একজন রমা চৌধুরীঃ অনেক কষ্টের কিছু কথা
প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৩৬ | আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪০
তপোতি বসু
----------------
আজ কয়েকদিন ধরে একজন অসামান্যা নারীর কথা আর ছবি ভেসে যাচ্ছে সবার লেখায়৷ সংক্ষেপে তাঁর সম্পর্কে যা জানা যায়—রমা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে। বলা হয়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর বা এম,এ৷ ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসাবে যোগদান করেন৷ বিয়ে এবং সন্তান নিয়ে সুখের সংসার ছিল তাঁর ৷নারী স্বাধীনতার আর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এক উজ্জল প্রতীক শিক্ষিকা রমা চৌধুরী।
১৯৭১সালের মুক্তিযুদ্ধ, লক্ষ কোটি মানুষের মতন যুদ্ধই বদলে দিয়েছিল উজ্জ্বল তরুণী, মা রমা চৌধুরীর জীবন ।তখন তিনি বাবার বাড়ি বোয়ালখালি থানার পোপাদিয়া গ্রামে, সঙ্গে মা আর সন্তানেরা৷ স্বামী চলে গিয়েছিলেন ভারতে। স্থানীয় রাজাকারেরা চিনিয়ে দেয় তাঁর বাড়ি৷ ১৩ মে পাকিস্তানি হানাদার ,শয়তান বাহিনী তাদের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করে সন্তান ও মায়ের সামনে৷ তাঁর লেখায়--"যখন আমার সম্ভ্রম কেড়ে নেয়ার জন্য উদ্যত হলো পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা, তখন জানালার পাশে দাঁড়ানো আমার মা ও দুই ছেলে, আমাকে ছেড়ে দিতে পাকিস্তানি হায়েনা ও রাজাকারদের নিকট বারবার আকুতি জানিয়েছিল।আমার পোষা বিড়াল কনুও ছিলো তাদের সাথে। নিরূপায় আমি মাকে বললাম আমার সন্তানদের নিয়ে তুমি এখান থেকে সরে যাও।
এরপরই হানাদারেরা গান পাউডার দিয়ে তাদের বাড়িঘর পুরো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। দৌঁড়ে তিনি বাড়ির পাশের একটা পুকুরে গলাজলে থেকেই তাঁর মূল্যবান সাহিত্যকর্ম, কাগজপত্র পুড়তে দেখেন তিনি। তারপর বৃদ্ধা আর সন্তানদের নিয়ে বনে -বাঁদাড়ে লুকিয়ে দিন কাটিয়েছেন। ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে। তাঁর ভাষায়—‘‘সেদিন আমাদের পাড়ায় কত মেয়েকে যে ধর্ষণ করেছে পিশাচগুলো তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যুবতী মেয়ে ও বৌ কাউকেই ছাড়েনি। গর্ভবতী বৌ, এমনকি আসন্ন প্রসবারাও বাদ যায়নি! এসব কথা জানতে পেরে আমি অন্তরের গ্লানি ভুলে নিজেকে কোনোমতে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেও মা কিন্তু আমার গর্ভে হানাদারের সন্তান আসতে পারে ভেবে আতংকে ও উদ্বেগে ছটফট করতে থাকেন।’’
ইতিহাস যা কষ্টের, বেদনার তা পাল্টায়না৷ আত্মহত্যার কথা না ভেবে, নিজের সম্ভ্রম হারানোর ভয়ংকর ঘটনাকে আড়াল করে শিশু সন্তান ও মাকে নিয়ে পথের জীবনে পাননি কোনো আশ্রয়-আশ্বাস সহযোগিতার হাত—‘...আমার আপন মেজো কাকা সেদিন এমন সব বিশ্রী কথা বলেছিলেন, লজ্জায় কানে আঙুল দিতে বাধ্য হই। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেবার জন্য৷’
স্বাধীনতার পরেই খাদ্যহীন, বাসস্থানহীন অবস্থায় পরপর দুই সন্তানকে হারান তিনি। ফুসফুস প্রদাহে আক্রান্ত হয়ে ছয় বছর বয়সী সন্তান সাগর ২০শে ডিসেম্বর। দু'মাস পরই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চার বছর বয়সী ছেলে টগর৷ স্বাধীনতার পরে নাম মাত্র দ্বিতীয় বিয়ের সন্তান টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান।
তারপরের জীবনও শুধুই কষ্টের! ধর্ষিতা, স্বামী-সংসারহীনা এ সমাজে তিনি অপয়া আর অভিশপ্তা৷ রমা চৌধুরী একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন৷ সম্মানীভাতা ছাড়া তাঁকে দিত ৫০ টি কপি যেগুলি বিক্রি করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। এরপরেই তিনি লিখতে শুরু করেন বই। ‘একাত্তরের জননী’সহ ১৮টিবই লিখতে শুরু করলেন এই হার না মানা প্রাণ৷ নিজের বই ফেরি করতেন —‘কারো কাছে জীবনে হাত পাতিনি। আমি নিজের লেখা বই বিক্রি করি। যেদিন বিক্রি করতে পারি সেদিন খাই, যেদিন পারি না সেদিন উপোস থাকি।’
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বাসায় পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর সোমবার মৃত্যু হয় তাঁর! মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর৷
এই হচ্চে সাহসিকা, বীরাঙ্গনা, একাত্তরের জননী, হার না মানা…ইত্যাদি বিশেষণে সাজিয়ে দেওয়া রমা চৌধুরীর প্রায় পঁঞ্চাশ বছরের জীবন৷ যাঁর এই জীবনের জন্যে তিনি কোনো অপরাধ করেননি৷ তিনি ধর্ষিতা হবার আগেই বিপদ বুঝে পালিয়ে গেছে প্রথম স্বামী৷এরপর সমাজ আর পরিবারের কথা আর কী বলার আছে! কিন্তু দেশ!
স্বাধীনতার জন্যে যিনি সব হারিয়ে ছিলেন,সেই দেশের কী উচিৎ ছিল? তাঁর চাকরিটা কেন তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো না? কেন তাঁর লেখা বই রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশনার ব্যবস্থা করা হয়নি? কেন না খেয়ে থাকতেন? অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা পাওয়াতো তাঁর মৌলিক অধিকারের মধ্যেই ছিল!
শেষ বয়সেও কিছু সাধারণ মানুষ তাঁর জন্যে চেষ্টা করে গেছেন, তাঁকে ভালো রাখার!এসব প্রশ্ন কারো লেখায় আসেনা,কারণ উত্তরগুলো কারো জানা নেই৷
ওনার লেখা "একাত্তরের জননী" —আসলে উনি, ওনার মা সহ আরো অনেক রমা চৌধুরী--যাঁদের ব্যথিত বক্ষে পা ফেলে আসা স্বাধীনতার আনন্দ-সুফল আর সুযোগ ভোগ করছে অনেকে৷ যাঁদের সাথে সেই সব দিনের দুঃসহ বেদনার,কণ্টক পথযাত্রার কী কোনো সম্পর্ক আছে?
রমা চৌধুরী! আপনি যে পথে চলে গেছেন, সে পথ সবার নয়৷ হার না মানা আপনি, আপনাদের জন্যে আমাদের অনেকের শ্রদ্ধা-সম্মান-ভালোবাসা৷
খুব অল্প সংখ্যক মানুষের চলার পথের পথ প্রদর্শকও আপনার মতন মহতী মানুষেরাই৷
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত