বাংলাদেশ উদ্বেগজনক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২৭ |  আপডেট  : ১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৬:৪৯

বিশ্বব্যাংক আগামী অর্থবছর, ২০২৪-২৫ এ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ০.১ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে ৫.৭ শতাংশ হবে বলে বলছে। তবে তা ৫ বা ৪ শতাংশ হবে বলে মনে হচ্ছে।  বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতি, আমদানি বিধিনিষেধ এবং আর্থিক খাতের দুর্বলতা অর্থনীতির উপর প্রভাব ফেলবে। বলা চলে বাংলাদেশ উদ্বেগজনক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভবিষ্যত রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ভারসাম্যের উপর নির্ভর করছে। ৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি লোক বেকার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, গামেন্টস শিল্পে নৈরাজ্য চলছে, যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ও হচ্ছে। তীব্র তারল্য সংকটের কারণে অসংখ্য বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উদ্যোক্তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং অন্যান্য পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি প্রতিকূল ঘটনার কারণে অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে, তাই বাংলাদেশ, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান ঋণের কারণে অর্থনীতির আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। গত কয়েক মাস বাংলাদেশের রাজনীতি উত্তাল । শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এবং শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত পর বাংলাদেশ তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে, দ্রুত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শেষ হয়ে যাচ্ছে, ঊর্ধ্বমুখী ঋণ, জ্বালানির উচ্চমূল্য এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।

বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্প, যা রপ্তানির ৮০ শতাংশ এবং জিডিপির ১৫ শতাংশ তা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। জুন ২০২৪ পর্যন্ত, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল ১০৩.৮ বিলিয়ন ডলার। দেশের ঋণ-টু-জিডিপি অনুপাত ৩৭.৯ শতাংশ। উদ্বেগজনক বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কারণে বিনিয়োগকারীদের আস্থাকে ক্ষুন্ন করেছে। পরিস্থিতি শোচনীয় এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ হয়ে উঠছে। অর্থনৈতিক মন্দা ঠেকাতে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে। আইএমএফ ৪.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ কি তবে মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের কারণে বেলআউট করার জন্য তৃতীয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হয়ে উঠছে? ইতিমধ্যে, অনেক 'বায়িং হাউস' যার বেশিরভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ইইউ দেশগুলিতে পোশাক রপ্তানি করে তাদের অফিস বন্ধ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশ কি তবে একটি উদ্বেগজনক অর্থনৈতিক পতনের দিকে যাচ্ছে? জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তীব্র দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে পারে, গার্মেন্টস সেক্টরের বেশিরভাগই তাদের চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছে৷ আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট, হিজবুত তাহরির এবং হেফাজত-ই-ইসলামের মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ইতিমধ্যে তাদের অর্ডারগুলি বিকল্প দেশে স্থানান্তরিত করছে৷ উদ্বেগজনক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, যে বাংলাদেশ একসময় এশিয়ার একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক তারকা হিসেবে দেখা যেত, সেটি বর্তমানে আরেকটি লিবিয়া, ইরাক বা পাকিস্তান হওয়ার পথে।

বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ডঃমুহাম্মদ ইউনূস, বিল ক্লিনটন, হিলারি ক্লিনটন এবং জর্জ সোরোসের মতো ব্যক্তিত্বের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্য পরিচিত। ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪, জর্জ মার্ক ম্যালোচ ব্রাউন, ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং ইউএনডিপির সাবেক প্রধান, ইউনূসের সাথে একটি দীর্ঘ বৈঠক করেন। ব্রাউন আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের একজন উপদেষ্টা এবং জর্জ সোরোসের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ জানুয়ারী, ২০২৫-এ কার্যভার গ্রহণ করার পর পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। ডঃ ইউনূস, ট্রাম্পের একজন সমালোচক। তাই ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশী রপ্তানি, ভিসা বিধিনিষেধ এবং ইউনূস ও তার সহযোগীদের উপর শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপ করতে পারে। ট্রাম্প সরকার যুক্তরাষ্ট্রে ইউনূসের ব্যবসায়িক উদ্যোগের তদন্ত, 'গ্রামীণ আমেরিকা' সহ, যেখানে হিলারি ক্লিনটন জড়িত, তার কার্যকলাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারে।

এদিকে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাসন থেকে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ইউনূস ও তার উপদেষ্টাদের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ। এটি ডঃ ইউনূসকে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করতে পারে। আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জনের জন্য মরিয়া ডঃ ইউনূস ঢাকায় একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন, যাতে দাবি করেন যে ২৮ জন ইইউ রাষ্ট্রদূত তার সরকারের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে অংশ নেবেন। কিন্তু মাত্র ১৮ জন উপস্থিত ছিলেন, যাদের বেশিরভাগই জুনিয়র-র্যাঙ্কিং কর্মকর্তা ছিলেন। তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে সমালোচনামূলক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল, যা ডঃ ইউনূসের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশের বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক সংকট, বর্তমান সরকারে বিতর্কিত নীতি দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। হিন্দুদের বিরোধী মনোভাব এবং পাকিস্তানপন্থী নীতি এই অঞ্চলে উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক ও ভূ-রাজনীতির সাথে এবং দেশের ভেতরের বিরোধিতা গতি লাভ করলে, ডঃ ইউনূস ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে তার শাসনের মেয়াদ শেষ করতে পারে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যের উপর নির্ভর করছে। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে ভুগা বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে শিল্প এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের প্রায় ৫৪ লক্ষ কর্মী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে কাজ হারাতে পারেন। তা উল্লেখ করা হয়েছে সরকারি সংস্থা এটুআই এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গবেষণার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক কাজী মুহাইমিন-উস-সাকিব জানান, তাঁদের আশঙ্কা যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে ২৭ লক্ষ, ফার্নিচার শিল্পে প্রায় ১৪ লক্ষ, কৃষিপণ্য ও পর্যটন শিল্পে প্রায় ১২ লক্ষ এবং চামড়া শিল্পের প্রায় ১ লক্ষ কর্মী চাকরি হারাতে পারেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ জানুয়ারী, ২০২৫-এ কার্যভার গ্রহণ করার পর বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পে ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতির প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক সেক্টর সহ বিশ্বব্যাপী শিল্পগুলি বাণিজ্য নীতি, শুল্ক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সম্ভাব্য প্রভাব পড়তে পারে৷ ট্রাম্পের প্রশাসন পোশাক খাতে অভ্যন্তরীণ উত্পাদন জোরদার করলে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে ট্রাম্পের "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতি থাকা সত্ত্বেও, টেক্সটাইলগুলিতে পুনঃস্থাপন সমস্ত ক্ষেত্রে অবিলম্বে বা সম্ভাব্য নাও হতে পারে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টরের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ দুটোই নিয়ে আসবে। চীনা পণ্যের উপর উচ্চ শুল্কের বৃদ্ধির সম্ভাবনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকে শক্তিশালী করতে পারে।

       

    লেখকঃ অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

কথা সাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত