ট্যাটাস পেতে পেতে জীবনের একটা সময় ব্যয় করে ফেলে ঘরছাড়া পাখিরা। 

এভাবেই পাখিরা নিগৃহীত হতে হতে, দেশ ত্যাগ করতে করতে একদিন শুন্যের কোঠায় এসে দাঁড়ায়। কিন্তু কাকদের সহিংস চরিত্র বদলায় না। আইন তাদের পক্ষে।  তারপর এমন এক দিন আসে কাকের দেশে, যখন অন্য পাখিদের উপর অত্যাচার করার সুযোগও বন্ধ হয়ে যায়। কারণ কাক ছাড়া অন্য কোন পাখি যে আর অবশিষ্ট নেই এই ভূ-কাক সাম্রাজ্যে। 

কাকদের মজার মজার খাবারও গেল বন্ধ হয়ে একদিন। সম্রাটের ডিনারে আর ঘুঘু পায়রার ছানা নেই। আর মানুষেরাও ভীষণ নিষ্ঠুর। অনাহারী কাকদের যে একটু খাবার দেবে তা নয়, উলটে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। আর তেড়ে আসবে না কেন, অন্য পাখিদের রাজ্য ছাড়া করেছে কাকেরা। তাই পাখি প্রেমি মানুষেরাইবা কাকদের ছাড়বে কেন?

কাকের সাম্রাজ্যে দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। ভয়াবহ খাবার সংকট দেখা দেয় কাক সাম্রাজ্যে। ক্ষুধার তাড়নায় আরো বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে কাকেরা। অনাহারি সবল কাকেরা দুর্বল কাকদের ক্ষতম করে তাদের মাংস খেতে শুরু করে। 

লোকে বলে, কাকে নাকি কাকের মাংস খায় না। সেই প্রবাদ বাক্য ভুল প্রমান করে নিজেরাই নিজেদের মাংস খাচ্ছে এখন তারা। এভাবে কাকেরা যখন নিজেদের মধ্যে হানাহানি, হত্যা খুন রাহাজানিতে ধ্বংসের পথে এসে দাঁড়ায়, তখন হঠাৎ একদিন সম্রাটের সেই বুড়ো উপদেষ্টা কাকের কথা মনে পড়ে যায়।

কালবিলম্ব না করে সম্রাট ছুটে যান সেই জ্ঞানবৃদ্ধ প্রজ্ঞ কাকের কাছে। সম্রাট মাথা নত করে সবিনয়ে রাজ্যের এই দুরবস্থার কথা জানান তাঁকে। এবং তা নিরসনে তাঁর কাছে সৎ পরামর্শ চান।

শুনে মহামান্য উপদেষ্টা-কাক বলেন, " আত্নবিধ্বংসী কাকেরা এভাবেই একদিন ধ্বংস হবে জানতাম। তার আভাস আপনাকে আমি বহু পূর্বেই দিয়েছি জাঁহাপনা। এ ভাবেই একদিন পৃথিবী থেকে ডাইনোসোর নামে এক অতিকায় প্রাণীও নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। 

সবার আগে পাখিদের সম্প্রীতি রক্ষা করুন। সকল পাখিদের সন্মান করুন, তাদের জীবনাচরণের স্বাধীনতা,  অধিকার ও কর্তব্যের প্রতি সমানভাবে সহিষ্ণু আচরণ করুন। আর অবিলম্বে বিতাড়িত পাখিদের দেশে ফিরিয়ে আনুন। সহাবস্থান করুন। মিলেমিশে থাকুন। পরশ্রীকারতরা, লোভ হিংসা হীনমন্যতা ত্যাগ করুন। মনে রাখবেন, এই সহাবস্থান ও সহিষ্ণুতাই বহুত্ববাদের মহিমা, পাখিদের পরম্পরা, ঐতিহ্য। আর শান্তি ও সমৃদ্ধির উৎস হচ্ছে সম্প্রীতি।"

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত