শিরোনাম: বৃহন্নলার আত্মকথা

  বর্ণালী চ্যাটার্জী

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪:৪৫ |  আপডেট  : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২:৩৯

আমি এক হতভাগা বৃহন্নলা। যেদিন জন্মেছি, সেদিন থেকেই বিধাতা আমার ললাটে লাঞ্ছনা, অপমান আর ভর্ৎসনা লিখে দিয়েছিল। আমার মা প্রতিবেশীদের কটূক্তির শিকার হয়েছিলেন। তবুও মা আমায় দু'হাত দিয়ে বুকে আগলে রেখেছিলেন... আমায় হারিয়ে যেতে দেবেন না বলে। আমার ঠাকুরমা আর বাবা মিলে অনেক চেষ্টা করেছিলেন আমায় অনাথ আশ্রম কিংবা কোনো এক পথের ধারে ফেলে আসার, কিন্তু মা এই অন্যায় হতে দেননি। কারণ আমি তাঁর সন্তান... তাঁর নারীর টান। এভাবেই বাড়ির ভিতরে ও বাইরে সকলের সঙ্গে লড়াই করে মা আমায় তিলে তিলে বড় করে তোলেন।

তবে এরই মধ্যে ঘটে যায় এক দুর্ঘটনা... ঠাকুরমার মৃত্যু এবং তার কয়েক মাস বাদেই বাবার আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া। আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বাসস্থানটুকু ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্বল ছিল না, খিদে মেটানো তো দূরের কথা, একপ্রকার উপোস করেই দিন অতিবাহিত হতে লাগল। কিছুদিনের মধ্যে মা তিনটি বাড়িতে রান্নার কাজে বহাল হলেন, যা উপার্জন করতেন, তাতে মোটামুটি আধপেটা খাওয়া আর আমার পড়াশোনার যৎসামান্য খরচ চলত।

মায়ের এই লড়াই দেখে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মা যেভাবে নিজের সবটুকু দিয়ে আমায় বুকে আগলে রেখেছেন, আমিও জীবনে অনেক বড় হয়ে মাকে আগলে রাখব। এখান থেকেই আমার লড়াই শুরু... যেদিন একজন আইপিএস অফিসার হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলাম, সালটা এখনো মনে আছে— ১৯৯৮। সেদিন আমাকে নিয়ে আমার মায়ের কী উচ্ছ্বাস, আনন্দ, গর্ববোধ! যেন মনে হচ্ছিল, মা আকাশের চাঁদ পেয়েছেন। আর আমার মনে হচ্ছিল, আমি আজ মাকে পৃথিবীর সেরা আনন্দ দিতে পেরেছি।

আমাদের দিন বেশ সুন্দরভাবেই কাটতে লাগল। এর মাঝখানে একদিন হঠাৎ আমার বাবার আগমন ঘটল আমাদের বাড়িতে... মানুষটার জীর্ণশীর্ণ অবস্থা, বোধহয় বেশ কিছুদিন অভুক্ত ছিলেন। বাবাকে জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলাম, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়ে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন এবং একটি পুত্রসন্তানও রয়েছে। আজ বাবা তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ও ছেলের অত্যাচারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে আশ্রয়ের জন্য এসেছেন।

সে মুহূর্তে কিন্তু আমার একবারের জন্যও মনে হয়নি বাবাকে হোমে বা রাস্তার ধারে বসিয়ে দিয়ে আসি, যেটা আমার জন্মের পর বাবার মনে হয়েছিল। বরং আমার বেশ অহংকার হয়েছিল এই কথা ভেবে— আমি তৃতীয় লিঙ্গ বলে লোকলজ্জার ভয়ে বাবা আমাদের ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। আর যাঁদের সম্মান দিয়েছিলেন, আজ তাঁদের অত্যাচারে নিজেকে বাঁচাতে আমাদের কাছে পালিয়ে এলেন...

এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, আমার বাবা একজন স্বার্থপর মানুষ। তবুও তাঁকে আমি ফিরিয়ে দিতে পারলাম না... নিজের বিবেকের কাছে পরাজিত হলাম। সেদিন বাবা আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, "তুই আমার গর্ব-অহংকার।" তাঁর কাছ থেকে এই প্রাপ্তিটাই ছিল আমার জীবনের অলঙ্কারসম।

কাজেই সব মানুষের কাছে আমার একটাই চাওয়া— "জীবন মানে লড়াই করে টিকে থাকা।"

আমরা বলি না— 'যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ'। সব পিছুটানগুলো সরিয়ে আমাদের বর্তমানকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে হবে ভবিষ্যতের দিকে।

 

সা/ই

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত