পর্ব – ১|ঃসংকোচের বিহ্বলতা

তিতুমীর কলেজ আমার অবহেলার বিদ্যাপীঠ

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৩৫ |  আপডেট  : ২ মে ২০২৪, ১০:০৬

তিতুমীর কলেজে পড়াকালীন আমি

ঝর্না রহমান
------------

‘সরকারী তিতুমীর কলেজ’-এ আমার উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। ১৯৭৫-৭৬ এই দু’ বছর এ-কলেজে আমি পড়াশোনা করি। তিতুমীর কলেজ ঢাকা শহরের স্বনামধন্য এক প্রাচীন কলেজ। ঢাকা শহরের মহাখালি এলাকায় মহাখালি-গুলশান-বনানী মেইন রোডে ওয়ারলেস-গেইটের কাছাকাছি (বীরোত্তম একে খন্দকার রোড, মহাখালি) কলেজটি অবস্থিত। ১৯৬৮ সনে এ কলেজ ‘জিন্নাহ কলেজ’ নামে একটি উচ্চমাধ্যমিক কলেজ হিসেবে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। তারও আগে জিন্নাহ কলেজের এ ভবন ছিল ডিআইটি খাদ্যগুদাম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান জগন্নাথ কলেজের ছাত্র আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য ঐ কলেজের ডিগ্রি শাখাটিকে সরিয়ে ডিআইটি খাদ্যগুদামে নিয়ে আসেন আর তার নামকরণ করেন জিন্নাহ কলেজ। একাত্তরের ১লা মার্চ সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ স্থগিত ঘোষণা করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ হিসেবে জিন্নাহ কলেজের ছাত্রসংসদের নেতৃবৃন্দ (সিরাজউদ্দৌলা, টিপু মুনশি, শাহাবুদ্দিন, আনিসুজ্জামান খোকন প্রমুখ)‘ জিন্নাহ কলেজ’ সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলেন আর জিন্নাহ সাহেবের নাম বদলে কলেজের নামকরণ করেন ‘তিতুমীর কলেজ’।*১
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের ঘটনাবলির সাক্ষী এই কলেজটিতে আমি দুবছর পড়াশোনা করে ১৯৭৬ সনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে পাস করি। এ-কলেজের একজন প্রাক্তন ছাত্রী হিসেবে আমি সত্যিই গর্বিত। কিন্তু দুটি বছরের ৭০০রও বেশি দিন অতিবাহিত-করা এই কলেজটি ছিলো আমার শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে অবহেলিত প্রাঙ্গণ। আমি এ কলেজের ক্লাসরুম বারান্দা কমনরুম অফিসরুম ছাড়া তেমন কোনো প্রাঙ্গণের সাথে পরিচিতি হইনি। ‘সরকারী তিতুমীর কলেজ’ নামাঙ্কিত বিশাল ফটক পেরিয়ে আমি ঢুকতাম, ফটকের পরেই প্রশস্ত মাঠ। মাঠের মাঝখানটা চিরে চলে গেছে বাঁধানো রাস্তা। আমি কোনোমতে সে রাস্তাটুকু পেরিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়তাম। তারপর এক-দুই-তিন করে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে আমাদের ক্লাসরুমে ঢুকে যেতাম। সারাদিন কলেজ জুড়ে নানারকম কর্মযজ্ঞ চলতো, তার কোনো কিছুই আমি দেখতাম না, অংশগ্রহণ তো দূরের কথা! মাঝে মাঝে ‘অফ পিরিয়ড’ থাকতো। সে সময়টা ছিল আমার সবচেয়ে ‘করুণ’ সময়। তখন ক্লাসের ভেতরে থাকা যেতো না। কারণ ক্লাসে তখন অন্য সাবজেক্টের ক্লাস হত, যেটা আমার নেই। সে সময়টায় আমি নিজেকে কোথায় লুকোবো ভেবে পেতাম না। কোনোমতে ক্লাসরুমের বাইরে এসে বারান্দায় একটা পিলারের পাশে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। আমার চারপাশ দিয়ে বয়ে যেত তারুণ্যভরা উন্মুখর জীবন। সামনে দিয়ে চলে যেতো হাসিখুশিভরা গল্পে মশগুল ছাত্রছাত্রীরা। বুকে চক ডাস্টার বই নাম রেজিস্টার খাতা চেপে বারান্দা দিয়ে আসাযাওয়া করতেন শিক্ষকেরা। তাঁরা দেখতেন একটি প্রথম বর্ষে পড়ুয়া ষোল-সতর বছরের কুণ্ঠিত কিশোরী জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার লাজুক মুখে অপরাধী ভঙ্গি, চোখে ভীত চাউনি, সারা অবয়বে সংকোচ। সেই কিশোরী-আমিটি মনে করতাম সবাই বুঝি আমাকেই দেখছে। আমাকেও না দেখছে আমার পেটটাকে! কারণ আমি ছিলাম অন্তঃসত্ত্বা।

১৯৭৪ সনে আমি যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী, তখনই আমি অন্তঃসত্ত্বা। স্কুলে থাকতেই, ১৯৭৩ সনে, দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পরে মেয়েরা মা হবে এটাই তো ধর্ম, কাজেই যথানিয়মে এসএসসি পরীক্ষার আগেই আমার গর্ভসঞ্চার হলো। চরম খারাপ শরীর নিয়ে আমি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। আমার আম্মা আমাকে চালতার ডাল আর পিঁয়াজ-শুকনো মরিচ ভাজা হাতে ডলে সরষের তেলে মেখে ভর্তা বানিয়ে দু নলা গরম ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিয়ে বলতেন, যা মা ঝর্না, ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে আয়! আর বমি হবে না! আল্লাহ আছেন। দেখবি, আমার নাতিনাতনী যা-ই হয় ওর ব্রেন হবে খুব ভালো। কারণ ওকে পেটে নিয়ে তুই জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষাটা দিচ্ছিস। আমি আসলে তখন একই সঙ্গে জীবনের কয়েকটা বড় পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। পরীক্ষা-হলে খাতায় লিখতে লিখতে শরীরে নানারকম অনুভ’তি হতো। সে-সব সয়ে নিতে গিয়ে মাঝে মাঝে মনে হত, পেটের ভেতর থেকে বাচ্চাটা বুঝি সত্যিই লেখাপড়া শিখে যাচ্ছে! (অবশ্য আমার সন্তানেরা সত্যিই খুব মেধাবী, হয় তো সত্যিই গর্ভগৃহে বসে মায়ের লেখাপড়া শুনে শুনে ওদের হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল!!)

যাই হোক, যখন তিতুমীর কলেজে ভর্তি হলাম তখন আমি সাত কি আট মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। যদিও হালকাপাতলা গঠন এবং কিছুটা দীর্ঘাঙ্গী অবয়বের কারণে আমার পেটের উচ্চতা বাইরে থেকে অতটা বোঝা যেত না, তা ছাড়া আমার পোশাকও শাড়ি, সে কারণেও গর্ভ বলতে গেলে অদৃশ্যই থাকে, তবুও কিশোরী আমি প্রতিদিন আমার পেটের স্ফীতি দেখে ভয় পেতাম। মনে হতো, রোজই আমার পেট গম্বুজের মত উঁচু হয়ে উঠছে। একদিন হয়তো বাচ্চা হবার আগেই শাড়ি ফেটে এই গম্বুজ সবার চোখের সামনে বেরিয়ে আসবে! সেই দুশ্চিন্তায় আর লজ্জায় সংকোচে আমি এতটুকু হয়ে থাকতাম। কলেজে ঢুকে তাই নিজেকে আড়াল রাখার এক দুর্মর প্রচেষ্টা চলতো। ক্লাসরুম ছাড়া পারতপক্ষে কোথাও বেরুতাম না। খুব কম ঢুকেছি কমনরুমে। কারণ কমনরুমকে মনে হতো ছাত্রছাত্রীদের মেলা! অফিসরুমে গেলে মনে হতো কর্মকর্তা কর্মচারি পিওন চাপরাশি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এই মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে? বাচ্চা পেটে? ইয়াল্লাহ! যদিও আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশে স্কুল-বালিকাদের বিয়ে হয়ে যাওয়া তেমন অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না, তারপরেও আমি লজ্জা পেতাম। নিজেকে মনে হত অপরাধী। ফলে তিতুমীর কলেজে আমি আমার ক্লাসরুম ছাড়া বলতে গেলে কিছুই চিনলাম না। আমি বলতে পারবো না আমাদের কলেজের কোন ভবনের কোনখানে কী কক্ষ ছিলো, কোথায় ছিলো লাইব্রেরি, কোথায় গবেষণাগার, কোথায় বসতেন শিক্ষকেরা, কোথায় ছাত্রছাত্রীরা নাটকের রিহার্সাল করতো বা অফ পিরিয়ডে জমিয়ে তুলতো আড্ডা বা গানের আসর। তখন আমি শুধু চোরের মত নিঃশব্দে নিজের দেহটি ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে ফেলি, মন দিয়ে স্যার ম্যাডামদের পড়ানো শুনি, টিফিন পিরিয়ডে ক্লাসরুমে বসেই বাসা থেকে-নেয়া টিফিন টুকটুক করে খাই, বেশি হলে আমার সহপাঠিনীদের সাথে গল্প করি। তবে তাও মেয়েদের সাথে। আমি যে-স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, সেটি ছিল মেয়েদের স্কুল। তিতুমীর কলেজের সাথেই ছিল সে স্কুল। আদর্শ গার্লস হাই স্কুল। আদর্শ স্কুলের কয়েকজন সহপাঠিনী আমার সাথে তিতুমীর কলেজে ভর্তি হয়েছিল। ওদের মধ্যে ছিল পারভিন, মঞ্জু, মেনকা, আমেনা, রিনা আরও দু একজন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমার বান্ধবীরা অনেকদিন জানতো না, আমি অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু আমি তো জানতাম! এই জানাটা আমাকে প্রতিদিন সংকুচিত করে তুলছিল। আমার গর্ভের স্ফীতি বাড়ছিল আর আমার মন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছিল। এই সংকোচের বিহ্বলতায় পড়ে তিতুমীর কলেজ রোজ একটু একটু করে হারিয়ে যেতে লাগলো। দূরে সরে যেতে লাগলো। পরীক্ষার আগ-পর্যন্ত ‘কলেজ’ হিসেবে আমার সামনে রইলো একটি গেট, প্রবেশপথ, কয়েক ধাপ সিঁড়ি আর একটি প্রশস্ত ক্লাসরুম! 
                                                                                                                             (চলবে)

তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া
ছবি পরিচিতি: ১. সরকারী তিতুমীর কলেজ (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
                    ২. তিতুমীর কলেজে পড়াকালীন আমি। 

ঝর্না রহমান

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত