বাংলার প্রথম এবং একমাত্র নারী নবাব

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৫ জুন ২০২৪, ১৭:৩১ |  আপডেট  : ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:২৭

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ও একমাত্র মহিলা নওয়াব ও নারীশিক্ষার পথিকৃৎ। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে কুমিলস্না (ত্রিপুরা) জেলার পশ্চিমগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ব্রিটিশ শাসনাধীন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান মহিলা নওয়াব ও নারী শিক্ষার রূপকার এবং প্রজাবৎসল জমিদার।  ফয়জুন্নেসার পিতা আহমেদ আলী চৌধুরীর পূর্বপুরুষ দিলিস্নর বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে সনদ লাভ করে হোমনাবাদ পরগণার জমিদার হন।

ছোটোবেলা থেকে লেখাপড়ায় তার প্রচুর আগ্রহ দেখে ফয়জুন্নেসার বাবা মেয়ের জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। তিনি কঠোর নিয়মানুবর্তিতা পালন করে তার জ্ঞানস্পৃহাকে আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তোলেন। গৃহশিক্ষকের সাহায্যে ফয়জুন্নেসা খুব দ্রুতই কয়েকটি ভাষার উপর গভীর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। বাংলা, আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃত এ চারটি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ সহ ফয়জুন্নেসার এ প্রতিভা স্ফুরণে তার শিক্ষক তাজউদ্দিনের অবদান অতুলনীয়। 

১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী বাউক সারের জমিদার মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফয়জুন্নেসা স্বামীর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন। প্রায় ৬/৭ বছরের মাথায় স্বপত্নী বিদ্বেষের কারণে তার স্বামী থেকে বিচ্ছেদ ঘটে। তিনি পিতৃগৃহে ফিরে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন এবং স্বামীর সাথে যোগাযোগ বন্ধ বিচ্ছেদ করেন। ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ স্বামীর মৃতু্য পর্যন্ত তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। দেন্মহরের এক লক্ষ এক টাকা দিয়ে তিনি নিজের একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। 

ফয়জুন্নেসা জমিদারি পরিচালনার প্রশিক্ষন নিয়েছিলেন। তাছাড়া বুদ্ধির দীপ্ততা, বিচক্ষণতা আর কর্মদক্ষতায় অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। তাই ১৮৭৩ সালে তার বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারি লাভ করেন। তবে ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী কবে থেকে জমিদারির দায়িত্ব নেন তা নিয়ে কিছুটা ভিন্নমত পাওয়া যায়। বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া বলছে, ১৮৮৩ সালে তিনি জমিদারি শুরু করেন। যদিও গবেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, ১৮৭০ সালের পর থেকেই ফয়জুন্নেসা জমিদারি দেখাশোনার কাজটি শুরু করেন।

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুসলমান নারী জাগরণের পথিকৃৎ। বাংলাদেশের নারী সমাজ যখন অবহেলিত তখন তিনি ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে নিজগ্রামে কুমিলস্না (ত্রিপুরা) জেলার লাকসামে মহিলাদের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করে নিজেই তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োজিত হন। এটি উপমহাদেশের বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রাচীনতম স্কুলগুলোর অন্যতম। কালক্রমে এটি একটি কলেজে রূপান্তরিত হয় এবং এর নাম হয় নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজ।

জমিদার হওয়ার পর তাঁর সেবার হাত আরও প্রসারিত হয়। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্দানশীন বিশেষত দরিদ্র মহিলাদের চিকিৎসার জন্য তিনি নিজ গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি “ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল” নামে একটি চিকিৎসালয় ও স্থাপন করেন। এছাড়া শিক্ষা বিস্তারে তিনি মাদ্রাসা, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন। দু:স্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল নির্মাণে ও অন্যান্য জনহিতকর কাজে অর্থ দান করেন। মসজিদ নির্মাণেও তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, দিঘী-পুস্করিণী খনন প্রভৃতি জনহিতকর কাজে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এতে তাঁর নাগরিক ও প্রগতিশীল চেতনার প্রমাণ পাওয়া যায়। ফয়জুন্নেসা বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীর ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। “ঢাকা প্রকাশ” ছাড়াও তিনি বান্ধব, মুসলমান বন্ধু, সুধাকর, ইসলাম প্রচারক প্রভৃতি বাংলা পত্র-পত্রিকা তাঁর আর্থিক সহায়তা লাভ করে।

নওয়াব ফয়জুন্নেসার বিভিন্ন জনহিতকর কাজ দেখে রানি ভিক্টোরিয়া তাকে নবাব উপাধি প্রদান করেন । এর পিছনেও রয়েছে সুন্দর গল্প।  ওই সময় ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন মি. ডগলাস। স্থানীয় উন্নয়ন কাজে সরকারি অর্থ আসতে দেরি হওয়ায় তিনি স্থানীয় ১০জন জমিদারের কাছে ঋণ হিসাবে ১০ হাজার টাকা করে এক লাখ টাকা চেয়েছিলেন মি. ডগলাস। কিন্তু সুদ কম হওয়ায় কেউই অর্থ দিতে রাজি হননি। কিন্তু সেসময় ফয়জুন্নেসা চৌধুরী মি. ডগলাসকে এক লাখ টাকা দান করেন। এবং সে অর্থ কখনো ফেরত নিবেন না বলে জানান। ফয়জুন্নেসার এই অবদানের কথা ম্যাজিস্ট্রেট ইংল্যান্ডে রানি ভিক্টোরিয়াকে লেখেন। এরপর জনহিতৈষী কাজের জন্য রানি ভিক্টোরিয়া জমিদার ফয়জুন্নেসাকে 'বেগম' উপাধি দেন। 

কিন্তু ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী দুইবার সেই উপাধি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছিলেন, 'তার প্রজাদের কাছে এমনিতেই তিনি বেগম হিসেবে পরিচিত, সুতরাং নতুন করে ওই উপাধির প্রয়োজন নেই।' এরপর রানি ভিক্টোরিয়ার মনোনীত এক প্রতিনিধিদল এসে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট পাঠায় ইংল্যান্ডে। তার সাহস, সময়ানুবর্তিতা, মহত্ত্ব দেখে প্রতিনিধিদল রিপোর্ট তৈরি করলে তার ওপর ভিত্তি করে ১৮৮৯ সালে রানি ভিক্টোরিয়া ফয়জুন্নেসাকে 'নওয়াব' উপাধি দেন। তিনিই বাংলার প্রথম মহিলা যিনি এই উপাধি লাভ করেন। অভিষেক অনুষ্ঠানে তাকে হীরাখচিত একটি পদক, রেশমি চাদর এবং সার্টিফিকেট দেয়া হয়। 

Caption

১৯০৩ সালে ৬৯ বছর বয়সে তিনি কুমিল্লার লাকসামে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯০৩ সালে মারা যাওয়ার আগে নিজের জমিদারির বড় অংশটি ওয়াকফ্ করে দিয়ে যান নওয়াব ফয়জুন্নেসা, যা থেকে কুমিল্লার লাকসামের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা আজও বৃত্তি পায়। 

 

সা/ই

 

 

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত