“গোলামিকে না বলি”-হোক তরুণ প্রজন্মের স্লোগান
আমরা স্বাধীন জাতি, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করি না
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২২, ১০:১৮ | আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩২
জন্মলগ্ন থেকে দূর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ আর মার্কিন ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছিলো। ষড়যন্ত্র থেমে থাকে নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ১৯৭১ সালের জুলাইতে হেনরি কিসিঞ্জার বেইজিংয়ে যান। ফলস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়েরই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য বৈঠকে বসেন। বৈঠকে কোন সিদ্ধান্ত হয় না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চাপ, আমেরিকার হুমকি উপেক্ষা করে ১৯৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে দৃঢ় প্রত্যয়ে, বলিষ্ঠ কিন্তু শান্ত বজ্রকঠিন কন্ঠে ঘোষণা করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ১৯৭১-এর ৭ মার্চ মহানায়কের যে মহাকাব্য, যার পথ ধরে যাত্রা শুরু এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের, তাই থমকে গেলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থানে বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। তাও দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্র ও যোগসাজশের মধ্যে দিয়ে। যদিও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও বাংলাদেশকে অস্থিতিশীলতার জন্য মার্কিন যোগসাজশের দিকে ইঙ্গিত করে এমন অজস্র প্রমাণ রয়েছে । এরপর থেকে বেইমানী, কাপুরুষতা, পদলেহন, দূর্নীতি আমাদের রক্তে, মজ্জায়, দেহের রেন্ধ্রে রেন্ধ্রে মিশে গেছে।
দূর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী আর সুশীল সমাজ সুইস ব্যাংকে টাকার পাহাড় জমিয়েছে। দেশ থেকে অবৈধ ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলির পাশাপাশি কানাডা, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ বা সিঙ্গাপুরে টাকা চলে গেছে এবং যাচ্ছে ৷ বাংলাদেশিদের টাকার ‘পাহাড়’ জমেছে সুইস ব্যাংকে। তাদের দেশের কোন প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা নেই। বিদেশে তারা সম্পদ জমা করে, সম্পদ কেনে, কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিদেশে আশ্রয় নেয়, বাচ্চাদের বিদেশে মানুষ করে, লেখাপড়া শেখায়।
আর এদের সহযোগীতায় মার্কিন, চীন, পাকিস্তান, ভারতের ষড়যন্ত্র চলছেই। তারা আমাদের মতন গোলামদের মালিক হতে চায়। হত্যা করতে চায় আমাদের নেতৃত্বকে। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট ঢাকায় আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয় এবং প্রায় ৩০০ লোক আহত হয়। ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও জুন মাসে সিঙ্গাপুরে দাউদ ইব্রাহিম এবং আইএসআইয়ের সঙ্গে তারেক রহমানের অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয়। আর ‘আর্জেস’ গ্রেনেডও সংগৃহীত হয়। আর্জেস-৮৪ গ্রেনেড অস্ট্রিয়ায় এবং অস্ট্রিয়ার লাইসেন্সের ভিত্তিতে পাকিস্তানে তৈরি হয়। এ উপমহাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছাড়া কেউ এ গ্রেনেড ব্যবহার করে না।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক শক্তিশালী ব্যক্তি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বিপরীতমুখীতা শুরু হয়। জিয়া বাংলাদেশকে ইন্দো-সোভিয়েত কক্ষপথ থেকে বের করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি নিয়ে আসতে সফল হন। জিয়ার অধীনে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মার্কিন ও বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গির মিল ছিল। কিন্তু জিয়া হত্যার অভ্যুত্থানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল অবাক করার মতন। এরপর রাষ্ট্র ক্ষমতায় জেনারেল এরশাদ এসে জিয়ার নির্দেশিত বৈদেশিক নীতি অব্যাহত রাখেন, যা মার্কিনদের সন্তুষ্ট করেছিল। মেজর জিয়ার হত্যার পর ক্ষমতা দখল করা লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ.এম. এরশাদ ২৫ অক্টোবর, ১৯৮৩ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিগানের বৈঠক হয়। সেই সফরের এরশাদ এর অস্থিরতা দেখে বুঝা যায় তিনি কতটুকু অপ্রস্তুত ছিলেন। সে বৈঠকের পর রিগান বলেন, “আজ আমরা বাংলাদেশের মন্ত্রী পরিষদের সভাপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদকে স্বাগত জানাতে পেরে সম্মানিত। গত দেড় বছরে জেনারেল এরশাদের সরকার বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নিয়েছে।” মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র ১৩ই জানুয়ারি ১৯৮৬ তারিখ উল্লেখিত দলিলে, এরশাদকে হত্যার এক ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পেছনে লিবিয়ার সহায়তা ছিল বলেও তথ্য মিলেছে।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে, যখন সেনাবাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঢাকায় ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন এই শাসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদ ছিল । ১১ জানুয়ারী ২০০৭ সালের ঘটনাগুলি ছিল 'একটি আন্তর্জাতিকভাবে অনুপ্রাণিত সামরিক অভ্যুত্থান।' একটি প্রতিবেদনে একজন সিনিয়র বাংলাদেশি সামরিক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে দাবি করা হয়েছে যে 'ব্রিটিশ, আমেরিকা , অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী আনার জন্য ব্যাপকভাবে জড়িত ছিল এবং এটির [অভ্যুত্থান] জন্য [ইউ.এন] সদর দফতর থেকেও সমর্থন ছিল। অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের দক্ষিণ এশিয়া সংবাদদাতা, পিটার লয়েড, ৮ জুন ২০০৭, প্রভাবশালী বাংলাদেশী সংবাদপত্রের সম্পাদককে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, “পশ্চিমা দেশগুলি শুধু সামরিক হস্তক্ষেপই করেনি, জানুয়ারিতে বেসামরিক রাজনীতিবিদদের এটি গ্রহণ করার জন্য প্রচারণা চালায়।”
মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে। গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়। এটি বাংলাদেশের উপর চীনের ক্রবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধির কারণে হয়েছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ও চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গ্রহণীয় নয়। বিভিন্ন বিধিনিষেধ আর কিছু নয় বর্তমান সরকারকে আজ্ঞাবহ, নতজানু করার চেষ্টা। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির কাছে হারের দিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি তো চেয়েছিলাম আমার দেশের সম্পদ আগে আমার দেশের মানুষের কাজে লাগবে। আমার ৫০ বছরের রিজার্ভ থাকবে। তারপর, আমরা ভেবে দেখব বিক্রি করব কি, করব না। …ফলাফল কী ? ……….. আমেরিকা অ্যাম্বাসির লোক, হাওয়া ভবনে বসেই থাকত। এই নির্বাচনটা.. ২০০১-এ সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে হারাবে, আর এখান থেকে গ্যাস নেবে।” তিনি কিছুদিন আগে বলেছেন, “২০১৪–এর নির্বাচনের আগে চক্রান্ত করেছে, ২০১৮–এর নির্বাচনের আগে করেছে, আবার এখন নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে।”
দূর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, আমলা আর সুশীল সমাজের চক্রান্তের কারণে মার্কিন, ভারত, চীনের এম্বাসেডররা আস্ফালন করে, তাদের দেশ হতে প্রতিনিধি এসে বিভিন্ন চাপ সৃষ্টি করেন। আমাদের দেশের মাটিতেই তারা ১৬ কোটি মানুষকে চোখ রাঙায়। কারণ আমাদের দূর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, আমলারা নতজানু পররাষ্ট্রনীতি সৃষ্টি করে আমাদের গোলাম বানিয়েছেন। তারা এদের পদলেহন করেন কারণ তাদের অর্থ ঐসকল দেশে গচ্ছিত। ১৬ কোটি মানুষের দেশের মুসলমান ৯১.০৪ শতাংশ, হিন্দু ৭.৯৫ শতাংশ, খ্রিস্টান ০.৩০ শতাংশ; বৌদ্ধ ০.৬১ শতাংশর দেশে আমরা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করি না। কিন্তু দূর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, আমলা আর সুশীল সমাজের চক্রান্তে বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার ধর্মপ্রাণ জনগন, বাংলার সাধারণ মানুষ হলাম গোলাম। হে তরুণ প্রজন্ম আর কত ষড়যন্ত্র মানবে? আর কতো হত্যার পর বন্ধ হবে এই কান্না অশ্রু, এ যে অশ্রু নয় রক্তক্ষরণ। ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।/ সংঘাতে তোর উঠবে ওরা রেগে, শয়ন ছেড়ে আসবে ছুটে বেগে, সেই সুযোগে ঘুমের থেকে জেগে, লাগবে লড়াই মিথ্যা এবং সাঁচায়। হে তরুণ আসো সর্বত্র ধ্বনিত করি, “আমরা স্বাধীন জাতি, সৃষ্টিকর্তা ছাড়া মানবো না কারো গোলামি।”
লেখকঃ কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত