জিম সিয়াং বম 

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:০৫ |  আপডেট  : ২ মে ২০২৪, ১৪:৫৪

কাওসার পলাশ
----------------- 

১৯৮৭ সালের জুলাই মাস, পুরো সাপ্তাহ জুড়েই হালকা হালকা বৃষ্টি চলছিলো। রোদ বৃষ্টি যাই হোক প্রতিদিনের খাবার সংগ্রহ করাই লাগবে। পাহাড়িরা আমাদের মতো করে কালকের কিংবা ভবিষ্যতের চিন্তা কখনোই করে না। প্রকৃতি থেকে তারা প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন যা খুঁজে পায় তা দিয়েই চালিয়ে দেয়। রুমা উপজেলার অত্যন্ত গহীনে রুমানা পাড়া নামক একটি গ্রামে বসবাস করতো ১৩-১৪ বছরের এক কিশোরী মেয়ে। তার নাম ছিলো "জিম সিয়াং বম"। পরিবারের ৪ ভাই বোনের মধ্যে সে ছিলো সবার বড়। পাহাড়দের মধ্যে যুগ যুগ ধরেই বড়দের দায়িত্ব সব থেকে বেশি, ফলে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই জিম সিয়াং চলে গেলেন পরিবারের সকলের খাবারের সন্ধানে। রুমানা পাড়ার থেকে আধাঘণ্টা হেঁটে রুমা খালের উৎস মুখের নিচের ঝিরিপথে তখন প্রচুর শামুক পাওয়া যেতো। উল্লেখ্য যে, পাহাড়িরা শামুক সিদ্ধ করে   সবজি কিংবা তরকারির মতো কোন কিছু দিয়ে রান্না করে খেয়ে জীবন যাপন করে।
 
ঝিরিপথের উৎস মুখে পরপর ৩ টা স্টেপে অনেক বড় বড় ঝর্ণা আছে। প্রতিটি ঝর্ণার উচ্চতা প্রায় ৬০-৭০ ফুট উঁচু। অনেক উপর থেকে পানি নিচের দিকে আঁচড়ে পড়ার কারণে নিচে গভীর খাদ বা গর্ত তৈরি হয়। বর্ষার মৌসুমে বিভিন্ন পাহাড় থেকে পানির সাথে শামুক এসে ঝর্ণার এই গর্তগুলোতে জমা হয়ে থাকে। জিম সিয়াং বাসা থেকে বের হলো খুব সকালে। বেলা গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল কিন্তু তাও জিম সিয়াং তখনো বাসায় ফিরে আসেনি। এদিকে জিম সিয়াং এর মা বাবাও প্রতিদিনের মতো জুম থেকে ফিরে আসলো। শেষ বিকালেও সে বাসায় ফিরে না আসায় পরিবারের সবার কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট হতে লাগলো। ইতিমধ্যেই পাড়ার লোকজন সবার কানে এই সংবাদ পৌঁছে গেলো। পাড়ার লোকজন সবাই জুম চাষ থেকে ফিরে আসলো কিন্তু একমাত্র জিম সিয়াং তখনো ফিরে আসেনি!

পাড়ার প্রতিটি মানুষের মধ্যেই একটা অজানা আতংক ভয় ছড়িয়ে পড়লো! জিম সিয়াং এর খোঁজে দলবদ্ধ ভাবে পাড়ার সকল লোকজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সন্ধ্যার অনেক পরে একজন এসে জানালো সর্বনাশ হয়ে গেছে! জিম সিয়াং বমকে পাওয়া গেছে কিন্তু জীবিত নয় মৃত!! ঝর্ণার ২য় স্টেপের গর্তে জিম সিয়াং এর মৃতদেহ দেখতে পাওয়া যায়। খবর শুনে পাড়ার বাকী নারী পুরুষ সহ সকল মানুষ চলে যান সেখানে। পাড়াবাসী অত্যন্ত হৃদয়বিদারক এক ঘটনার সাক্ষী হলো। প্রথম ধাপ থেকে ২য় ধাপে যাওয়াটা অনেক ভয়ংকর ছিলো। এমনেই বৃষ্টির মৌসুম তারমধ্যে আবার রাত হয়ে যাওয়াতে, সেটা যেনো একটা স্রেফ ভয়ংকর মৃত্যুকৃপে পরিনত হয়েছিলো।

গ্রামের প্রতিটি মানুষের নিরলস কঠোর প্রচেষ্টায় সেদিন রাতেই আমার বোনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল কিন্তু আমি তখনো কিছুই জানি না।পরদিন দুপুরের দিকে রুমা বাজারে এক লোকের মারফত আমি এই খবর জানতে পাইলাম। আমার নাম "নল বম", আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। রুমা বাজারেই থাকতাম আমি। দিদি আমার থেকে এক বছরের বড়। খবর পেয়েই পাগলের মতো করে বাড়ির পথ ধরলাম, বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কোন রকমে দিদির খণ্ডবিখণ্ড চেহারাটা শেষ বারের মতো এক্টু দেখতে পাইছিলাম।--দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সহজ সরল মানুষটা  করুণ গল্পটা শেষ করে ফেললেন।
 
একটা বড় নিশ্বাস ফেলে আবার বলতে লাগলেন " সেই দিনের পর থেকেই এই ঝর্ণার নাম হয় জিম সিয়াং সাইতার। তবে আমিও অনেকদিন গাইডের দায়িত্ব পালন করছিলাম। বয়স বাড়লে বাদ দিয়ে দিলাম, মাইনুল, নিজাম এরা আমাকে খুব ভালো করে চিনে। আমরাও রুমানা পাড়া ছেড়ে দিয়ে এখন পুনুম পাড়ায় চলে আসছি। এখন জুমে কাজ করি, দাদা। যান দাদারা ঘুরে আসেন, এখন নিচেরটায় নামার রাস্তা নাই, এক্টু সাবধানে যাবেন "। কথাগুলো বলে নলদা বিদায় নিলেন, আমরাও হাঁটা ধরলাম জিম সিয়াং সাইতারের দিকে। অত্যন্ত দুর্গম হওয়াতে ফেরার পথ ধরতে আমাদের বিকাল হয়ে গেলো। ফেরার পথে আবার দেখা হলো নল দাদার সাথে, অত্যন্ত চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললেন ‘কেমন লাগলো?’ বললাম, দাদা অনেক সুন্দর। আমি দাদার হাতে কিছু বিস্কুট আর চকোলেট ধরিয়ে দিলে দাদা আরো একটা হাসি উপহার দিয়ে আমাদেরকে বিদায় জানাল।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত