কেন হেরেছেন বিজেপির প্রার্থী,অযোধ্যার হিন্দুদের ‘গাদ্দার’ বলছে অন্যরা

  আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪, ১৩:৫৩ |  আপডেট  : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:১৪

লোকসভা নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগে গত জানুয়ারিতে উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তখন মনে হচ্ছিল, রামমন্দির অবস্থিত অযোধ্যার ফৈজাবাদ আসনে তাঁর দল বিজেপির জয় নিশ্চিত। কিন্তু সেখানে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী অবধেশ প্রসাদের কাছে হেরে গেছেন বিজেপির লাল্লু সিং। এই লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকেই উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার হিন্দুদের নিয়ে অশ্লীল মন্তব্যের ঢেউ দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। অশ্রাব্য গালাগালি তো দেওয়া হচ্ছেই, যার মধ্যে সবচেয়ে ‘ভদ্র’ শব্দটি সম্ভবত ‘গাদ্দার’ বা বিশ্বাসঘাতক।

অযোধ্যা যে লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেই ফয়েজাবাদে বিজেপির প্রার্থী, যিনি আবার আগের বার সংসদ সদস্যও ছিলেন, সেই লাল্লু সিং সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী ও দলিত সমাজের প্রতিনিধি অওধেশ প্রসাদের কাছে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই সেখানকার বাসিন্দা হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর পোস্ট, ভিডিও দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। 

উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদে রামমন্দির অবস্থিত। ২০১৮ সালে ফৈজাবাদ জেলার নতুন নামকরণ করা হয় অযোধ্যা। তবে লোকসভার এই আসনকে এখনো ফৈজাবাদ বলা হয়। শুধু ফৈজাবাদই নয়, বরং পুরো উত্তর প্রদেশেই এবার বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। অথচ ভারতের সবচেয়ে জনবহুল এই রাজ্য এক দশকের বেশি সময় ধরে বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। ভারতের লোকসভায় সবচেয়ে বেশি সদস্য আসেন উত্তর প্রদেশ থেকে। এ রাজ্যে লোকসভার ৮০টি (প্রায় ১৫ শতাংশ) আসন রয়েছে। 

ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। বিজেপি বলে আসছে, এই মন্দির নির্মাণের মধ্য দিয়ে তারা তাদের তিন দশকের প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে গত দুই মাসে প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারসভায় বিজেপি ভোটারদের রামমন্দির নির্মাণের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। সেটি গড়ে তোলার জন্য কৃতিত্ব কিছুটা অব্যক্তভাবেই আশা করেছিলেন তারা। তারপরও ফৈজাবাদ আসনে বিজেপি হেরে গিয়েছে।

এ কারণেই অযোধ্যার হিন্দুদের নিয়ে অশ্লীল মন্তব্যের ঢেউ দেখা যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। এদের বক্তব্য, যে নতুন রামমন্দির সেখানে বানানো হয়েছে, হিন্দু সমাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থক্ষেত্র হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, সেখানকার হিন্দু ভোটাররা কেন বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জেতাতে ব্যর্থ হলেন ! ভোটের ফল ঘোষণার পরে অযোধ্যার হিন্দুদের গালাগালি দেওয়া একটি ভিডিও বানিয়ে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশ ইতোমধ্যেই দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। 

ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইনস্টাগ্রাম– এই তিনটি জনপ্রিয় সামাজিক প্ল্যাটফর্মেই চোখে পড়ছে অযোধ্যা হ্যাশট্যাগ দিয়ে সেখানকার ভোটারদের গালাগালি করা হচ্ছে, বিজেপি প্রার্থীর পরাজয়ের জন্য তাদের দায়ী করা হচ্ছে।সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের সম্বন্ধে, সেটা হলো ‘গাদ্দার’ বা বিশ্বাসঘাতক। ‘এক্স’ এবং ইনস্টাগ্রামের একাধিক পোস্টে দেখা যাচ্ছে, অযোধ্যার রামমন্দির ঘিরে যে ‘মন্দির অর্থনীতি’ রয়েছে, তা বয়কট করার আহ্বান জানানো হয়েছে। 

জবাবে উত্তরপ্রদেশের বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র এবং অযোধ্যারই বাসিন্দা শরদ শর্মা বলেন, ‘যদি ভোটের কথা বলেন, তাহলে নির্বাচনে তো হারজিত থাকেই। যে প্রার্থী ভালো কৌশল নিতে পারবে, সেই জিতবে। আর শুধু তো অযোধ্যা নয়, উত্তরপ্রদেশের অনেক আসনেই তো দল হেরেছে। শুধু অযোধ্যার মানুষকে কেন দোষ দেওয়া হবে! দলের প্রার্থী যে চার লাখ ৯৯ হাজার ভোট পেয়েছেন, সেটাও তো এখানকার মানুষই দিয়েছেন!’ 

তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে কুকথা বলছেন, গাদ্দার বলছেন এখানকার ভোটারদের। এটা অনুচিত হচ্ছে। অযোধ্যার মানুষই সব সময়ে রামমন্দিরের লড়াইতে থেকেছেন এবং আছেন। যারা ওইসব কুকথা বলছেন, তারা বাইরের মানুষ। অযোধ্যার ইতিহাস, ভূগোল নিয়ে তাদের কোনও ধারণা আছে বলে মনে হয় না।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন অযোধ্যা যে ফয়েজাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেখানে বিজেপির পরাজয়ের মূল কারণ দুটি। বিবিসির সাবেক সহকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সমীরাত্মজ মিশ্র বলছিলেন, ‘প্রথমত রামমন্দির নির্মাণের সময়ে উন্নয়নের নামে সেখানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, মানুষের ঘর-বাড়ি-দোকান নির্বিচারে ভেঙে দেওয়া হয়েছে, বহু মানুষ যথার্থ ক্ষতিপূরণ পাননি, সেই ক্ষোভ তো ছিলই।’

‘দ্বিতীয়ত, বিরোধী জোট এখানে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস আর সমাজবাদী পার্টির জোট হয়েছিল। এই অঞ্চলটা তো দীর্ঘদিন ধরে কংগ্রেসের শক্তিশালী এলাকা ছিলই’।

সমীরাত্মজ মিশ্র আরও বলেন, এবার কংগ্রেস আর সমাজবাদী পার্টি জোট গড়ে এখান থেকে একজন দলিত নেতাকে প্রার্থী করল। ফয়েজাবাদের প্রায় পাঁচ লাখ দলিত ভোট আছে। সেগুলোর বড় অংশ পেয়েছে বিরোধী জোট। এই জাতি-ভিত্তিক সমীকরণের ফলে ভোটের আগে থেকেই আমরা যারা ওই কেন্দ্রে পর্যালোচনার জন্য গিয়েছিলাম, তারা বুঝতেই পারছিলাম যে এই আসনটি বিজেপির পক্ষে খুবই কঠিন আসন হয়ে উঠেছে।

ব্যবসায়ী সংগঠন ‘অযোধ্যা ব্যাপার মণ্ডল’-এর সভাপতি রাকেশ যাদব বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘মন্দির নিয়ে আমরা খুব খুশি। কিন্তু বিজেপিকে নিয়ে লোকজন হতাশ। মানুষ সব সময় জাত-পাত বা মন্দির-মসজিদের রাজনীতিতে পা দেবে না।’ 

 

সা/ই

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত