তান্ত্রিকতার শতভাগই ভুয়া, অথচ টিকে আছে!  

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৩৮ |  আপডেট  : ১ মে ২০২৪, ১৬:০১

মুজিব রহমান
 ---------------------
 
পৃথিবীতে তান্ত্রিকতার বিপুল চর্চা হলেও তার পুরোটাই নিস্ফল। এতো ব্যর্থতার পরেও এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় তান্ত্রিকতার চর্চা হয়। তন্ত্র হল ভারতবর্ষে প্রচলিত এক বিশেষ ধরনের সাধনা পদ্ধতি বা উপাসনা। একে গুহ্য সাধনাও বলে। ইউরোপেও একসময় এমন সাধনা প্রচলিত ছিল। ধারণা করা হতো বৃদ্ধা নারীরা এমন সাধনা করে। তাদের ডাইনী আখ্যা দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। অথচ এসব নারীদের কারোই কোন প্রকৃত ডাকিনীশক্তি ছিল না। বিক্রমপুরের অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে যাওয়ার আগে ওখানেও তান্ত্রিকতার চর্চা ছিল ব্যাপকভাবে। তিনি তা থেকে ফেরান। তবে অতীশ দীপঙ্কর নিজেও একসময় তান্ত্রিক ছিলেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের এই অংশটির প্রভাব বিক্রমপুরেও ছিল। অতীশের জন্ম গ্রামের নাম বজ্রযোগিনী থেকেও তা উপলব্ধি হয়। জাপানের শিন্টো ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও এমন মতাদর্শ ছিল। বেশ কয়েকবছর আগে এক জাপানি তান্ত্রিক ওম শিনরিকিও সারিন গ্যাস প্রয়োগে বহুজনকে একসাথে হত্যা ও হাজার হাজার মানুষকে আহত করেছিল। আফ্রিকার ফুটবল দল বিশ্বকাপে উঠলে মাঠে তান্ত্রিক গুরুরা তাদের কাজ শুরু করে দেয়। তারা আগুন জ্বালিয়ে বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে সাধনা শুরু করে কিন্তু তাতে প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। ভারতে হিন্দু-বৌদ্ধ ছাড়াও জৈন ধর্মে তান্ত্রিকতার চর্চা হতো। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জ্বীনকে ব্যবহার করে ক্ষমতাবান হওয়ার চর্চা রয়েছে। কুফরি কালাম চর্চা ও কুফরি নকশার মাধ্যমে শত্রুকে নিধন ও বশিকরণ করার চর্চার কথাও শোনা যায়। যদিও এমন ক্ষমতা বাস্তবে কেউ দেখাতে পারেনি। 

ঠাটারি বাজারে কয়েক বছর আগে ঘটনাটা শুনেছিলাম। ওখানকার এক সদ্যজাত শিশু মারা গেলে তাকে পোস্তগোলা শ্মশানে সমাধীস্থ করা হয়। ওই আমাবশ্যার রাতেই কয়েক কিশোর শিশুটিকে উঠিয়ে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে লাল রঙ মেখে তন্ত্র সাধনা শুরু করে। তারা মনে করেছিল এমন সাধনা সমাপ্ত করতে পারলে অলৌকিক শক্তিধর হতে পারবে। কিন্তু স্থানীয় মানুষ বিষয়টি দেখে পুলিশে খবর দেয়। আর পুলিশ এসে ওদের গ্রেফতার করে। হিন্দু ধর্মে শৈব ও বৈষ্ণবদের মধ্যেই সাধারণত তান্ত্রিক চর্চা করতে দেখা যায়। বৈষ্ণবদের মধ্যে কিশোরীভজনার মাধ্যমেও তান্ত্রিক চর্চা করা হতো। শৈবদের দেবী ছিন্নমস্তা ও কালির অনুসারীরা সাধারণত তান্ত্রিক চর্চা করে। 

 

আমাদের কিশোর বয়সে হঠাৎ শুনলাম এক তান্ত্রিক কালি-সাধক এলাকায় এসেছে যে মানুষের মাথার খুলিতে ভাত খায়। আমাদের ক্লাবের তরুণরা ধরে নিয়ে আসল। বিস্মিত হয়ে জানলাম সে মুসলিম কিন্তু কালি সাধক! ক্লাবে ঢুকিয়ে নির্মমভাবে তার গোফ ও চুল ছেটে দেয়ার জন্য কাচি বের করা হল। একজন কাচি ধরা মাত্র সে শরীর কাঁপিয়ে আতঙ্ক তৈরি করতে চাইল। বিরবির করে মন্ত্র পড়তে লাগল। কিছুক্ষণ এমনটা করার পরে সে একটু ক্লান্ত হলে- তার গোফ ও চুল ছেটে দিয়ে, সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে, গেরুয়া ফেলে দিয়ে লুঙ্গি ফতুয়া পরিয়ে, খাইয়ে বিদায় দেয়া হয়। তার তন্ত্র-ফন্ত্র বিফলে গেল। তিনি ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে চলে গেলেন। কদিন পরে একজন এসে বলল ওই লোক আবারো কালি-সাধনা শুরু করেছে। যদিও আজ ওই কাণ্ড করায় অপরাধ করেছি বলেই স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করছি।

ভারতবর্ষে এখনো কামরূপ-কামাক্ষ্যায় ব্যাপক হারেই তন্ত্রসাধনা চলে। সেখানে স্ত্রী লিংগ (যোনী) এর পূজাও হয় ওই তন্ত্র সাধনার অংশ হিসেবেই। তান্ত্রিক সাধনায় যৌনতার গুরুত্ব রয়েছে। আমাবশ্যা ও পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, মধ্যদুপুর, মধ্যরাতও গুরুত্বপূর্ণ সময়। ছিন্নমস্তা দেবিকে দেখি সঙ্গমরত যুগলের উপরে দাঁড়িয়ে নিজের মস্তক ছিন্ন করে গলা দিয়ে ত্রিধারায় উদগীরণ হওয়া রক্ত নিজে পান করছে ও দুই শিষ্যকে পান করাচ্ছে। এমন প্রতিমাকে ছিন্নমস্তার অনুসারীরা পূজা করে। চণ্ডী, কালী, তারা, বাসুলী, শিবানী, জগদ্ধাত্রী সাধকরাও নানা রকমের তান্ত্রিক আরাধনা করে। তান্ত্রিকদের সকলেই দেবীর উপাসক, দেবতার নয়। তান্ত্রিকরা ধারণা করে শিবের শক্তির উৎস হল কালী। পুরুষও শক্তি অর্জন করে নারীর কাছ থেকে। তান্ত্রিকদের মূল লক্ষ্যই হল শিবত্ব লাভ করা তথা শক্তিমান হওয়া। কেউ আমাবশ্য বা পূর্ণিমা রাতে মৃতদেহের উপর বসে ধ্যান করে, কেউ শত খুন করে বা কেউ শত ধর্ষণ করে তান্ত্রিক শক্তি অর্জন করতে চায়। জাদুকরি ক্ষমতা ও সিদ্ধি লাভের জন্য তান্ত্রিকরা এমনটা করলেও তাদের সফলতার কোন নজির দেখা যায় নি। তবুও হাজার হাজার বছর ধরে ভারতে এমন চর্চা চলে আসছে। গুরু শিষ্যকে এমন বিদ্যা শিক্ষা দিতে চায় আবার সেই শিক্ষায় শিষ্য পূর্ণতা পেলে গুরুও পূর্ণতা পাবে। অনেক গুরুই নিজেকে তান্ত্রিক ক্ষমতা ও সিদ্ধিলাভ করেছে ঘোষণা দিলেও তা নিতান্তই মিথ্যাচার। এই শিষ্যও আবার মিথ্যা ঘোষণা দিয়েই গুরু হয়ে উঠে এবং শিষ্যদের নতুন নতুন চর্চার মাধ্যমে সিদ্ধি লাভের আশায় ঠেলে দেয় তান্ত্রিক সাধনায়। গুরুরা দাবি করে, তন্ত্র হল অসীম জ্ঞানের আধার যা কিছু কঠোর সাধনায় লাভ হয়, সিদ্ধিলাভে জ্ঞানচক্ষুও উন্মোচিত হয়। গুরুদের দাবি- তারা ঘরে বসেই বহু দূরকে দেখতে পায়, ভবিষ্যতও দেখতে পায়।

আর্যরা তন্ত্র চর্চা করতেন না, এটা অনার্যরাই করতেন। এখনো দেখা যায় অনার্য দেবীদের অনুসারীরাই তন্ত্র সাধনা করে। ফলে এখনো যারা এসব চর্চা করে তারা সাধারণত দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের মানুষ। তন্ত্র সাধনা করার নামে কিছু সফল প্রতারণার ঘটনা ঘটাতে পারলেও তারা কেউই প্রকৃত তান্ত্রিক হতে পারেননি। অন্তত দুই হাজার বছরে কোন ফল না-পাওয়ার পরেও কেন এখনও তন্ত্র সাধনা করা হয়? বিষয়টা পৃথিবীর দিকে তাকালে স্বাভাবিকই মনে হবে। ৪৩০০টি ধর্মের মধ্যে কেবল আপনার ধর্মটিই সত্য। কিন্তু বাকি ৪২৯৯ টি ধর্ম-বিশ্বাসীরা শত শত বা হাজার হাজার বছর ধরেই তাদের ধর্ম গভীরভাবেই বিশ্বাস করে আসছে। অথচ আপনি নিশ্চিত যে, ওই ধর্মগুলো ভুল। তাহলে কেন তারা বিশ্বাস করে আছে? ঠিক একই কারণেই তন্ত্র সাধনাও নিছকই মিথ্যাচারে ঠাসা থাকলেও অন্ধ বিশ্বাসের কারণেই টিকে আছে।

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত