আমাদের স্যানিটেশন ব্যবস্থা কি নারীবান্ধব?

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৩, ১২:০৩ |  আপডেট  : ৫ মে ২০২৪, ২৩:০৯

উন্নত স্যানিটেশন আমাদের নারীদের জীবনকে উন্নত করতে পারে। কিন্তু দুর্বল স্যানিটেশন নারীদের জন্য একটি বড় বাধা। নারীদের উপর খারাপ স্যানিটেশনের প্রভাব বহুমুখী। আমাদের দেশে নিরাপদ এবং পরিষ্কার টয়লেটে অ্যাক্সেসের অভাব রয়েছে। এটি মহিলাদের জন্য উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্যগত প্রভাব ফেলে। বহিরঙ্গন স্থানগুলিতে অস্থায়ী টয়লেট তাদের যৌন হয়রানি, আক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলে। তদুপরি, দুর্বল স্যানিটেশন মহিলাদের উপর অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলে। এই মৌলিক প্রয়োজনীয়তার অভাবের কারণে মেয়েরা স্কুলে অনুপস্থিত থাকে এবং মহিলারা কাজ করতে বা অন্যান্য দৈনন্দিন কাজে অংশগ্রহণ করতে অক্ষম হয়, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের স্বাস্থ্যবিধি অত্যাবশ্যক এবং বাড়িতে ও কর্মক্ষেত্রে উভয়ই স্থানে তা বজায় রাখা প্রয়োজন। নারীদের অনন্য উন্নত স্যানিটেশন চাহিদা তাদের মাসিক এবং দৈনন্দিন জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের গর্ভপাত বা বাচ্চা হওয়ার পরে যোনিপথে রক্তপাতের অন্যান্য পর্ব থাকতে পারে, বা ফাইব্রয়েডের কারণে ভারী রক্তপাত হতে পারে, যার জন্য ঘন ঘন কাপড় এবং প্যাড পরিবর্তন করতে হয়। তারা গর্ভবতী হতে পারে এবং গর্ভাবস্থার সাথে আরও ঘন ঘন প্রস্রাব করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবহন ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে, শপিং সেন্টারগুলোতে, বস্তিতে অবস্থিত টয়লেটগুলি খুব নোংরা।

 সারাদেশের বেশিরভাগ পাবলিক টয়লেটের চিত্র প্রায় একই- নোংরা আর স্যাঁতসেঁতে। নিয়মিত পরিষ্কার না হওয়ায় দুর্গন্ধযুক্ত। কোন কোনটিতে বিদ্যুত সংযোগ নেই। ভাঙা দরজা, ছিটকানি অনেকক্ষেত্রেই অকেজো, কোনো রকমে টেনেটুনে দরজা লাগাতেই টয়লেটের ভেতরটায় নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনেকক্ষেত্রে কমন বাথরুম থাকলেও, মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেকক্ষেত্রে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় মেয়েরা ঋতুকালীন সময়ে বিভিন্ন পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা থেকেও নিজেদের বিরত রাখে। শহরগুলিতে জনসংখ্যার তুলনায় পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা কম। পুরাতন পাবলিক টয়লেটের মান খুব খারাপ, প্রায় ব্যবহারের অনুপযোগী- অপরিষ্কার, দুর্গন্ধযুক্ত। নারী ও শিশুরা তা ব্যবহার করতে পারে না। অনেকক্ষেত্রে মাদকসেবীদের উপদ্রবের কারণেও পাবলিক টয়লেট ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন নারীরা। রাস্তায় বের হলে জ্যামের কারণে যেকোন জায়গাতে পৌছানো অনেক সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে যদি মহিলাদের টয়লেট চাপে, তাদের যাওয়ার জায়গা থাকে না।  মহানগর পুলিশের কর্মকর্তা এবং কনস্টেবল যারা রাস্তায় কর্মরত থাকেন এমন নারী পুলিশ সদস্যরা টয়লেট চেপে রাখেন। এদের অনেকেই ইউরিন ইনফেকশনসহ নানা ধরণের সমস্যায় ভুগছেন। সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থায় নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে । বেসরকারি এক জরিপে জানা গেছে, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩৯টি ও দক্ষিণে ৪৭টি শৌচাগার চালু আছে, যা লোকাল কমিটি ও লিজ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। এগুলো সার্ভিস চার্জ দিয়ে পরিচালিত হয়। তবে তাতে নারীদের ব্যবহার ২০ শতাংশেরও কম। প্রায় ২ কোটি মানুষের শহরে দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে গণশৌচাগারের সংখ্যা প্রায় ৮৬টি সচল থাকলেও নারীদের ব্যবহার উপযোগী হাতে গোনা কয়েকটি। বর্তমানে রাজধানীতে নারীদের ব্যবহারোপযোগী মাত্র ২৬টি টয়লেট রয়েছে।

 সারাদেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টয়লেটের চিত্র প্রায় একই। শিক্ষার্থীদের বাইরেও সন্তানদের স্কুল, কোচিং বা পরীক্ষাকেন্দ্রে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করেন নারী অভিভাবকরা। কিন্তু তাদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলাদা কোনো টয়লেট নেই। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেট নেই। থাকলেও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসম্মত নয়, যদিও প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-৩-এর লক্ষ্য ছিলো ২০১৭-র জুনের মধ্যে দেশের ৯৫ শতাংশ সরকারি স্কুলে মেয়েদের জন্য পৃথক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রীদের জন্য পৃথক টয়লেট রয়েছে মাত্র ৩২.৬ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রায় ৬৭ শতাংশ ছাত্রীই এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে আবার ১৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়েই কোনো টয়লেট নেই। এ চিত্র আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
২০১৪ সালের স্থানীয় সরকার বিভাগের পলিসি সাপোর্ট ইউনিটের উদ্যোগে ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভে করেছিল আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি)। স্বাস্থ্যবিধি চর্চার বিষয়ে ধারণা পেতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে করা এ জরিপে সহযোগিতায় ছিল ওয়াটার এইড বাংলাদেশ। এতে দেখা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে ১৮৭ শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একটি টয়লেট, যেখানে সরকারি মানদণ্ডে প্রতি ৫০ ছাত্রীর জন্য পৃথক টয়লেট ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। আবার স্কুলগুলোর ৫৫ শতাংশ টয়লেট তালাবদ্ধ থাকে। খোলা থাকাগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ ব্যবহারের উপযোগী। এছাড়া ছাত্রীদের জন্য আলাদা টয়লেট আছে কেবল ১১ শতাংশ স্কুলে। আর ঋতুকালীন ব্যবস্থাপনা রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ স্কুলে। তাই ৮৬ শতাংশ ছাত্রী এ সময় বিদ্যালয়ে আসতে চায় না। ঢাকা বার দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বার। সেখানে কম-বেশি ৫ হাজার নারী আইনজীবী রয়েছেন। তাদের জন্য বাথরুমের কোনো ব্যবস্থা নেই। ৪-৫টি বাথরুমের ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো ব্যবহারের উপযোগী নয়। দেশে গার্মেন্স ফ্যাক্টেরিগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৪২ লাখ শ্রমিক কাজ করছে, যার মধ্যে শতকরা ৮০-৯০ শতাংশ নারী শ্রমিক রয়েছে। তাদের জন্য যথাযথ টয়লেটের ব্যবস্থা নাই। সেখানে একটি-দুটি টয়লেট দিয়েই শেষ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্লিনার নেই। স্বাস্থ্যসম্মত নারীবান্ধব ওয়াটার, স্যানিটেশন ও হাইজেনিক ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যাবে তা অবস্থা অত্যন্ত করুণ। অফিসের নারীদের ক্ষেত্রে হয়তো একটা কমন টয়লেট থাকে। সেখানে পুরুষ ও নারী একত্রে যাতায়াত করে।  প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ নারী শিক্ষিকা, তাদের জন্য নারীবান্ধব টয়লেট নেই। 

 এইসব কারণে মেয়েরা দীর্ঘ সময় পানি না খেয়ে থাকেন, কিংবা চেপে রাখেন পায়খানা ও পেশাব---এর প্রভাব পড়ে শরীরে। এজন্য মূত্রথলির সংক্রমণসহ নানা ধরণের শারীরিক সমস্যায় পড়তে হয় নারীদের। দীর্ঘ সময় পানি না খেয়ে থাকলে প্রথমেই পানিশূন্যতা হয়। এরপর টয়লেট চেপে রাখা ইউরিন ইনফেকশনের একটি কারণ। আরো অনেক রোগ হতে পারে। কিডনীর কাজ পরিচালনার জন্য পানি পান জরুরি, শরীরের বিষাক্ত উপাদান বের করে দেয়া এবং গ্লুকোজসহ অন্যান্য উপাদান অ্যাবজর্ব করে কিডনী। ফলে তার কাজ ব্যহত হওয়া মানে পুরো শরীরের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মহিলারা ইউরিনের বেগ চেপে রাখছেন! বাড়ছে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের ভয়! ডায়াবেটিস বা কঠিন রোগে আক্রান্ত রোগীদের ঘনঘন প্রস্রাবের বেগ আসে। দীর্ঘসময় ধরে টয়লেট চেপে রাখতে গিয়ে শোচনীয় অবস্থা হয় তাঁদের। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের ইউরেথ্রা বা মূত্র নিষ্কাশনের জায়গার দৈর্ঘ্য কম। ফলে মহিলাদের মূত্রনালীতে চট করে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নোংরা জায়গায় ইউরিন করা, জল কম খাওয়ার কারণে পুরুষদের থেকে মহিলাদের মধ্যে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) বেশি হয়। ডায়াবেটিস, স্নায়ুর সমস্যায় আক্রান্ত মহিলা কিংবা মেনোপজ হয়ে গিয়েছে এমন মহিলার মূত্রত্যাগের সমস্যা বেড়ে যায়। ইউরিন পাসের জন্য নোংরা জায়গা বা টয়লেট এড়িয়ে চলতে হয়। বিশেষ করে যে জায়াগায় ইউরিন পাস করছে, সেই জায়গাটি খুব ভালো করে পরিষ্কার থাকা দরকার। মহিলাদের সংক্রমণ ঘটার অন্যতম জায়গা হল ইংলিশ স্টাইলের কমোড। কমোডে ইউরিন পাস করার সময় স্কিন কনট্যাক্ট হয়। ফলে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত মূত্রনালীর মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করার সুযোগ পায়।  পাবলিক টয়লেট থেকে গোপনাঙ্গে ঘা হওয়ার আশঙ্কা বিপুল। পাবলিক টয়লেটে মূত্রত্যাগের পাশাপাশি অনেকেই মলত্যাগের জন্য যান। শৌচালয়ের উপকরণ থেকে মারাত্মক পেটের রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মহিলাদের এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। পাবলিক টয়লেট থেকে মূত্রনালীতে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। এর ফলে মূত্রত্যাগের সময় জ্বালা ও ব্যথা হয়। ত্বক বেশি সংবেদনশীল হলে এই সমস্যায় পড়তে হয়। টয়লেটের বেসিন থেকে শুরু করে মগ বা হাত ধোয়ার কলে সংক্রামক জীবাণু থাকে। তাই সংবেদনশীল ত্বক হলে সংক্রমণের আশঙ্কাও বেশি। বাংলাদেশি টয়লেটে যেহেতু পানির ব্যবহার বেশি হয়, তাই ভাইরাল রোগ ছড়ানোর আশঙ্কাও বেশি। অপরিষ্কার টয়লেট মহিলাদের জন্য বিশেষ হুমকি সৃষ্টি করে। আমাদের সমাজ মহিলাদের ‘প্রস্রাব আটকে রাখতে’ও শেখানো হয়েছে, যা অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলির উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করতে পারে, ইউটিআইগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে (আরো বেদনাদায়ক) এবং কিডনির কার্যকারিতাকে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। নোংরা টয়লেটগুলি মহিলাদের মাসিকের সময় সমস্ত ধরণের সংক্রমণ হতে পারে – জীবাণু দ্বারা ঘেরা নোংরা টয়লেটে স্যানিটারি ন্যাপকিন পরিবর্তন করা প্রতিকূল সম্ভাবনা তৈরি করে। পাবলিক টয়লেট বা স্নানের সুবিধা ব্যবহার করার সময় তারা যৌন হয়রানি এবং লাঞ্ছিত হওয়ার ঝুঁকিতেও থাকে।

উপসংহারে, মহিলাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দুর্বল স্যানিটেশন একটি উল্লেখযোগ্য বাধা। উন্নত স্যানিটেশন পরিকাঠামোতে বিনিয়োগ করে, পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় নারীদের সম্পৃক্ত করে এবং অন্তর্নিহিত লিঙ্গ বৈষম্য মোকাবেলা করে, আমরা এমন একটি দেশ গঠন করতে পারি যেখানে সমস্ত নারীদের তাদের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক স্যানিটেশন সুবিধাগুলিতে অ্যাক্সেস থাকবে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত