আমার পড়া নিষিদ্ধ বই
অধিকাংশ বই খামোখাই নিষিদ্ধ হয়
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:২৪ | আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২০:৪৮
মুজিব রহমান
---------------
…গত বছর নিষিদ্ধ করা হয় সাইফুল বাতেন টিটোর বিষফোঁড়া উপন্যাসটি। বইটি সুধী মহলে খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। নামটিও খুব মানানসই হয়নি। মাদ্রাসা শিক্ষাকে তিনি হয়তো বিষফোঁড়া বলতে চেয়েছেন। বইটির নাম হতে পারতো ‘লুতু কওম’। তিনি বইটি লিখেছেন কওমী মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে। বাস্তবিক এখানে আসবে বলাৎকার শব্দটি। কোনভাবেই দক্ষতার সাথে তিনি উপস্থাপন করতে পারেননি। এই বইটি নিষিদ্ধ করে তো ‘লুতু কওম’ বন্ধ করা যাবে না। বরং লেখকের দাবি করা সত্যতা যাচাই করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রকৃত অবস্থা খুঁজে বের করতে পারলেই তা আরো কাজে আসতো। হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদবাদ’ ছিল আরো আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপিত। অথচ নিষিদ্ধ হল ‘বিষফোঁড়া’। এতে বইটির উপর পাঠকদের আকর্ষণ বেড়ে গিয়েছিল এবং তারা বিভিন্নভাবে বইটি সংগ্রহ করে পড়েছে৷ বাস্তবিক বইটির প্রচার আরো বেড়ে যায়। হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ বইটি কেন নিষিদ্ধ হয়েছিল? একেবারেই অযৌক্তিক ছিল নিষিদ্ধ করা। ‘নারী’ নিষিদ্ধ হলে তিনি ফরাসী বুদ্ধিজীবী সিমোন দ্য বোভোয়ারের ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইটির অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এই বইটি আরো গুরুত্বপূর্ণ এবং তাতে ‘নারী’ নিষিদ্ধ অর্থহীন হয়ে যায়। এছাড়া নারী নিষিদ্ধ হলেও প্রচুর সংখ্যক মানুষ বিভিন্নভাবেই নারী পড়তে থাকে। নারী বইটি আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। পরে আদালতের রায়ে নারী অবমুক্ত হয়।
বাংলাদেশে নিষিদ্ধের তালিকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নামটি হল তসলিমা নাসরিন। প্রথমে তার লজ্জা উপন্যাসটি নিষিদ্ধ করা হয়। বইটি প্রকাশের প্রথম ৬ মাসেই বিক্রি হয়েছিল ৫০ হাজার কপি। নিষিদ্ধ হওয়ার পরে বিক্রি হয়েছে লক্ষ লক্ষ কপি। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সকল ভাষাতেই অনুবাদ করা হয়েছে। এছাড়া ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, জার্মানি, স্প্যানিশ, ইতালীয়, সুইডিশ, নরওয়েজীয়, ফিনীয়, ফার্সী, আরবী, ফিনীয়, নেপালী, মালয়লাম, সিংহলি ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। অর্থাৎ নিষিদ্ধ করে প্রসার ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। তাঁর পাঁচটি আত্মজীবনী নিষিদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশে তার মধ্যে- আমার মেয়েবেলা, উতল হাওয়া, দ্বিখণ্ডিত/ক অন্যতম। বইগুলো পড়েছি এবং তাতে নিষিদ্ধ হওয়ার মতো উপাদান ছিল বলে মনে হয়নি।
আনা ফ্রাঙ্কের ডাইরী আমেরিকার কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নিষিদ্ধ ছিল। তাদের হাস্যকর অভিযোগ ছিল, বইটিতে নাজি সেনাদের ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা রয়েছে যা শিশু-কিশোরদের কোমল অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। তবে মার্ক টোয়েনের ‘দি এডভেঞ্চার অব টম সয়্যার’ এবং 'দি এডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন’ নিষিদ্ধ করা ছিল আরো হাস্যকর। নিউইয়র্ক ও কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের অভিযোগ ছিল টম এক বিতর্কিত চরিত্র। এই বই পড়ে শিশু-কিশোরগণ অবাধ্যতা আর দুষ্টুমি শিখবে। 'হাকলবেরি ফিন' নিষিদ্ধ ছিল কারণ বইতে ধারণা দেয়া হয়েছিল যে, নিগ্রোরা দাস হিসেবে নয়, অন্যান্য মানুষের মতোই সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে। তাদের আরো অভিযোগ ছিল, বইটিতে কথ্য শব্দ রয়েছে যা শিশু-কিশোরদের অনুপযোগী। আরেকটি বিখ্যাত বই হ্যারিয়েট বিচার স্টোর ‘আঙ্কল টমস কেবিন’ নিষিদ্ধ হয়েছিল৷ বইটির কারণেই নাকি আমেরিকার গৃহযুদ্ধ লেগেছিল! বইটি যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত দাসপ্রথার ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিল। জর্জ অরওয়েলের এনিম্যাল ফার্ম প্রাণিদের নিয়ে লেখা হলেও এর গভীরে ছিল রাজনীতি। সোভিয়েত ইউযনিয়নের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সমালোচনা ছিল ইংগিতে তাই সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ড্যান ব্রাউনের বিখ্যাত থ্রিলার ‘দ্য দা ভিঞ্চিকোড’ নিষিদ্ধ করা হয় লেবাননে। এই বইতে যিশুর স্ত্রী ও সন্তানদের কথা বলা হয়েছিল। মেরি শেলির বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফ্রাঙ্কোস্টাইন’ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় অশ্লীলতার অভিযোগে। এই ছয়টি বই পড়েছি; পড়ে আজ যে কেউই বলবে, আরে এই বই নিষিদ্ধ করে কোন পাগলে?
যৌনতার অভিযোগ নিষিদ্ধ হয়েছিল ডিএইচ লরেন্স এর প্রেমের উপন্যাস ল্যাডি চাটার্লিজ লাভার ও পশ্চিমবঙ্গের সমরেশ বসুর প্রজাপতি। লেডি চাটার্লিজ লাভার নিষিদ্ধ হওয়ার কোন উপাদানই নেই। সামান্য যৌনতা আছে তা রগরগে নয় মোটেই। প্রজাপতির ক্ষেত্রেও বলতে পারি পশ্চিমবঙ্গে এর আগে আরো রগরগে বই প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু নিষিদ্ধ হয়নি। সম্ভবত গ্রামের এক আখক্ষেতের পাশে সামান্য ভালবাসা বিনিময়ের কারণে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়। বই দুটি অনেক আগের পড়া বলে বিস্তারিত লিখলে ভুল হতে পারে। প্রথম আলোর ইদ সংখ্যায় এমন একটি বই পুনঃপ্রকাশ করেছিল। ইরানের শাহ আমলের বিখ্যাত লেখক ও মন্ত্রী আলি দস্তির ‘নবী মোহাম্মদের ২৩ বছর’ ইরান ও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে নিষিদ্ধ। লেখক কোরআন ও হাদিস বিশ্লেষণ করে নবী মোহাম্মদ (সা.) এর জীবনী লিখেন ও বিভিন্ন অলৌকিকতার বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা দেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি বই সম্পাদনা করে বা লিখে প্রকাশক/লেখক শামসুজ্জোহা মানিক গ্রেফতার হন। বইটি পড়ে দেখেছি এর একটি লেখাও তার নয়। শিরোনাম ইংরেজি করে সার্চ দিলেই মূল ইংরেজি লেখা চলে আসে। তাতে স্পষ্ট হয় যে, মানিক শুধু ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করে প্রকাশ করেছেন। বইটি শেষ পর্যন্ত সম্ভবত নিষিদ্ধ হয়নি। আরো কয়েকটি বই পড়েছি যা পরে নিষিদ্ধ হয়৷ এগুলো গুরুত্বহীন বলে আলোচনা করলাম না৷ বাংলা ভাষার বইগুলো নিষিদ্ধের আগেই পড়েছি৷
বই সবচেয়ে বেশি নিষিদ্ধ হয় অশ্লীলতা, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে। ধর্মীয় কারণে নিষিদ্ধ হওয়া আলোচিত বই হল সালমান রুশদির ‘দ্যা স্যাটানিক ভার্সেস'। সম্ভবত সকল মুসলিম দেশেই বইটি নিষিদ্ধ করা রয়েছে। এছাড়া ভারত, শ্রীলংকা, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, পাপুয়া নিউগিনি, কেনিয়া ইত্যাদি দেশেও নিষিদ্ধ। বহু বিখ্যাত ব্যক্তির বইই নিষিদ্ধ হয়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেল, জেমস জয়েস, ড্যানিয়েল ডিফো, এলেন গিন্সবার্গ, জন স্ট্যাইনব্যাক, ভলতেয়ার, নোয়াম চমস্কিসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ লেখকের বই কোন কোন দেশ কর্তৃক সাময়িক বা দীর্ঘ সময়ের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত