বেকার সাত হাজার শ্রমিক

লোকসানে মুলধন হারানোর কারনে আদমদীঘিতে ২৩০ চালকল বন্ধ  

  আদমদীঘি (বগুড়া) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৪, ১৯:২৪ |  আপডেট  : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৩০

টানা লোকসানে ব্যবসার মুলধন হারানোর কারনে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার ২৩০টি চালকল (হাসকিং মিল) বন্ধ হয়ে গেছে। এ সমস্ত চালকলের মধ্যে ১৭৮টি একেবারে বন্ধ এবং ৫২টি চালকল সরকারের সাথে সম্পাদিত চুক্তি মোতাবেক চাল সরবরাহ করতে না পারায় তাদের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। বর্তমানে উপজেলায় ৫৪টি সাধারণ চালকল (হাসকিং) এবং ১১টি স্বয়ংক্রীয় (অটোমেটিক) চালকল চালু রয়েছে। অধিকাংশ চালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চালকলের সাথে সংস্লিষ্ট প্রায় সাত হাজার শ্রমিক তাদের কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। বর্তমানে তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় মোট সাধারণ চালকলের সংখ্য ২৮৪টি এবং স্বয়ংক্রীয় চালকলের সংখ্যা ১৪টি। চুক্তি ভঙ্গ করায় ৫২টি সাধারণ চালকল এবং তিনটি স্বয়ংক্রীয় চালকলের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। বর্তমানে ১১টি স্বয়ংক্রীয় এবং ৫৪টি সাধারণ চালকল চালু রয়েছে। চলতি আমন মৌসুমে উপজেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৭শ মেট্রিক টন। সংগৃহিত চালের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন সরবরাহ করেছে স্বয়ংক্রীয় চালকল বাঁকি ৭শ মেট্রিক টন সরবরাহ করেছে সাধারণ চালকল । 

খোজ নিয়ে জানা গেছে, ধান সমৃদ্ধ এলাকা এবং দেশের সর্ব বৃহৎ খাদ্য গুদাম (সান্তাহার সিএসডি ও সাইলো) এই উপজেলায় অবস্থিত হওয়ায় ৯০ দশকের পর থেকে ব্যাঙের ছাতার মত এখানে চাতাল ব্যবস্যা গড়ে ওঠে। অনেকে ফসলের জমিতেই চাতাল তৈরী করে চালকলের ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসায় ভাল মুনাফা হওয়ায় এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকলেও এক পর্যায়ে এর গতি থেমে যায় ২০০০ সালের পর থেকে এলাকায় একের পর এক স্বংয়ক্রীয় চালকল গড়ে ওঠায়। ধান সেদ্ধ ও শুকানো ছাড়াই স্বয়ংক্রীয় চালকলে সরাসরী কাঁচা ধান থেকে দ্রুত চাল উৎপাদন হওয়ায় থেমে যায় সাধারণ চালকলের ব্যবসা। স্বয়ংক্রীয় চালকলের সাথে ব্যবসায়ীক প্রতিযোগীতায় টিকতে না পেরে লোকসানে পরে একের পর এক সাধারণ চালকল বন্ধ হতে থাকে। 

সান্তাহার শহরের মুসফিক চালকলের স্বত্ত্বাধিকারী মতিউর রহমান জানান, তার একটি সাধারণ চালকলে ১৫ দিনে ধান ছাটাইয়ের ক্ষমতা ১৫৪ মেট্রিক টন, প্রতি দিন ধানের প্রয়োজন হয় ১৪০ বস্তা (প্রতি বস্তা ৭৫ কেজি) কিন্তু শহরের বৈশাখী নামের স্বয়ংক্রীয় চালকলে ১৫ দিনে তিনটি ইউনিটে ছাঁটাই ক্ষমতা ৪৮ হাজার মেট্রিক টন । প্রতি দিন এই চালকলে ধান প্রয়োজন হয় তিন হাজার মেট্রিক টনেরও বেশী। উৎপাদন ক্ষমতার বিশাল ব্যবধানের সাথে তাল মেলাতে না পারার কারনে বন্ধ হতে থাকে একের পর এক সাধারণ চালকল। চালকল ব্যবসায়ী হেলালুর রহমান বলেন, নানা কারণে স্বয়ংক্রীয় চালকল ব্যবসায়ীদের সাথে আমরা টিকতে পারছিনা। এর অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে ধান থেকে চাল উৎপাদনের আনুপাতিক হার। সাধারণ চালকলে প্রতি মণে ধান থেকে চাল উৎপন্ন হয় ২৫ কেজি অথচ স্বয়ংক্রীয় চালকলে প্রতি মণে উৎপন্ন হয় প্রায় ২৮ কেজি। সাধারণ চালকলে ধান থেকে গুড়া ও তুষ বের হয়, যার মূল্য অনেক কম পক্ষান্তরে  স্বয়ংক্রীয় চালকলে ছয়’শ মণ ধান থেকে চালের কুড়া বের হয় প্রায় ৪০ বস্তা। এ সমস্ত কুড়ার প্রতি ৫০ কেজি ওজনের বস্তার মূল্য প্রায় দুই হাজার টাকা। চালের কুড়া থেকে ভৈজ্য তৈল ও মাছসহ পশু খাদ্য তৈরী হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা অনেক গুনে বেশী। এছাড়া স্বয়ংক্রীয় চালকল মালিকরা স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে মোটা অংকের লোন পাওয়ায় ধান কাটার পর পরই বেশি করে ধান কিনে রাখতে পারেন, যেটি সাধারণ চালকল মালিকরা পারেন না। ব্যবসায়ী মতিউর রহমান আরোও বলেন, বর্তমানে বাজারে ধানের দাম বেশী হওয়ায় চাল তৈরী করে লাভ হচ্ছে না। প্রতি মণ ধান কেনাসহ উৎপাদন খরচ পরছে প্রায় ২৪শ টাকা কিন্তু চাল বিক্রি হচ্ছে ২২ শ ৫০ টাকা। প্রতি মণে লোকসান হচ্ছে দেড় থেকে দুই’শ টাকা। আদমদীঘি উপজেলার আরেক ব্যবসায়ী হানিফ উদ্দিন জানান, দুই’শর বেশী চালকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় সাত হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে গেছে। এ সকল শ্রমিকরা বর্তমানে বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মতি চালকলের নারী শ্রমিক রেহেনা বেগম, মর্জিনা বেগম, আনিসুর ইসলাম’সহ কয়েকজন বলেন, মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা বর্তমানে একেবারে বেকার। পরিবারের সদস্যরা এক বেলা খেয়ে দুবেলা না খেয়ে দিন পার করছেন। কেউ কেউ এ পেশা ছেড়ে বিকল্প পেশায় চলে যাচ্ছেন। 

আদমদীঘি উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা গোলাম রব্বানী সাধারন চালকল বন্ধ হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, স্বয়ংক্রীয় চালকলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, ধানের দাম বেড়ে যাওয়া ও মুলধন হারানো’সহ বিভিন্ন কারণে সাধারণ চালকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত