প্রধানমন্ত্রীর জরিপে ইউপি নির্বাচনে আ. লীগের পরাজয়ের কারণ

  হাসান শান্তনু

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩:৫৯ |  আপডেট  : ২ মে ২০২৪, ০৫:৪৫

আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমেনি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তৃণমূলের মানুষের আস্থা বেড়েছে। সব বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নয়, অনেকেই পাবেন ‘সাধারণ ক্ষমা’।

সারাদেশে ধাপে ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবির কারণ চিহৃিত করতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতির কার্যালয়ের উদ্যেগে জরিপ পরিচালিত হয়। এতে দলের মনোনীত প্রার্থীদের পরাজয়ের বিভিন্ন কারণ উঠে এসেছে। একেক এলাকায় একেকরকম চিত্র। এলাকা ও অঞ্চলভিত্তিক আলাদা আলাদা কারণের কথা এসেছে জরিপে। সারাদেশে পরাজয়ের কারণ একই রকম নয়। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতির কার্যালয়ের সূত্র মত ও পথকে এসব তথ্য জানায়।

জরিপ বলছে, ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হলেও দলের জনপ্রিয়তা কমেনি। সরকারের কার্যক্রম, উন্নয়নের ধারাবাহিতা বজায় থাকা, করোনাভাইরাসের মতো দুর্যোগ মোকাবেলা ও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক পদক্ষেপে দলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। দুর্যোগকালে ও দীর্ঘদিন ধরে অন্যদলের নেতাদেরকে মাঠে না পাওয়ায় আওয়ামী লীগ ও দলটির প্রধান শেখ হাসিনার প্রতি তৃণমূলের মানুষের আস্থা আরো বেড়েছে।

তবে কয়েক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, নিজ সংসদীয় এলাকার সঙ্গে দুরত্ব, নিয়মিত যোগাযোগ না রাখার মতো বিষয় তাদের এলাকার ইউপি নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জরিপ অনুযায়ী দলের তৃণমূলে পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণে আলোচনা ও পরিকল্পনা চলছে। করোনাভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে এলে সেসব বাস্তবায়নে মাঠে নামবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। চলতি বছরের শেষদিকে দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজনের কথা রয়েছে। ওই সম্মেলনের আগেই তৃণমূলে কমিটি গঠন, বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে পরিচ্ছন্ন প্রার্থীদের পদে আনা, কোন্দল মেটানোর নির্দেশ আছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর তিন সদস্য মত ও পথকে জানান, ৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বিকেলে গণভবনে অনুষ্ঠিত সভাপতিমণ্ডলীর সভায় সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়, এখন করণীয় কী, দলের জনপ্রিয়তা ও আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে জনপ্রিয়তা আরো বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। দলের জনপ্রিয়তার বিষয়ে আমরা আস্থাশীল। সভায় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর তনয়া শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জনগণ আমাদেরকেই ভোট দেবে। আমরা দেশকে বদলে দিয়েছি। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। জনগণের ওপর আমাদের আস্থা আছে।’

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের দুজন নেতা জানান, দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে যেসব সংসদ সদস্য, শীর্ষনেতার জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার কথা এসেছে, তাঁরা আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। যাদের কোন্দলে ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বেশ কয়েকটি ইউপিতে যারা দলীয় নির্দেশ না মেনে বিদ্রোহী প্রার্থী হন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তাঁরা বলেন, সব বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। যেসব এলাকায় কোন্দল বেশি প্রকাশ্যে এসেছে, আগামী কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে তা মিটিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন দলীয়প্রধান। কোন্দলে জড়িত থাকলেও যাদের কর্মকাণ্ড সাংগঠনিক বিচারে ‘গুরুতর’ নয়, তাদেরকে কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে সতর্ক করা হবে। বেশিরভাগ নেতাকেই ‘সাধারণ ক্ষমা’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল।

কারণ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় ঐক্যের ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ইউপি নির্বাচনে দলের ভেতরের বিরোধ ও বিদ্রোহে জড়িত সবার বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্তে অটল থেকে ঐক্য ফেরানো সম্ভব নাও হতে পারে। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান এ প্রসঙ্গে মত ও পথকে মঙ্গলবার রাতে বলেন, ‘ইউপি নির্বাচন নিয়ে তারা আলোচনা করে দলীয় পদক্ষেপ নেবেন।’

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জরিপ মতে, দেশের অনেক ইউনিয়নে সঠিক প্রার্থী মনোনীত হয়নি। তৃণমূলকে পাশ কাটিয়ে বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে প্রার্থী মনোনীত করতে ভূমিকা রাখেন কেন্দ্রীয় কয়েক নেতা। ফলে সেখানে জয় আসেনি। কোথাও কোথাও দলীয় কোন্দলের জের ধরে সংঘর্ষ হয়, প্রার্থীও জয়ী হতে পারেননি। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও অনেক এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সরকার সমর্থকরা তা সেভাবে বিবেচনা করেননি। প্রার্থীদের এলাকায় ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান ভোটদাতাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।

এ ছাড়া রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি এবারের ইউপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেনি। বিএনপিসহ আরো কয়েকটি দলের আনুষ্ঠানিক প্রার্থী না থাকলেও দলগুলোর নেতারা নির্বাচনে অংশ নেন। তারা দলীয় প্রতীক না পাওয়া ও দলীয় প্রার্থী না হওয়ায় আওয়ামী লীগের অনেক ভোটদাতাও তাদেরকে ভোট দেন স্থানীয় সম্পর্ক ও পরিচিতি বিবেচনায়। এখানে কোন দলীয় প্রার্থী, তা বিবেচ্য ছিল না।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়া ঠেকাতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে কৌশল নেওয়া হয়। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দেশের অনেক ইউপিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর বিষয়ে চুপ থাকার কৌশল নেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সেসব এলাকায় বিদ্রোহী প্রার্থীরা ভোটে বিজয়ী হন। বিএনপি অংশ না নিলে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরেই এ কৌশল অবলম্বন করে আসছে। এবার জয়ী বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্রদের মধ্যে প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ মনে করেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে এলাকায় ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ কোথাও হারেনি। নির্বাচনে নেতৃত্বের যে প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে, সেটি সামনের স্থানীয় সম্মেলনে ঠিক হয়ে যাবে।’

জানা গেছে, সারাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দেড় হাজারের বেশি ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। নৌকা প্রতীক নিয়ে হারেন অন্তত দেড় হাজারের বেশি প্রার্থী। এবার মোট সাতধাপে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গত ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠদফা পর্যন্ত নির্বাচনের চিত্র উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর জরিপে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সবশেষ ও সপ্তমধাপের ভোট।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত