ছোটগল্প: ঘ্রাণ

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ১ আগস্ট ২০২১, ১০:২৩ |  আপডেট  : ২১ মার্চ ২০২৪, ১৬:১০

নাসির খান
----------------------

-আজকের রাতের আঁধার একটু বেশিই কালো। এক ফুট দূরের কিছু দেখা যায় না এমন। আঁধারকে আমার সবসময় বড় ভয় হয়। মনে হয় এই বুঝি অন্ধকার ফুঁড়ে এইসব অন্ধকারের দৈত্যের মতো দাঁত বের হবে। তারপর রোগা লিকলিকে হাড্ডিসার শরীরের শফিক নামের এই আমাকে কামড়ে খেতে থাকবে। 
যাদের মনে সুখের বসবাস কম, যাদের জীবন বলতে কেবল সকাল সন্ধ্যা কাজ আর রাতের বেলা এক বেডে তিনজনের ঘুম, তাদের সম্ভবত ভয় বেশি থাকে।
অন্ধকারকেও তাদের পাড়ার কালো রঙের পাগলা কুকুর মনে হয়।
দু'মাস পর বাড়ি যাচ্ছি। বাস থেকে নেমে কোনো ভ্যান না পেয়ে হেঁটে যাচ্ছি। রাত বারোটায় আমাদের গ্রামে সবার একঘুম হয়ে যায়। 
আমি ফুরফুরে বাতাসে অন্ধকারে হাঁটছি। নাকে কেমন এক গন্ধ আসছে। হাহাকার মাখা এক গন্ধ। গন্ধে কখনো হাহাকার মেশানো থাকে কি? নাকি দুই মাস পর কেউ গ্রামে এলে এমন গন্ধ আসে নাকে?
মিজান ভাইয়ের বাড়ির কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম। বাইরবাড়িতে কতগুলো হ্যারিকেন জ্বলছে। কত লোকজন। গাজীর গান হচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম। টাকা উঠানো হচ্ছিলো। আমাকে দেখেই কেউ একজন চেঁচিয়ে আমার নাম বলে দিলো। গাতক আমার নাম নিয়ে মজা করে করে গান গাইতে লাগলো। সবাই হাহা করে হেসে উঠলো।
আমার কেন জানি লজ্জা লাগতে লাগলো। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে চুপ করে বেড়িয়ে এলাম।
রমজানের মায়ের পাটখড়ির ভাঙা ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে খেঁকিয়ে উঠলো- ক্যাডা যায়? রমজান?  ও রমজান?
আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম-
: খালা আমি। শফিক। রমজান কই?
: জুয়া খ্যালতে গ্যাছে।
: আপনার শরীর কেমন?
: হাত পা পইড়া গ্যাছে বিছনায়। রমজান একটা শুয়ার। রমজানের বউ একটা বেশ্যামাগী।
: খালা যাই। সকালে একবার আসবো।
বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। আমার পিলে চমকে উঠলো। মা ঘর থেকেই চেঁচিয়ে উঠলো- থাম। ও টম থাম।
আমাদের জরাজীর্ণ সংসার। সেখানে একটি কুকুর পোষা হয়। সেই কুকুরের নাম আবার টম। কুকুরটা মাদী কুকুর। অথচ নাম টম।  হয়তো কুকুরদের জেন্ডার নিয়ে ভাবার সময় বা গুরুত্ব থাকে না গরিবদের!
আমি বারান্দায় এসে বললাম, মা আমি আমি শফিক। ও মা দরজা খোলো।
মা দরজা খোলার আগেই দরজা খুলে পারুল বের হলো পাশের ঘর থেকে। আমাকে না দেখেই হুড়মুড় করে ঘরে গিয়ে হারিকেন জ্বালালো। হাতে হারিকেন নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো পারুল। মাও বের হয়ে এলো।
পারুলকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিলো। মা আসার কারণে ওর দিকে তাকালাম না। এমন ভাব করলাম যেন পারুল কিছুই না। মাই আসল। বললাম-
: মা আছো কেমন?
: বাতের ব্যথা বাড়ছে। খাইতে পারি না গলা বুক জ্বলে। আর ঘুম হয় না।
মা এমনভাবে বলতে লাগলো যেন আমি বড় কোনো ডাক্তার। এই এখনই মাকে ওষুধ লিখে দেবো।
মায়ের ঘরে গিয়ে মায়ের হাতে পাঁচশ টাকার নোট গুঁজে দিলাম। মাকে শান্ত রাখার এরচেয়ে বড় কোনো টনিক আমার কাছে নাই।
ঘরে আসলাম। পারুল এত রোগা হয়েছে। একদম শুকনা। দেখলে একটুও শরীর জাগে না এমন। গায়ে রঙ ওঠা পুরাতন সুতি কাপড়। দেখে মনে হচ্ছে আমার থেকে বয়স বেশি। 
: পারুল কেমন আছো?
: আপনে কেমন আছেন?
: ভালো আছি। আমাকে মনে পড়ে খুব পারুল?
পারুল পাতিলে ঝনঝন শব্দে চাল ঢালতে লাগলো। আমি এগিয়ে গিয়ে একটু ভালোবাসা নিয়ে হাত দিয়ে ওর মুখটা আমার দিকে নিলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। পারুল কাঁদছে। আমার এত খারাপ লাগতে লাগলো।  মেয়েরা তার স্বামীর জন্য এত মমতা এত ভালোবাসা কীভাবে জমা রাখে?
পারুলকে বুকে টেনে নিলাম।
মাঝরাতে পারুল আমাকে গরম ভাত, শুকনো মরিচ দিয়ে আলুর ভর্তা, ডিম ভেজে পেট ভরে ভাত খাওয়ালো। এটা ছিলো এই দুইমাসের সবচে সেরা ও তৃপ্তির খাওয়া। 
ব্যাগ থেকে পারুলের জন্য আনা কাপড়টা দিলাম। এই মাঝরাতে ট্রাংক থেকে জর্জেটের ব্লাউজ বের করে মাড় দেয়া শক্ত কাপড় পরে পারুল আমার সাথে ঘুমাতে এলো। কাপড়ের গন্ধে আমার নাড়িভুঁড়ি উলটে যাওয়ার কথা। অথচ আজ কত মধুর লাগলো এই গন্ধটা। পারুলের গায়ে হাত উঠিয়ে দিতেই পারুল রাজ্যের গল্প শুরু করলো।
: হুট কইরা আসলা যে?
: হুট করে কোথায় দেখলা? দুই মাস পর।
: আমারে মনে পড়ে না?
: নাহ। শুধু প্যান্ট-শার্ট ধোয়ার সময় মনে পড়ে।
পারুল রুনুঝুনু শব্দ করে হেসে উঠলো মাঝরাতের নিস্তব্ধতা কাঁপিয়ে।
মা নির্লজ্জের মত পাশের ঘর থেকে বলে উঠলো- ওই শফিক ঘুমা।  ঘুম দে।
আমাদের গলা নেমে এলো।
: মা তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করে তো?
: না। আমারে বন্ধ্যামাগী বলে। আমি নাকি অপয়া। সেইদিন রানতেছিলাম। মনার মার ছাগলে লাউগাছ খাইলো। মা আমারে শুধুশুধু পেছন থেকে এসে লাত্থি মারলো। আমি নাকি সংসার দেখি না।
: তুমি কিছু মনে কোরো না পারুল। মা আর অল্পকয়দিন বাঁচবে। 
: আমি কিছু মনে করি না। মনে করায় কী যায় আসে। কিছু মনে কইরা আমি কই যাবো? 
: তুমি অনেক লক্ষ্মী। এত কাবু হইছো ক্যান?
: ভাত খাইতে পারি না। তোমার মা তোমারে আরেকটা বিয়া দিতে চায়।
: তাই।
: তুমি যাইবা কবে?
: কাল দুপুরেই। ছুটি নাই। আইতেই তো রাত হলো।
ব্যাগ খুলে পারুলের গায়ে সেন্ট মেখে দিলাম। পারুলকে কাছে টেনে নিলাম।
পারুল নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পেতে লাগলো। ঘুমানোর আগে পারুলকে বললাম-
: যে কথাটা বলতে আসছি সেইটা বলি।
পারুল আগ্রহ নিয়ে বললো-
: কী কথা?  খারাপ কিছু? 
: খারাপ কিছু না। আমি আরেকটা বিয়ে করতে চাই। সন্তান ছাড়া আর কতদিন কউ? আমারো তো বাপ ডাক শুনতে মন চায়।
পারুল খুব সহজভাবে বললো-
: করো। আমি তো কইছিই তুমি বিয়া করো। আমার কোনো না নাই।
সারা সকাল পারুল কাঁদলো। আমার বিরক্ত লাগতে লাগলো। আমি এক ফাঁকে ডেকে বললাম-
: এত কান্নার কী হলো পারুল?
পারুল কাপড়ের আঁচলে চোখ মুছে বলল-
: তুমি বিয়া করবা সেই জন্য কান্দি না। আমি কান্দি আমি তোমারে বাপ ডাক শোনাইতে পারলাম না এইজন্য।
দুপুরে বিদায় নেয়ার সময় পারুলকে ডেকে বললাম-
: বউ মন খারাপ করবা না। আমি মিথ্যা বলছি। বিয়া টিয়া করছি না। তুমি পাগল হইছো। আমার কথা বিশ্বাস কইরা বসছো। তোমারে ডাক্তার দেখাতে ঢাকা নেবো। আমাদের সন্তান আসবে দেখো।
শহরের পথে হাঁটছি। দুপুরের রোদকে রোদ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে জোছনা। চোখে ভাসছে সেই জোছনায় পারুল খিলখিল করে হাসছে সুখী মেয়েদের মত। পারুলের কোলে একটা শিশু। পারুল লজ্জা লজ্জা মুখে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে আর গল্প করছে। 
আশ্চর্য আমার নাকে ভেসে আসতে লাগলো পারুলের ঘ্রাণ।  রাতে এই ঘ্রাণ আমার শরীরে মিশেছে। এই ঘ্রাণ ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নাই।
আমার এত ভালো লাগতে লাগলো।
বারবার মনে হলো- বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে হারিয়ে দেয়ার কোনো ক্ষমতা নেই কোনো সুন্দরের, কোনো শূন্যতার।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত