পদ্মায় স্রোতের প্রবাহ ঘুরছে, ভাঙ্গন চলছে জেগে ওঠা চরে

  কাজী সাব্বির আহমেদ দীপু, মুন্সীগঞ্জ

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২১, ১৫:২১ |  আপডেট  : ৯ মে ২০২৪, ০১:০৭

২০০২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ বছর একই রেখাচিত্রে পদ্মার পানি প্রবাহিত হলেও পরবর্তীতে পদ্মার স্রোতের প্রবাহ ঘুরতে শুরু করে। চলতি বছর পর্যন্ত গত ৬ বছরে পদ্মার স্রোতের প্রবাহ ঘুরছে। ফলে মাঝ পদ্মায় গত এক যুগ আগে জেগে ওঠা চর এবার ভাঙ্গতে শুরু করেছে। আর চরে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকায় ড্রেজিং অব্যাহত রাখলেও পলি অপসারন করে নাব্য সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে বিআইডব্লিটিএ ড্রেজিং বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অন্যদিকে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নাসার 'ভাঙনের আকৃতি' শীর্ষক প্রতিবেদনে গত তিন দশক ধরে পদ্মা তুলনামূলক সংকীর্ণ, সোজাসুজি অবস্থান পরিবর্তন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই নদীর গতিপথ আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০২ সালের দিকে পদ্মায় প্রচন্ড স্রোত দেখা দিয়েছিল। এরপর ২০১২-২০১৩ সালে পদ্মার খরস্রোতা রূপ রূদ্রমূর্তি ধারণ করে। দীর্ঘ একযুগের মধ্যে পদ্মায় এমন স্রোতের তীব্রতা মাওয়া ও শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় স্থায়ী ভাবে বসবাসরত মানুষও দেখেননি। সূত্র জানায়, ২০১২ সালের পর থেকে প্রতিবছরই মাওয়া প্রান্তের মূল পদ্মা রূদ্রমূর্তি ধারণ করে ভাঙ্গন তান্ডব চালাচ্ছে। পদ্মার ভাঙ্গনে কারনে ২০১৪ সালে কয়েকদফা ফেরিঘাট স্থানান্তর করতে হয়। সর্বশেষ গত বছর ২০২০ সালেও পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা ও শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় পদ্মার ভাঙ্গনে বিস্তীর্ন এলাকায় পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। এমনকি পদ্মা সেতুর রোড স্লাবসহ ব্যাপক এলাকা ভেঙ্গে নদী গর্ভে চলে যায়। আর এবার স্রোতের গতিপথ ঘুরতে থাকায় এখন মাঝপদ্মায় জেগে ওঠা চরে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। দীর্ঘ একযুগেরও বেশী সময় পরে চলতি মৌসুমে পদ্মায় স্রোতের তীব্রতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে বলে ঘাট সূত্র জানিয়েছে।

 

বিআইডব্লিটিএ, বিআইডব্লিটিসি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ ও নদী শাসন কাজ শুরুর পর থেকে পদ্মার স্রোতের প্রবাহ ঘুরতে শুরু করে। আর পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে, প্রাকৃতিক কারনে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহের গতিপথ ঘুরছে। ফলে চলতি আগষ্ট মাসের শুরু থেকে পদ্মা সেতুর ৩৪ নম্বর খুঁটির অদূরে মাদারীপুরের শিবচরের কারালী ও চরচন্দ্রা চরে পদ্মার ভাঙ্গন তান্ডব চলছে। গত কয়েক বছরে আরও কয়েকটি চরে ভাঙ্গন দেখা দিলেও নতুন করে আবার চরও জেগে উঠছে। 

স্থানীয় চরবাসী জানান, কয়েক বছর আগে পদ্মার মাঝে এই চর জেগে ওঠায় তা মাঝের চর নামে পরিচিতি পায়। গত কয়েকদিন ধরে মাদারীপুরের শিবচরের মাঝের চরের কারালী ও চরচন্দ্রা এলাকায় পদ্মার চলছে। প্রচন্ড স্রোতের তোড়ে বিস্তীর্ন এলাকা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। চরে বসবাস করা আউয়াল মিয়া জানান, কারালী এলাকায় পদ্মা সেতুর ড্রেজিংয়ের বালু রাখার ব্লক-৩ ও চরচন্দ্রায় ব্লক-৬ এলাকায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ড্রেজিংয়ের বালু রাখার জন্য ওই চর এলাকা পদ্মা সেতুর প্রকল্পের অধিগ্রহণ করা হয় বলে জানা গেছে।

এ প্রসঙ্গে পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো আব্দুল কাদের জানান, পদ্মার মাঝে জেগে ওঠা এই চর প্রতিবছরই ভাঙ্গন হয়। আর এ ভাঙ্গন পদ্মা সেতুর জন্য ক্ষতিকারক নয়। খরস্রোতা পদ্মা এরকমই। এসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখেই ডায়ানামিক নকশায়।

বিআইডব্লিটিএ'র ড্রেজিং বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান জানান, গত ৬ বছর ধরে প্রতিবছরই ৩৩ থেকে ৩৬ লাখ ঘনমিটার বালু অপসারন করতে হচ্ছে। কিন্তু চলতি মৌসুমে পদ্মার স্রোতের তীব্রতা মারাত্বক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্রোতের প্রবাহ ঘুরছে। ফলে ঘূর্নায়মান স্রোতের কারনে একাধিক স্থানে পলি মাটি জমথে থাকায় নাব্য সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। 

তিন দশক ধরে পদ্মা অবস্থান পরিবর্তন, এখন গতিপথ আঁকাবাঁকা
যুক্তরাষ্ট্রের নাসার বিজ্ঞানীরা ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে পদ্মার প্রস্থ, গভীরতা, গঠন এবং সামগ্রিক আকারের পার্থক্য তুলে ধরে ৬৭ বছরে পদ্মা নদীর ভাঙ্গন পরিমাপ ও তার তথ্য উল্লেখ করেছে। তাতে বলা হয়, ৫১ বছরে ৬৬ হাজার হেক্টর জমি বা ২৫৬ বর্গমাইল খরস্রোতা পদ্মায় বিলীন হয়েছে। 

নাসার প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন দশক পদ্মা তুলনামূলক সংকীর্ণ, সোজাসুজি অবস্থান পরিবর্তন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই নদীর গতিপথ আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে নদীর রেখাচিত্র তীব্র ভাবে বেঁকে যায়। বক্ররেখাটি ৯২ সাল থেকে বিকশিত হতে শুরু করে। তবে ২০০২ সালে এই রেখার পতন শুরু হয় এবং এরপর বক্ররেখাটি অদৃশ্য হয়ে যায়।

নাসার 'ভাঙনের আকৃতি' শীর্ষক প্রতিবেদনে স্যাটেলাইটের ছবিগুলোর সঙ্গে ১৯৮৮ সাল থেকে পদ্মার আকৃতি এবং প্রস্থের পরিবর্তন গুলো তুলনা করা হয়। ১৯৫০ সালে ভুমিকম্পের ফলে ভূমিধসের অবশিষ্টাংশ বলে গবেষকরা মনে করেন। ছবিগুলো তোলা হয়েছে নাসার ল্যান্ডস্যাট স্যাটেলাইট থেকে শুস্ক মৌসুম অর্থাৎ জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, বহু বছর ধরে গবেষকরা নদীর বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করেছেন। এক তত্ত¡মতে, নদীর নিচে পলি বিভিন্ন উৎস থেকে আসতে পারে। কিছু পলি ১৯৫০ সালে ভূমিকম্পের ফলে ভূমিধসের অবশিষ্টাংশ। গবেষকরা মনে করেন, বালির মতো এসব ক্ষুদ্র উপাদান নদীর মধ্য দিয়ে অর্ধ শতাব্দী ধরে সৃষ্টি হয়েছে। খবরে জানানো হয়, পদ্মার তীব্র ভাঙনের দুটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, এই নদী যেন মুক্তভাবে প্রবাহিত হতে পারে তা সুরক্ষার তেমন ব্যবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত, নদীর তীরে একটি বড় বালুচর রয়েছে, যা দ্রুতই ভাঙতে পারে।

২০১৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নাসার 'ভাঙনের আকৃতি' শীর্ষক প্রতিবেদন এক দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা এবং নদীভাঙনের ফলে এ স্থাপনায় কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, সে দিকটিও উঠে এসেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে নদীর ভাঙন কিছু অঞ্চলে হুমকি সৃষ্টি করতে পারে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও অনেক গবেষক ভিন্নমত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে জমি প্রকৃতপক্ষে স্থির হতে পারে এবং এটি শেষ হওয়ার পর নদীভাঙন হ্রাস পেতে পারে। প্রতিবেদনের শেষে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পদ্মার ভাঙনের হার প্রকৃতপক্ষে হ্রাস পেয়েছে। নদী বক্ররেখার পরিবর্তে জমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, এলাকাটি ভাঙন থেকে মুক্ত।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত