আমাদের সমাজে মানুষ কি সত্যিই কম নৈতিক?
প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২৩, ১২:১৫ | আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১৭
আমাদের দেশের বর্তমান সমাজের প্রায় সকলের একটি বিশ্বাস যে নৈতিকতা হ্রাস পাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমাদের রাষ্ট্রে, সমাজে, রাজনীতিতে ও নীতিনির্ধারকদের অনৈতিকতা, দুর্নীতি, সহিংসতায়, আমরা কি এই সমাজে বসবাসের যোগ্য? শিশুশ্রম, ধর্ষণ, গার্হস্থ্য সহিংসতা, বৈষম্য, বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য, ধর্মের নামে বৈষম্য ও সহিংসতার বর্তমান সমাজে নৈতিকতা ও নীতির অস্তিত্ব বিলুপ্ত প্রায়। বৃদ্ধি পাচ্ছে এক ধরণের সামাজিক আচরণে বর্বরতা ও অনৈতিকতা। আমরা এমন একটি দেশে বাস করি যেখানে সহমর্মিতার অভাব, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং সর্বক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতি দেখতে পাই। মানুষ সমাজে এখন মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে ব্যর্থ। আমরা যেন কাউকে হেয় করে, ক্ষতিগ্রস্ত করে, অত্যাচারে, নির্যাতনে, হত্যা করে আনন্দ পাই। সত্য, মানবিকতা, সহমর্মিতার যেন আর অস্তিত্ব নেই। মানুষ আজ অনৈতিকতা, দুর্নীতি, সহিংসতায়, অজ্ঞতা ও আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপন করছে। সমাজে আমাদের আশেপাশের মানুষ বা পরিবারের কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে, এটি আমাদের এখন আর প্রভাবিত করে না। আগে একজন দুর্নীতিবাজ ও নীতিহীন ব্যক্তিকে সমাজ পরিহার করলেও এখন কেউ অন্যায় করলে এটাই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়। নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। তরুণরা তাদের ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুতি এবং তাদের জীবন উপভোগ করতে ব্যস্ত। সামাজিক সমস্যা বা পারিবারিক বিষয় নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। বৃদ্ধরা প্রায়ই অবহেলিত । আমরা বর্তমান সমাজে প্রজন্মদের তাদের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার , এমনকি তাদের বের করে দেওয়ার ঘটনাও দেখছি।
অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক জীবনের কারণে ছোট শিশু, কিশোর, তরুণরা অবহেলিত। বর্তমান প্রজন্মের পিতামাতারা তাদের শিশুদের বিষয়ে যত্নহীন। ফলে পাশ্চাত্যের প্রভাব ও চলচ্চিত্রের প্রভাবে দিন দিন সংস্কৃতির অবক্ষয় ঘটছে যা তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত ও প্রভাবিত করছে। ইলেকট্রনিক গ্যাজেট এবং মোবাইল অ্যাপ শিক্ষার পদ্ধতির পরিবর্তন করেছে। বর্তমান প্রজন্ম অনলাইনে শিক্ষার প্রতি আসক্ত। কিন্তু আজকাল তারা তাদের শিক্ষকদের প্রতিও কম শ্রদ্ধাশীল। তরুণ প্রজন্ম আইপ্যাড এবং ল্যাপটপে ব্যস্ত। মূল্যবোধ ও আদর্শের অবক্ষয়ের কারণে বর্তমান প্রজন্ম উচ্চ শিক্ষিত হয়ে উঠলেও, তাদের জীবন দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি এবং সরকারের দুর্বলনীতির কারণে মানুষ আজ তাদের পরিবারের খরচ চলতে হিমশিম খাচ্ছে। মানুষ সরল ও অর্থবহ জীবনযাপনের মূল্য ভুলে গেছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিনোদনের নতুন মাধ্যম গড়ে উঠেছে। তারা গভীর রাত পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুষ্ঠান উপভোগ করে। তারা ভোরে তাড়াতাড়ি উঠতে এবং ধর্ম, ধ্যান ও ব্যায়াম করতে ভুলে গেছে। আধুনিক সময়ে নগরায়নের কারণে, বর্তমান প্রজন্ম ধীরে ধীরে একাকীত্বে ভুগছে। ফলে প্রজন্ম মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। কঠোর প্রতিযোগিতা তরুণদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি করছে যা খুবই হতাশাজনক এবং আমাদের দুর্বল সমাজ ব্যবস্থাকে প্রতিফলিত করে। কারণ সমাজে সর্বক্ষেত্রে আমাদের লোভনীতি ও অনৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধকে নিম্নমুখী করেছে। অনৈতিকতা, দুর্নীতি, সহিংসতায় জড়িত, প্রভাবশালীদের তান্ডব, রাষ্ট্র পরিচালকদের অনৈতিকতা, নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতি, ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার লোভে অনৈতিকতার অপরাধ বৃদ্ধির ফলে নিরপরাধ সাধারণ জনগণের মধ্যে ভয় ও তাদের জীবনে হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে আজ অবৈধভাবে ধনী, অভদ্র এবং অহংকারী ধনী শ্রেণীর তৈরি হয়েছে যা সমাজের নৈতিকতাকে ধ্বংস করছে। মানুষের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করছে। নিম্ন নৈতিক মূল্যবোধ সমাজে অস্থিরতা ও অশান্তি সৃষ্টি করেছে। সমাজে সাধারণ ও সৎ লোকেরা সংগ্রাম, অবহেলা এবং কষ্টের সম্মুখীন ।
এখন প্রশ্ন হলো আমাদের দেশের সমাজে মানুষ কি সত্যিই কম নৈতিক হয়ে উঠছে? নৈতিক আচরণ কি হ্রাস পাচ্ছে? আসলেই নৈতিকতা হ্রাস পাচ্ছে। কারণ আমাদের সমাজের সব ক্ষেত্রে, মানুষ বিশ্বাস করে যে নৈতিকতা ক্রমাগত অবক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে। কারণ মানুষ মনে করে, সাম্প্রতিক অতীতেও, লোকেরা একে অপরের সাথে আরও দয়া এবং শ্রদ্ধার সাথে আচরণ করতো। আমাদের দেশে বিগত দুই দশকে সমাজে অনেক নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ মানুষই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে বর্তমান প্রজন্মের কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্করা খুব আক্রমণাত্মক। তাছাড়া রাজনৈতিক ও আর্থিক দুর্নীতি নৈতিক অবক্ষয়ের আরেকটি কারণ। আমাদের দেশের রাজনীতি নোংরা হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদ এবং কর্তৃত্বের বা নীতিনির্ধারক ব্যক্তিরা তাদের মূল নৈতিক নীতিগুলি ত্যাগ করেছেন। আর্থিক দুর্নীতিও একটি বিষয়। ফলে প্রতারণা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বেআইনিভাবে কিছু মানুষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, ফলে নৈতিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত সমাজের সৃষ্টি হয়েছে। বৃদ্ধি ঘটেছে সহিংসতা, দুর্নীতি, যৌন হয়রানি এবং বৈষম্য ।
লেখকঃ কথা সাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক, অভিজিৎ বড়ুয়া অভি।
সান
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত