বাংলাদেশ পরিবেশ রক্ষা আইন ও বাস্তবতা

  মো.জয়নাল আবেদীন

প্রকাশ: ৯ জানুয়ারি ২০২২, ১১:৪৮ |  আপডেট  : ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৫২

আমার মনেহয় বাংলাদেশই বিশ্বে একমাত্র দেশ যে দেশে হাজার হাজার আইন আছে, কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয় না। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০) এর ৬(ঙ) ধারা অনুযায়ী জলাধার হিসেবে শ্রেণীভূক্ত কোনো জায়গা ভরাটের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। উক্ত আইনে জলাধার ভরাট করা অপরাধ হিসেবে গণ্য। অপরাধীদের অনধিক দুই বছর কারাদন্ড ও অনধিক দুই লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে (সূত্রঃ পরিবেশ অধিদপ্তর, মুন্সীগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের স্মারক নং-২২.০২.৫৯০০.১৪৪.৬০.১৯০.১৭.তারিখ ০১.০১.২০১৮)। কিন্তু আমার নিজ জেলা মুন্সীগঞ্জসহ দেশের সর্বত্র যে হারে নিচু ফসলিজমি, ডোবা-নালা, পুকুর, দিঘি,খাল, বিল,হাওর, বাওর ও নদ--নদী ভরাট করে ভূমিদস্যুরা প্লট, ফ্লাটের নামে আবাসন বানিজ্য করে পরিবেশ ধ্বংস করে চলেছে- সেক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের প্রয়োগ করে অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের উদাহরণ খুব একটা দেখা যায় না।

গত দু দশকে শ্রীনগর উপজেলায় যত ডোবা-নালা, ফসলিজমি ,পুকুর, দিঘি, জলাশয়, সড়কের দু’পাশের নিচু নালা ,খাল ভরাট করে মার্কেট করা হয়েছে তা সংখ্যার দিক দিয়ে শতাধিক হবে।এসব করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা, এমপি ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে। এমন কি শ্রীনগরে পুলিশ প্রশাসনও বাজারের দক্ষিণে ও পুরাতন থানার পশ্চিমের পুকুরটি ভরাট করে বানিজ্যিক ভবন নির্মানের কাজ শুরু করেছে।মুন্সীগঞ্জ জেলা পরিষদ এ ব্যাপারে একেবারে চ্যাম্পিয়ন। শ্রীনগর ডাকবাংলা ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দক্ষিণের দৃস্টিনন্দন দীর্ঘ লেকটি ভরাট করে মার্কেটের নামে ইট,বালু, রডের জঞ্জাল সৃষ্টি করেছে।

 দেউলভোগ গরুর হাটের পূর্ব ও উত্তরের বিশাল জলাশয় ক্ষমতাসীন দলের সাবেক এমপির ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে পরিচিত ও ক্ষমতাসীন দলের সহ-সভাপতি পরিচয় দানকারী ব্যক্তি সহোদর ভাইয়ের নাম দিয়ে ভরাট করে এলাকার পরিবেশের সর্বনাশ ঘটিয়েছেন। এ ছাড়াও শ্রীনগরে পোদ্দারপাড়ার দিঘি ও ব্রজেরপাড়ার পুকুর ভরাট করে আবাসিক প্লট ও মার্কেট নির্মান করায় বর্ষার বৃিষ্টতে আশপাশে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এসব ভরাট বানিজ্য  প্রশাসনের নাকের ডগায় হয়েছে। যার ফলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠ বার মাস পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে।

এ সব জলাধার ভরাটকারী চক্র রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনকে হাত করে সিন্ডিকেট বানিজ্য করে আসছে অবাধে। কারণ তারা সচেতন ও পরিবেশবান্ধব মানুষের থেকে কোনো প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের মুখোখামুখি হয়নি এতকাল। কিন্তু আশার কথা, সম্প্রতি শ্রীনগর উপজেলার বালাশুরের সাহেব বাবুর দিঘি ভূমিদস্যুরা ভরাট করতে গিয়ে জনপ্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এ দিঘির আয়তন প্রায় ৪.৯৩ একর। ১৯১৩ সালে জনস্বার্থ বিবেচনায় পদ্মা-ধলেশ্বরী নদীর সংযোগ খাল (লৌহজং- শ্রীনগর-সৈয়দপুরখাল) নিজ অর্থ ব্যয়ে পুনঃখনন করে দিয়েছিলেন ভাগ্যকুলের কুন্ডু পরিবারের দানশীল ব্যক্তি জানকী নাথ রায়। তাঁদের মূল বাড়ি পদ্মায় ভেঙে  গেলে তাঁর পুত্র রমেন্দ্র নাথ রায় এ সুবিশাল জলাধার খনন করেছিলেন নতুন বসত বাড়ি নির্মাণের জন্য। ধারণা করা হয় ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি আর নির্মিত হয় নি। তাঁরা আর দেশে আসেননি। কুন্ডু পরিবারের যদুনাথ রায় পাকিস্তান হওয়ার পরেও মাটির টানে দেশে থেকে যান। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর কুখ্যাত মোনায়েম খানের সরকার পুলিশ দিয়ে তাঁকে চেনেহিঁচড়ে ভাগ্যকুল থেকে গোয়ালনন্দগামী স্টিমারে তুলে দেয়। ১৯৪৭ সালের পর থেকে কুন্ডুদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি লুটতরাজ ও দখল হতে থাকে। সর্বশেষ দখলের ঘটনা রমেন্দ্র নাথ রায়ের বাড়ি ও বিশাল জলাধার। এ সম্পত্তি খাসভূক্ত হওয়া সত্বেও জাল দলিল করে নিজেরা নিজেরা সাজানো মামলা করে বালাশুরের জনৈক আলেপ বেপারি মালিক বনে যায়। তাঁর থেকে এলাকার এক প্রভাবশালী তা কিনে নিয়ে ক্লিনিক করার জন্য দিঘিটি বালু দিয়ে ভরাট করা শুরু করে। যা স্থানীয় পরিবেশ সচেতন মানুষের প্রতিরোধে প্রশাসন থেকে বন্ধ করা হয়।এখন প্রশ্ন হলো, এ প্রভাবশালী ব্যক্তি কে? কি তাঁর পরিচয়?

মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের প্রাক্তন সংসদ সদস্যের আমলে শ্রীনগরে সবচেয়ে বিশাল ভরাটবানিজ্য হয়েছে। বর্তমান ভরাটের সাথে অনেকে বর্তমান সংসদ সদস্যের জড়িত থাকার কথা বলছেন। তা কতটুক সত্য বা মিথ্যা তা আমরা জানিনা।তাঁকে বা তাঁর প্রতিনিধিকে এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করতে অনুরোধ করছি। তা নাহলে এ নিয়ে গুজব ছড়াতে থাকবে এবং মানুষ মিথ্যাকে সত্য বলে মনে করতে থাকবে।

আমাদের উপজেলাসহ মুন্সীঞ্জর সকল উপজেলার পরিবেশবান্ধব সচেতন মানুষের প্রতি আবেদন- যেখানে জলাশয় ভরাট হতে দেখবেন, সেখানেই বাধা দিবেন। এবং এ জন্য সংগঠিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি স্বার্থে জলাশয় ভরাট করতে থাকলে প্রকৃতি কিন্তু প্রতিশোধ  নেবে। প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম; যা থেকে আমরা কেউ রক্ষা পাবোনা।

 লেখকঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. এর পরিচালক।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত