শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনা এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী

  সাজ্জাদুর সিরাজ নিবিড়

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২১, ১০:০০ |  আপডেট  : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৬

প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রশ্ন করেছিলেন, “১৯৭১ সালে যখন জেলে আপনার কবরের পাশে ওরা কবর খনন করছিল, তখন কার কথা আগে আপনার মনে জাগল? আপনার দেশের কথা? না, আপনার স্ত্রী-পুত্র পরিজনের কথা? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আ মার আত্নীয় স্বজনদের চাইতেও আমার দেশের মানুষ আগে। আমার যা কিছু দুঃখ ভোগ, তা এদেশের মানুষের জন্য। আপনি তো দেখেছেন, আমাকে তারা কী গভীরভাবে ভালবাসে”। সেদিন ডেভিড ফ্রস্টের আরো এক প্রশ্নের জবাবে জাতির পিতা বলেছিলেন, “ আমি যদি পাকিস্তানীদের কাছে আত্নসমর্পণ করি তাহলে তা আমার দেশের মানুষের জন্য লজ্জার, আমার দেশবাসী বিশ্বের মানুষের কাছে মাথা তুলে তাকাতে পারবে না”। আজ শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ আজ বিশ্বে মাথা উঁচু করে বাঁচে। যেই আত্নবিশ্বাস জাতির পিতার মধ্যে ছিল তা আজ প্রসারিত হয়েছে সমগ্র বাংলাদেশে। তাইতো, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছে।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন তারিখে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার আকাশে পরাধীনতার মেঘের যে কালো ছায়া সমগ্র বাংলাকে গ্রাস করেছিল, সেই পরাধীনতার মেঘ ছিন্ন করে ১৯৭১ সালে বাংলার মাটিকে স্বাধীনতার সূর্যের আলোতে আলোকিত করেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানী জানোয়ার স্বরূপ শাসকেরা পরাজয় নিশ্চিত জেনে ধ্বংস করেছিল বাংলাদেশের রাস্তা-ঘাট, কল-কারখানা, শূন্য করেছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, হত্যা করেছিল জাতির শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের। রিক্ত হস্তে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে বাংলাদেশের এগিয়ে চলার সূচনা হয়েছিল, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুরদর্শী নেতৃত্বে রিক্ত বাংলাদেশ আজ প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ হয়েছে। সামাজিক ও অর্থনীতির সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে উন্নত দেশের দিকে অগ্রসরমান বাংলাদেশ। 

১৯৭২ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ঘোষণা করে বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ । সেই বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২০-২০২১ সালের বাজেটের আকার ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হতে যাচ্ছে। কিন্তু তার ধারণা ছিল না বঙ্গবন্ধু একজন সুনিপুণ কারিগর। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নিরস্ত্র বাঙ্গালি সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত জান্তাদের হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। সেই ধারাবাহিকতার দক্ষ কারিগরের মত শেখ মুজিব দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির পথে ধাবিত করেন বাংলাদেশকে। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু কৃষি খাতে ভুর্তকি প্রদান করেন, সেচ প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ অবস্থা তৈরী করে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিরা। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। মাছ ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়, ধান উৎপাদনে চতুর্থ, আলু উৎপাদনে সপ্তম। কৃষিতে আধুনিকায়নে বর্তমান সরকার কৃষকদের সব ধরনের সুবিধা প্রধান করছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী তলাবিহীন ঝুড়ি তকমা লাগানো বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘে উন্নয়নের রোল মডেল। অর্থনীতিক ও সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ আজ সফলতার উদাহরণ হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃত। এমডিজি উত্তরণে বাংলাদেশের সাফল্যের ধারা এসডিজি অর্জনেও বজায় থাকবে। করোনা মহামারিতে সারাবিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখিন হয়েছে তখন বাংলাদেশের ধনাত্নক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোরে মতে এই হার ৫.৪ শতাংশ। দরিদ্রতা বিমোচনে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম উদাহরণ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে ছয় কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতো, ১৯৯২ সালে এই হার ছিল ৫৭ শতাংশ, বিষ্ময়করভাবে  ২০২০ সালের প্রথমে এই হার নেমে আসে ২০.৫ শতাংশে যা মধ্যে অতি দারিদ্র্য ছিল ১০.৫ শতাংশ। করোনা মহামারীতে এই হার স্বল্প সময়ের জন্য বেড়ে গেলেও আশা করা যাচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে যাবে এবং ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য নির্মূল হবে।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক হবে। বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যে দেশ স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সময় তিনটি সূচক পূরণ করেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সমগ্র বিশ্বে অন্যতম। সামগ্রিক দেশের উন্নয়নে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে দেখতে পাকিস্তানের সরকার প্রধান। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় নিকোলাস ক্রিস্টফ লিখেছেন দরিদ্রতা দূর করতে চাইলে বাইডেন বাংলাদেশ  থেকে শিক্ষা নিতে পারে। যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস এন্ড রিসার্চের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০৩২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহৎ ২৫ টি অর্থনীতির একটি হবে। আগামী ১৫ বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ করে। ২০৩৩ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সুইডেন এবং হংকং এর মত অর্থনীতির দেশকে পেছনে ফেলবে। 

বর্তমান বাংলাদেশ সরকার উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করেছে। জলবায়ুর প্রতিঘাত মোকাবেলায় বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ হাতে নিয়েছে। দেশের উন্নতিকে ত্বরান্বিত করতে মেগা প্রকল্পের কাজ করে যাচ্ছে। আজ প্রমত্তা পদ্মার বুকে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান, ঢাকা শহরকে যানজট মুক্ত করতে মেট্রোরেলের কাজ চলছে, সেই সাথে এলিভেটেড এক্সপ্রেসের কাজ চলছে। নবায়ন যোগ্য বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে পাবনার রূপপুরে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ ২০২৪ সালে শেষ হবে। বাংলাদেশ শতভাগ মানুষ আজ বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করছে। বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশে আজ বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরীর কাজ চলছে। যার ২৮ টির কাজ ২০৩০ সালে শেষ হবে যেখানে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দেশে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষ শ্রমিক বাড়াতে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে সরকার। কারিগরি শিক্ষার হার বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এছাড়া ফ্রি আইসিটি ট্রেনিং এবং যবুকদের বিভিন্ন ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছে সরকার যাতে দেশে উদ্যোক্তা বাড়ে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরী হয়। এই সকল উন্নয়নের সুনিপুণ কারিগর বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রার প্রথম তিন যুগে যত উন্নয়ন হয়েছে বর্তমান সরকারের এক যুগে তার দ্বিগুণ উন্নয়ন হয়েছে।  

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তার সুযোগ্য তনয়া শেখ হাসিনা। তার প্রজ্ঞা ও দুরদর্শীতা বাংলাদেশকে পৌঁছে দিবে উন্নতির চূড়ায়। বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলার মানুষদের ভালবাসতেন, সেই ধারা অব্যহত রেখেছেন শেখ হাসিনা। দেশের সকল শ্রেণির মানুষকে নিয়ে উন্নত দেশ গড়তে শেখ হাসিনা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার উন্নত দেশ গড়ার এ মহান যাত্রা শুভ  হোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্প্রসারণে গড়ে উঠুক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। শুভ জন্মদিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত