উপকূলের শিশুদের ক্রন্দন শুনবে কে 

  সাধন সরকার

প্রকাশ: ৪ জুন ২০২২, ১১:৫৩ |  আপডেট  : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:২৭

    
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভুগতে থাকা বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর একটি। উপকূলীয় জেলাসমূহে জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব সবচেয়ে বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের থেকে অনেক বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলীয় জেলাসমূহে আঘাত হানছে। একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই অন্য  একটি দুর্যোগ আঘাত হানছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে উপকূলীয় জেলাসমূহ এককথায় ধুঁকছে। উপকূলীয় জীবনব্যবস্থা এলোমেলো করে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব। উপকূলের শিশুদের জীবন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। 

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সেই ভবিষ্যৎ শিশুদের জীবন এখন এলোমেলো। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, দাবদাহ, নদীভাঙনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় জীবনব্যবস্থার উপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে অনেক আগে থেকেই। উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে উপকূলের লক্ষ লক্ষ পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে, কাজ হারিয়েছে। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় সুপেয় পানির সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। অর্থ দিয়েও বিশুদ্ধ পানি মিলছে না। উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলের খেত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীভাঙনের কবলে পড়ে হারিয়ে গেছে। উপকূলে জীবনযাত্রার খরচ এখন আগের থেকে বেড়েছে। বিপরীতে তাদের আয়ের উৎস দিন দিন সংকুচিত হয়েছে এবং হচ্ছে। 

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ‘ইউনিসেফে’র ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে। ইউনিসেফের ২০২১ সালের অন্য আরেক প্রতিবেদন মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের শিকার হওয়া অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকা ৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫ তম। উপকূলের শিশুদের জীবন দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে হাজার হাজার পরিবার শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা উপকূলের বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে জীবনের তাগিদে বাধ্য হচ্ছে শহরে আসতে। উপকূলে মানুষের কাজ কমে যাচ্ছে, জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, অন্য সব জেলায় জনসংখ্যা বাড়লেও উপকূলের জেলাসমূহে বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে উল্টো কমে যাচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলের জীবনব্যবস্থায় চরম বৈষম্য তৈরি করছে। দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের শিশুরা যে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বড় হচ্ছে উপকূলের শিশুরা সেসব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জলবায়ু সমস্যাগ্রস্ত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের পেছনে বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে  উপকূলের শিশুরা অপুষ্টি নিয়ে বড় হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি সংকটসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উপকূলের হাজার হাজার শিশু রোগগ্রস্ত হয়ে জীবন কাটাচ্ছে। অর্থকষ্টে ভুগতে থাকা উপকূলের বহু পরিবার তাদের শিশু সন্তানদের লেখাপড়া বাদ দিয়ে কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। অনেক পরিবার তাদের মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ খারাপ জেনেও শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য পরিবারগুলো এসব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে! জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে শহরে পাড়ি জমানো পরিবারগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। শহরের বস্তিতে কিংবা রেললাইনে ঠাঁই নেওয়া এসব পরিবারের শিশুরা তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলছে। পড়ালেখা বাদ দিয়ে শিশুরা দোকান, কারখানাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যোগ দিচ্ছে। শহরে এসে অনেকে স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও জলবায়ু উদ্বাস্তু বেশিরভাগ শিশু শেষ পর্যন্ত বাস্তবতার কাছে হার মেনে বিপথে চলে যাচ্ছে। পিতামাতার হাতে টাকা না থাকলে আর শিশুর পেটে ক্ষুধা থাকলে যা হবার তাই হচ্ছে। উপকূলের প্রতিবন্ধী শিশুদের অবস্থা তো আরো খারাপ। যেখানে জলবায়ু দুর্যোগের শিকার হওয়া পরিবারগুলোর সাধারণ শিশুদের জীবন অগোছালো সেখানে প্রতিবন্ধী শিশুদের জীবনধারণের অবস্থা সহজে অনুমেয়।

বছরের পর বছর মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে আলাদাভাবে ভাবার সময় এসেছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে সাম্প্রতিককালের প্লাবন সমভূমির এই উপকূলীয় অঞ্চলে ভবিষ্যতের শিশুদের কথা ভেবে হলেও আলাদাভাবে নজর দিতে হবে। জলবায়ু সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উপকূলের মানুষ এখন উপকূলে থাকতে চাচ্ছে না। আবার শহরে পাড়ি জমানো উপকূলের মানুষ শহরে আসলেই যে সমস্যার সমাধান হচ্ছে তাও নয়। শহরে মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ তৈরি হচ্ছে। দুর্যোগে বিপর্যস্ত উপকূলে সমস্যা ও বৈষম্য এভাবে বাড়তে থাকলে উপকূলীয় জনপদ একসময় জনশূন্য হয়ে পড়বে। দেশের একটি অংশ অর্থাৎ উপকূলীয় শিশুদের টেকসই ও উন্নত জীবন ব্যতিরেকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন দিন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে এটা ধরে নিয়েই উপকূলীয় জনপদে জীবনব্যবস্থা সাজাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো তথা অভিযোজন কর্মসূচির আওতায় বিশেষ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। করোনাকালে এমনিতেই গরিব মানুষের জীবনব্যবস্থায় নৈতিবাচক প্রভাব তার উপর আবার মাত্রাতিরিক্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় জনপদের জীবনধারা বিপর্যস্ত। উপকূলীয় জনপদে জীবনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ও শিশুবান্ধব সহায়ক  পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো ও টেকসই পরিকল্পনা করতে হবে। কেননা উপকূলের শিশুদের টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে না পারলে আগামীর উন্নত বাংলাদেশ সম্ভব নয়।

লেখক: সাধন সরকার, শিক্ষক ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত