একজন বইওয়ালা দাদুভাই- পলান সরকার

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১ মার্চ ২০২৩, ১৪:২৭ |  আপডেট  : ৬ মে ২০২৪, ০৮:২১

পলান সরকার (১ আগস্ট ১৯২১ - ১ মার্চ ২০১৯) একজন বাংলাদেশি সমাজকর্মী ছিলেন। ২০১১ সালে সমাজসেবায় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক প্রদান করে। পলান সরকার রাজশাহী জেলার ২০ টি গ্রামজুড়ে গড়ে তুলেছেন অভিনব শিক্ষা আন্দোলন। নিজের টাকায় বই কিনে তিনি পড়তে দেন পিছিয়ে পড়া গ্রামের মানুষকে। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাঁধে ঝোলাভর্তি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। মাইলের পর মাইল হেঁটে একেকদিন একেক গ্রামে যান। বাড়ি বাড়ি কড়া নেড়ে আগের সপ্তাহের বই ফেরত নিয়ে নতুন বই পড়তে দেন। এলাকাবাসীর কাছে তিনি পরিচিত ‘বইওয়ালা দাদুভাই’ হিসেবে।

পলান সরকারের নানা ময়েন উদ্দিন সরকার স্থানীয় ছোট জমিদার ছিলেন। প্রথমদিকে তিনি তার নানার জমিদারির খাজনা আদায় করতেন। দেশ বিভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হলে ১৯৬২ সালে বাউসা ইউনিয়নে কর আদায়কারীর চাকরি পান। নানার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ৪০ বিঘা সম্পত্তির মালিক হন। ব্রিটিশ আমলেই তিনি যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন। ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন। তিনিই আবার যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতেন। অন্যদিকে মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন। এভাবেই বই পড়ার নেশা জাগ্রত হয়। দীর্ঘদিন ধরে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৬৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর পলান সরকার স্থানীয়দের অনুরোধেই চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। বাউসা বাজারে তার একটি চালকল রয়েছে।

১৯৯০ সাল থেকে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর যারা মেধাতালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জন করত তাদের বই উপহার দিতেন পলান সরকার। এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও তার কাছে বইয়ের আবদার করলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাদেরও বই দিবেন তবে তা ফেরত দিতে হবে। এরপর গ্রামের মানুষও তার কাছে বই চাইতে শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় বই পড়া আন্দোলনের ভিত। ১৯৯২ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখনই তার মাথায় এক অভিনব চিন্তা আসে।

তিনি স্কুলকেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়া এবং ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দেন। এছাড়া যারা তার চালকলে দেনা পরিশোধ করে তাদেরও তিনি বই উপহার দেন। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে।

প্রথমে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষই জানত পলান সরকারের এই অসামান্য শিক্ষা আন্দোলনের গল্প। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিতে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে পলান সরকারকে আলোকিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়।[৩] পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিক প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ সাময়িকীতে তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপা হয়, যার নাম ছিলো ‘বিনি পয়সায় বই বিলাই’। এরপর থেকে তিনি সারাদেশে পরিচিতি পান।

২০১১ সালে সামাজসেবায় অবদানের জন্য রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার উপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে বিটিভির জন্য গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ঈদের নাটক 'অবদান'। বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সকলের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির করার জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে 'সাদা মনের মানুষ' খেতাবে ভূষিত করে।

পলান সরকার ২০১৯ সালের ১ মার্চ রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার বাউশার নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত