মিরকাদিম সেতু পুরাকীর্তির অপূর্ব নিদর্শন
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২১, ১১:৪৭ | আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৫
মোহাম্মদ আবুল খায়ের মৃধা
-----------------------------
বেশ দেরি হয়ে যাচ্ছে। অন্যদের সে ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ ছিল না। নাটেশ্বর বৌদ্ধমন্দিরে তো কেটে গেল অনেকখানি সময়। এবার পূর্ব পরিকল্পনা মতো মিরকাদিম সেতুতে যাব, কিন্তু বাধ সাধল ঘুম কাতুরে বিপ্লব। সে মধ্যবয়সী আমগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল। ঘোড়া যেমন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায়, অনেকটা তেমন। ছেলেটার দিনে দিনে মাথার চুল কমে যাচ্ছে, সামনের দিকটা অনেকখানি খালি হয়ে গেছে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকগণ যখন বিদেশে যান, তখন অধিকাংশই তেল তেলে নাদুস-নুদুস চেহারা নিয়েই যান। কিন্তু যখন ফিরে আসেন, তখন অনেকেই মাথার চুল রেখে আসেন। চেহারার তেল তেলে ভাবটা বিকিয়ে আসেন। হতে পারে কঠোর খাটুনির ফল, নয়তো আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারার খেসারত। তাঁদের কায়-ক্লেশে,ত্যাগ-তিতিক্ষায় উপার্জিত অর্থে আমাদের অর্থনীতি চাঙা হয়। যার পোশাকি নাম রেমিট্যান্স।
বিপ্লব তো কোনোদিন বিদেশ করেনি, ওর বংশেও কাউকে টেকো মাথা দেখিনি, তাহলে কেন ওর এই দশা? বোধহয় ওরে দিয়েই ওর বংশের নতুন ধারার উদ্বোধন। বিপ্লবকে ছেলে বলা কতটা ঠিক, জানি না। সে বিবাহিত পুরুষ। তাঁর ঘরে সুন্দরী বউ আছে। অবশ্য সুন্দর একেক জনের কাছে একেক রূপে ধরা দেয়। আপনার কাছে সুন্দরের রূপ কেমন, তা বলতে পারি না। কিন্তু বিপ্লবের বউ যে তাঁর কাছে সুন্দরী, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। ওর বিয়ে হয়েছে বহুদিন হয়, বউয়ের প্রতি ভালোবাসা ওর এতটুকু কমতি দেখিনি। আর প্রাণী মাত্রই সৌন্দর্যের পূজারী। কীট-পতঙ্গ ফুলের বাহারি রঙের মায়ায় পড়ে, ফুলের পাশে ঘুরে ঘুরে, প্রেম নিবেদন করে মাথা ঠুকে মরে। আর আমরা মানবকূল, আমাদের কি প্রেম থাকবে না? বিপ্লবের বউ নিয়ে এত কথা বলছি, কারণ ও বউ রেখে আমাদের সাথে বোহেমিয়ানের মতো ঘুরে বেড়ায়। ও ছাড়া আমাদের দলে বাকিরা বউহীন।
অন্যেরা বিয়ে থা করলে কী করবে, বলতে পারি না, কিন্তু জুয়েলকে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ওরে নিয়ে এখনই ট্যুর করা মুশকিল, ঘর থেকে বের হতে চায় না একদমই। জোর-জবরদস্তি করে বের করেছি এবার। কোনোখানে যাওয়ার জন্য হানিফ, হাসপি এক পায়ে খাড়া থাকে সব সময়। ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে এমন এক পায়ে খাড়া লোকই দরকার। বিপ্লবকে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে সবাই গাড়িতে গিয়ে ওঠলাম। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা হাল্কা-পাতলা গাড়ি। প্রায় এক দশক আগে এ ধরনের গাড়ি যখন রাস্তায় নতুন নেমেছে, তখন ওঠেছি। মনে হয়েছিল, যেন পাখির পালকে চড়েছি। নিত্যদিনকার অভ্যাসে এখন আর পাখির পালক মনে হয় না। ব্রেক কষলে পাঁচ হাত দূরে গিয়ে থামে। হুঁশ হারিয়ে সামান্য কোনো কিছুর সাথে লেগে গেলে ভবলীলা সাঙ্গ। ড্রাইভার ছোঁড়া অবশ্য এ পর্যন্ত ভালোই চালিয়েছে। অল্পবয়সী হলে কী হবে, হিম্মত রাখে ঢেড়। সিএনজিচালিত অটোরিকশা দ্রুত যায়, কিন্তু আটশাট, গুমোট, দমবন্ধকরা লাগে। আয়েশ করে পা ছড়িয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বসা যায় না।
এরই মধ্যে গোটা দুই ঝাঁকুনি খেলাম। স্থানে স্থানে পিচ উঠে গিয়ে ইটের সুরকি বের হয়ে গেছে। এই এক ব্যাধি। সংস্কার হতে না হতেই ফের সংস্কারের বাজেট পাশের জন্য ধরনা দাও। সিন্ডিকেটের এতেই মওকা। সবকিছু টেকসই হলে ওনারা চলবেন কী করে? লেনদেন বন্ধ হয়ে অর্থনীতিতে যে বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হবে, তা কারওই কাম্য নয়! ওনারা তো অর্থনীতি সচল রাখতে রাখতে দেশের জন্য নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছেন। স্বাধীনতা পদক ও একুশে পদকে বিশেষ শাখা খুলে ওনাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। যদি ওনাদের অবদানকে অগ্রাহ্য করা হয়, তবে জাতি হিসেবে আমরা বড়ই শরমিন্দা হই।
ড্রাইভার ছোঁড়া অতি সন্তর্পণে ভালোই চালাচ্ছে। বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। দুয়েকবার গান গেয়ে ওঠল। ‘বেলুন বেলুন দাদা বেলুন বেলুন’ আমি ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকাই, দেখি ছোঁড়া আর পুরো গানটি গায়নি। যাক বাঁচা গেল! গানটিকে আমার কাছে অমার্জিত, রগরগে মনে হয়। সবাইকে সাথে নিয়ে শোনার মতো না। অন্তত সব সম্পর্কীয় লোকদের নিয়ে শোনার মতো তো নয়ই। এ গানটি খুব বেশি দিন আগে শুনিনি। মাত্র কিছুদিন আগে পদ্মানদীতে গোসল করতে গিয়ে দেখি ট্রলারে চড়ে একদল কিশোর গানটি বাজিয়ে উদোম গায়ে জামা কোমরে পেঁচিয়ে নাচছে। সে কী নৃত্য! উদ্দাম নৃত্য! সুরের চমৎকারিত্বে আমারও কেমন যেন কৌতুহল হলো। ভাবলাম, গানটি তো কোথাও শুনিনি, হয়তো ইদানিং বের হয়েছে। গুগুল করে দেখি,গানটি লিখিত আকারে নেই। সার্চে ‘ওল্ড পুরুলিয়া ডিজে সং’ নামে একটি ইউটিউব লিংক পাওয়া গেল, সেখানে ঢুকে যতটুকু ভলিউম বাড়ালে আমি শুনতে পাব, ততটুকু ভলিউমে শুনি। ছোঁড়া ওটুকুই গেয়েছিল, এর বেশি আর আগায়নি। বোধ হয় অবচেতন মনেই গেয়ে ওঠেছিল।
মিরকাদিম সেতুতে যাওয়ার পথে রাস্তালাগোয়া এক বাড়িতে কিছু সুপারি গাছ দেখেছি। মূল বাড়ির বাহিরের অংশে গোটা বিশেক গাছ নিয়ে ছোটখাটো একটা বাগান। গাছগুলো সারিবদ্ধভাবে লাগানো। বাড়ির মালিক বোধহয় শখেরবশে বুনেছে। এ অঞ্চলে সুপারিশ গাছ তেমন একটা দেখা যায় না। সিরাজদিখান ও টঙ্গিবাড়ি যা-ই একটু আধটু দেখা যায়, লৌহজংয়ে বিরল। আমাদের বাড়িতে অবশ্য দুটো সুপারি গাছ ছিল, একটি গত বন্যায় পানি পেয়ে মারা যায়। সিরাজদিখানে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে মা এনে লাগিয়েছিলেন। সুপারি গাছ দৈর্ঘ্যে বেশ বড় হয়। এর শেকড় এলোমেলো দাড়ির মতো মাটির ওপরে ভেসে থাকে। কিছুদূর পর পর শরীর ঘিরে দাগ তৈরি হয়, এ দাগ পাতা খসে পড়া স্থানের। লম্বা পাতার মধ্যশিরাটি বেশ শক্ত। মধ্যশিরার দুপাশে চিরল চিরল সবুজ পত্রফলক থাকে। দীর্ঘ ও চওড়া পত্রখোল কা-ের সাথে লেগে থাকে। ছেলেবেলায় সুপারির এ খোল দিয়ে বাল্যসখাদের নিয়ে খেলতাম। মাটির ওপর খোল রেখে, সেই খোলে একজন অন্যজনকে বসিয়ে মধ্যশিরাটি ধরে টানতাম। এইভাবে পালা করে বসা-টানা চলত। মা অবশ্য গরমের দিনের কথা ভেবে খোল কেটে হাতপাখা বানিয়ে রাখতেন। গ্রীষ্ম এলে সেই পাখা সিথানে বালিশের নিচে থাকত। দরকারে বের করে খোলকে মায়ের হাতে পাখা হয়ে উঠার সার্থকতা দিতাম। যখনকার কথা বলছি, তখন বিদ্যুৎ ছিল না, ব্যাটারিতে সাদাকালো টিভি চলত; তাও পুরো গ্রামে একটি কি দুটি। ছোটখাটো অনুষ্ঠানে হ্যাজাক লাইট ব্যবহারের চল ছিল। আইপিএসের তো প্রশ্নই আসে না। বিদ্যুৎ নেই, আইপিত্রস কীভাবে চার্জ হবে? তিন ব্যাটারির ইভারেডি টর্চ লাইট যার হাতে থাকত, সে ওই এলাকার তখনকার দিনের অবস্থাসম্পন্ন ঠাটবাটওয়ালা।
নাটেশ্বর হতে আব্দুল্লাহপুর বাজার রোড হয়ে হাতিমারার দিকে যে রাস্তা গেছে সেদিকে মিরকাদিম সেতুতে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। সেতুটি দেখে আমার চক্ষু তো চরকগাছ! এত্ত সুন্দর সেতু তো কস্মিনকালেও দেখিনি। ধারনাতীত সুন্দর। চুনসুরকির তৈরি। দুপাশ অত্যন্ত খাড়া। হেঁটে পার হব বলে গাড়ি থেকে নামলাম। যে পাশ দিয়ে উঠব, তার বাঁ পাশে গোড়ায় একটি নাতিদীর্ঘ অশ্বত্থ গাছ। রোদের কারণে এর তলে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। ঘুরে বেড়াতে এসেছি, রোদটোদ দেখলে কী চলে? দেরি না করে যে যার মতো সেতুর ওপর ওঠলাম। খাড়া হওয়ার কারণে গাড়ি সাবধানে নামাতে-উঠাতে হয়। মোগল আমলের সেতু। সেতুর নিচে দুপ্রান্ত থেকে প্রায় মাঝ অবধি নিরেট করে বাঁধা। মাঝখানে তিনটি খিলান। দুটি ছোট খিলান ও একটি বড়। ছোট দুটি মূলত পানি যাতায়াতের জন্য রাখা। বড়টি দিয়ে নৌকা-ট্রলার যাওয়া-আসা করে। নৌযান যাওয়া-আসার সময় ঘর্ষণে চুনসুরকির পলেস্তরা খসে বড় খিলানের দুপাশের ইট বের হয়ে আছে। নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরশ্রোতা মিরকাদিম খাল। সেতুর পূর্বপ্রান্ত সদর উপজেলার পানাম-পুলঘাটা আর পশ্চিমপ্রান্ত টঙ্গিবাড়ি উপজেলার আব্দুল্লাহপুর এলাকায় পড়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে। তাঁদের টানানো সাইনবোর্ড অন্তত তা-ই বলে। সেতুটি বারবার সংস্কারের ফলে এর আদি রূপএখন আর পুরোপুরি নেই।
নাটেশ্বরের মতো এখানেও সেই একই সমস্যা, রোদে খা খা করছে চারদিক। বুকের ছাতি শুকিয়ে যাচ্ছে। নাটেশ্বরে তো হাসপি কুলফি মালাই এনে খাইয়েছিল। এখানে তো সে উপায় দেখছি না। বিপ্লব ও জুয়েল অনেকটাই ক্লান্ত। হানিফ এখনো চাঙা আছে। ছবি তুলব, কিন্তু আমাদেরসহ পুরো সেতুর ছবি তুলতে গেলে দূর থেকে আমাদের ঠিক চেনা যায় না। রোদ মাথার ওপর হওয়াতে আলোর অভাবে চেহারা কালো দেখায়। আর আমরাসহ আস্ত সেতুর ছবি নিতে না পেরে মনে শান্তি আসছে না। সেতুটির সাথে আমরা একখানা ছবি যদি না তুলি, তবে ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে আমাদের সম্পর্ক কী করে হয়? নেট ঘাটলেই না সেতুটির দুর্দান্ত সব ছবি পাওয়া যায়, তবে আর কষ্ট করে এখানে আসা কেন? সেতুর ওপরে-নিচে কাছে দূরে-দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। আলোর অসামঞ্জস্যতায় মনপুত হয়নি। উল্লেখ্য, সেলফিবাজ হাসপি সেতুটির সঙ্গেও একখানা সেলফি তুলতে কসুর করেনি।
সেতুর কাছে, খালের পাড়ে, হাঁটাপথ দূরত্বে একটি গরুর খামার। কী এগ্রো ফার্ম যেন, মনে নেই। ড্রাইভার ছোঁড়াকে গাড়িতে পাহারায় রেখে সদলবলে সেখানে গেলাম। দেখি গোটা দশেক গরু নিয়ে ফার্ম। গোবর আর গোমূত্রের গন্ধে চারদিকের বাতাস গোময় হয়ে ওঠেছে। জুয়েল পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চেপে ধরেছে। বিপ্লব খালি হাতে কয়েকবার গন্ধ আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বারকয়েক নাকে কম্পন সৃষ্টি করে ক্ষান্ত দেয়। হাসপি গরুর সাথে সেলফি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর আমি ক্লোজ শট, মিড শট ও লং শটে পুরো খামারটিকে ভিডিও করতে থাকি। অন্যদিকে হানিফ খামারের কেয়ারটেকারের সাথে আলাপ জমিয়ে দেয়। ও তো খামোখা কথা বলার লোক না। কাছে গিয়ে দেখি কেয়ারটেকারকে খামার সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা প্রশ্ন করছে। জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর অফিস থেকে ছয় মাসব্যাপী গবাদী পশু পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছে ও। ইচ্ছে গরুর খামার করা। আজকাল অবশ্য অর্ধশিক্ষিত-শিক্ষিত বেকার যুবক এসব পেশায় যুক্ত হচ্ছে। গত এক দশক ধরে আমাদের জেলায় এর প্রবণতা বাড়ছে। দেশের অন্যান্য জেলার মানুষ এ পেশায় অনেক আগেই ব্যাপকহারে যুক্ত ছিল। আমাদের এখানেও নতুন নতুন উদ্যোক্তা খামার তৈরি করছেন। হানিফ পরিশ্রমী মানুষ, যথার্থ পরামর্শ পেলে সে সফল হবে। কাজের প্রতি ওর ডেডিকেশন আছে।
গরুর খামার থেকে সেতুর ওপর ফিরে এসেছি। আমাদের ঘিরে জনাপাঁচেক বালক জটলা পাকাল। ওদের কৌতুহল, ভর দুপুরে পাগলগুলো কী করছে? ওদের মধ্যে কয়েকজনকে সেতু থেকে খালের পানিতে লাফ দেওয়ার আয়োজন করতে দেখে আমি বললাম, তোমরা একটু অপেক্ষা কর, নিচে গিয়ে ক্যামেরা রেডি করে যখন বলব, তখন লাফ দেবে। উদ্দেশ্য লাফ দেওয়া অবস্থায় ওদের ছবি তোলা। আবার দুর্ঘটনার ভয়ও ছিল। নিজেকে প্রবোধ দিলাম, ওরা তো নিত্যদিনই লম্ফঝম্ফ করে। আমরা তো ডেকে আনিনি। ছবি তুললেও লাফ দেবে, না তুললেও। জলকেলি করা ওদের রোজকের অভ্যেস। (চলবে)
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত