মহান ভাষা আন্দোলনের সাত দশক : ফিরে দেখা

  কেশব মুখোপাধ্যায়

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:২৯ |  আপডেট  : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ২০:৩৪

একুশে ফেব্রুয়ারি হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা বা বিষয় নয় । ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া কিংবা ভাগ করা একটি জাতি সত্তা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের সূচনা লগ্নেই, সম্পূর্ণ উল্টো দিকে ঘুরে ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতি পরিচয়ের শিকড় অনুসন্ধান যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রচনা করে, তা সামান্য ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে না । বাঙালি জাতি পরিচয়ের প্রশ্নে একুশে ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন, এক বিশাল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী ঐতিহাসিক ঘটনা । ভাষা আন্দোলনের চেতনা ভৌগোলিক অবস্থান এবং সময়ের গন্ডি অতিক্রম করে তা ক্রমশ বাঙালি জাতি পরিচয়ের শিকড় সন্ধান এবং অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছে ।

'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি'র
মহান চেতনা,  ভাষা আন্দোলনের স্মারক, ইতিহাস এবং জনমানসে তার ইতিবাচক প্রভাবকে মুছে ফেলার নানা ষড়যন্ত্র নিয়োজিত থেকেও তা কার্যকর করতে বার বার ব্যার্থ হয়েছে ধর্মান্ধ পাকিস্তানি স্বৈরশাসক। বরং ভাষা আন্দোলনের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা জনমানসে ব্যাপ্তি পেয়ে এবং তা গভীর থেকে গভীরতর হয়ে  পরবর্তী সময়ে নানা পর্যায়ে আন্দোলন - সংগ্রাম এবং বহু রক্ত এবং বাংলার মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের শৃঙ্খল এবং চিহ্ন কবরে পাঠিয়ে, পূর্ববাংলার জনগণ ১৬ ডিসেম্বর (১৯৭১) বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মহান বিজয় অর্জন করেন । ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্মলাভ করে বাংলা ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ।

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিজয় অর্জনের পাকিস্তানি শাসন - শোষণ - বঞ্চনা - অত্যাচার ইত্যাদি ছিল কার্যকর। । তবে সব থেকে বেশি কার্যকর ছিল পূর্ববাংলার বাঙালির মুখের ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষাকে উর্দুর দাসত্ব এবং পাকিস্তানি শৃঙ্খল মুক্ত করার স্বপ্ন । বাংলা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ওই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সূচনা।

এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন ভাষার যেমন ধর্ম পরিচয় নেই, তেমনি নেই শ্রেণি পরিচয় । ভাষা ধর্ম,বর্ণ, শ্রেণি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে সমগ্র জাতির সম্পদ । আমরা ভাষার সাহায্যে চিন্তা করি, ভাষার সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করি, ভাষার সাহায্যে জ্ঞান আরোহণ করি এবং ভাষার সাহায্যে তা মস্তিষ্কে ধরে রাখি । ভাষা আছে বলেই মানুষ গুহা থেকে আজ মহাকাশে বিচরণ করছে ।

পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটির সঙ্গে বাঙালির যে দ্বন্দ্ব ও  বিরোধ, তার সূচনা হয়েছিল ধর্মকে ভিত্তি করে  পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই,  রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে । অবশ্য ভাষা প্রশ্নে  দ্বন্দ্ব বা বিরোধের কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকার হেতু ছিল না । কারণ পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ছাপান্ন শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা । অন্যদিকে উর্দু ছিল মাত্র সাত শতাংশের ভাষা । ন্যায্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দিলে,  রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাই হতো পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রেভাষা । কিন্তু রাষ্ট্রভাষা তো দূরের কথা, ধর্মের নামে পূর্ববাংলার বাঙালির মুখের থেকে বাংলা ভাষা কেড়ে নিয়ে, মুছে দিয়ে বিজাতীয়  উর্দু ভাষা বাঙালির উপর চাপিয়ে দেওয়ার হলো । বলা হলো বাংলা ভাষা হিন্দুদের ভাষা এবং 'পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, তাই পাকিস্তানের ভাষা হইবে মুসলিমদের ভাষা উর্দু ।'  ১৯৪৮-এ করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ২৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৮) ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা ভাষার ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক দাবি বা প্রস্তাব উত্থাপন করার 'অপরাধে' তিনি 'ভারতের চর' বিশেষণে অভিযুক্ত হয়ে লাঞ্ছিত হন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে একাত্তরের শহিদ ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন পাকিস্তানের শাসকদের চোখে প্রথম চিহ্নিত 'ভারতের চর' ।

বাংলা ভাষার ন্যায্য দাবি উচ্চারণ করে 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' শিরোনামে প্রথম যে লেখাটি ৩০ জুন ১৯৪৭ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তার লেখক ছিলেন আব্দুল হক । ওই নিবন্ধে আব্দুল হক লেখেন, 'পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ভাষা পাঁচটি : বেলুচী, পশতু, সিন্ধী, পাঞ্জাবী এবং বাংলা । পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু নেই তা নয়, বাংলাও আছে । কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে তো নয়ই, পশ্চিম পাকিস্তানের কোনোও প্রদেশের মাতৃভাষা উর্দু নয় ।' (সূত্র : ইত্তেফাক ২২-০২-২০১৯)
এক মাস পর ২৯ জুলাই ১৯৪৭ তারিখে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা' শিরোনামে  বহু ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লেখেন, 'পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন, যেমন ------ পশতু, বেলুচী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা । কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশের মাতৃভাষারূপে চালু নয় ‌।'
তিনি আরো লেখেন, 'উপরিউক্ত ভাষাসমূহের মধ্যে বাংলা ভাষার সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করিয়াছে । কত অধিকসংখ্যক লোকে একটি ভাষা বলে, এই অনুযায়ী বাংলা ভাষা বিশ্বভাষার মধ্যে সপ্তম স্থান অধিকার করিয়াছে।'

পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু এই বিতর্কে শুধু অবাঙালি মুসলিম লিগ নেতৃত্ব এবং তাদের অনুচররা নয়, বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে  মাঠে নামানো হয়েছিল এক শ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষাবিদদের ।   ১৯৪৭-এর জুন মাসে দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানায় অবস্থিত ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ প্রধান অতিথির ভাষণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন । মুসলিম লিগের রাজনৈতিক নেতাদের মতো ধর্মীয় অসার অবস্থান ছাড়া, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রস্তাবের পিছনে অন্যকোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি কার্যকর ছিল কি ?

ওই প্রেক্ষাপটে  বাংলা ভাষার ন্যায্য দাবির স্বপক্ষে প্রথম পুস্তিকা প্রকাশিত হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ । 'তমদ্দুন মজলিস' কর্তৃক 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু' শিরোনামে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ওই পুস্তিকায় বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিক দাবি জানিয়ে তিনটি লেখা প্রকাশিত হয় । প্রকাশিত তিনটি প্রবন্ধ বা নিবন্ধ  লিখেছিলেন, অধ্যাপক আবুল কাসেম, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং আবুল মনসুর আহমদ । এই সূত্রে উল্লেখ করা যায়, ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতন অনুষ্ঠিত প্রথম ভাষা শহিদ স্মরণ সভায়, পূর্ববাংলা থেকে আগত কাজী মোতাহার হোসেন বলেছিলেন, '... আমাদের মুখের ভাষা যদি ওরা কেড়ে নেয়, আমরা তা হলে পাকিস্তান ছেড়ে দিতেও কুণ্ঠা বোধ করব না ।'
১৯৫৩ সালে  শান্তিনিকেতনে প্রথম বর্ষের  ভাষা শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল অন্নদাশঙ্কর রায়-এর নেতৃত্বে এবং গৌরী দত্ত (পরে আইয়ুব) এবং নিমাই চট্টপাধ্যায়ের নিষ্ঠা ও উদ্যোগে। 

ভাষা শহিদ ও সংগ্রামীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা । জয় বাংলা ।
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, কলকাতা

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত