চালুর উদ্যোগ নেই

দেশের একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর ১৭ মাস ধরে বন্ধ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৫৩ |  আপডেট  : ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:২০

গণহত্যার ইতিহাসকে শুধু একাডেমিক পরিসরে রাখার পরিবর্তে জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য ১১ বছর আগে খুলনায় তৈরি করা হয়েছিল ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। ২০২৪ সালে এটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়ার পর এক মাস চালু ছিল। পরে বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় গত ১৭ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর। গত বছরের জুলাই থেকে মিলছে না সরকারি অনুদান। নেওয়া হয়নি চালুর উদ্যোগ। সংস্কার ছাড়া এটি পুনরায় চালু করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। 

জাদুঘর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এটি দেশের একমাত্র গণহত্যা জাদুঘর। খুলনায় স্থাপনের অন্যতম কারণ চুকনগর বধ্যভূমি এখানে অবস্থিত। চুকনগরে ১৯৭১ সালের সবচেয়ে বড় ও নৃশংস গণহত্যাটি চালিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। এখানে আছে বাঙালির মুক্তি, স্বাধীনতার স্পৃহা আর মুক্তিযুদ্ধকালের সবচেয়ে মর্মন্তুদ পর্বের অসংখ্য নিদর্শন। সেগুলোর সামনে দাঁড়ালে দর্শনার্থীর চোখে ভেসে ওঠে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্তের যন্ত্রণার দিনগুলো। তবে শুধু খুলনা অঞ্চল নয়, মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশের বিভিন্ন গণহত্যার নিদর্শন জায়গা পেয়েছে এই জাদুঘরে। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর পাঞ্জাবি, শহীদুল্লা কায়সারের দুটি টাই ও ডায়েরি, বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দীন আহমেদের কোট, সেলিনা পারভীনের কলম ও শাড়ি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পাঞ্জাবি, পায়জামা ও পাণ্ডুলিপি, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার লেখা বই, ডা. আলীম চৌধুরীর ভিজিটিং কার্ড, ল্যাম্প, ডেন্টাল টুলকিট ও ডায়েরি আছে জাদুঘরে। শহীদ পরিবারের সদস্যরা এগুলো জাদুঘরে দান করেছেন। পরে মুক্তিযুদ্ধের আরও নিদর্শন এখানে স্থান পায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের উৎসাহে ২০১৪ সালের ১৭ মে খুলনায় এর যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে ময়লাপোতা এলাকার শেরেবাংলা রোডের একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৫ সালের আগস্টে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগরের ২৬ সাউথ সেন্ট্রাল রোডের দ্বিতল একটি বাড়ি উপহার দেন। সংস্কারের পর ২০১৬ সালের ২৬ মার্চ সেই বাড়িতে স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে এটির যাত্রা শুরু। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে সেখানে প্রায় ৩২ কোটি ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে ছয়তলা ভবন নির্মাণ হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থে গণপূর্ত অধিদফতর ভবনটি নির্মাণ করেছিল। খুলনার দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাগুলোর মধ্যে এটি দ্বিতীয়। ওই বছরের মে মাসে এটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। চালু ছিল মাত্র এক মাস।

২০২৪ সালের ২০ জুলাই সংস্কারকাজ করার জন্য ও কারফিউর কারণে জাদুঘর বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা না দেওয়াকে কেন্দ্র করে জাদুঘরের সামনে একটি হাসপাতালে ভাঙচুর চালান আন্দোলনকারীরা। তখন জাদুঘরের প্রধান ফটকও ভাঙচুর হয়। পরবর্তী সময়ে নিরাপত্তা বিবেচনায় প্রধান ফটক টিন ও বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। গত ১৭ মাসে সেই তালা খোলা হয়নি। এখন পুরো জাদুঘর বন্ধ আছে। এর মধ্যে সংস্কারকাজ কিংবা খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

জাদুঘর সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এর ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, শহীদদের চিঠিসহ ১৯২ ধরনের নিদর্শন রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সাড়ে তিন শতাধিক ছবিও আছে। আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে ১০ হাজারের বেশি ছবি, দুই হাজারের মতো ভিডিওসহ অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য নথি। তালাবদ্ধ থাকায় অধিকাংশ নিদর্শনগুলো নষ্ট হচ্ছে। প্রধান ফটক মেরামতের জন্য গণপূর্ত বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। জাদুঘর ও আর্কাইভ পরিচালনার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই টাকাও ছাড় হয়নি। এতে আর্থিক সংকটে প্রথম পর্যায়ে আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়। নিরাপত্তা, আর্থিক সংকটসহ বিভিন্ন কারণে জাদুঘর এখন বন্ধ রয়েছে। কবে খোলা হবে, তাও জানা নেই সংশ্লিষ্টদের।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। ১১ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়ে আসছে। জাদুঘর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের ১৭ মে উদ্বোধনের পর ২০ জুলাই সংস্কারকাজ করার জন্য ও কারফিউর কারণে এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ৪ আগস্ট ভবনের সামনের কিছু অংশ ভাঙচুর করা হয়। এতে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। এখন প্রয়োজনীয় সংস্কার ও মেরামত ছাড়া চালু করা যাচ্ছে না। বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছে। তারা মেরামতের জন্য কেমন বাজেট লাগবে, তা জানাবে। এরপর সংস্কার করে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাদুঘরের ট্রাস্টি সম্পাদক বাহারুল আলম বলেন, ‘গত ১৭ মাস ধরে রাজনৈতিক কারণে জাদুঘরের অনুদান ও চালুর উদ্যোগ বন্ধ আছে। এটি চালু করতে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। জাদুঘরে একাত্তার, নব্বই, চব্বিশ–সব গণআন্দোলনের ইতিহাস রাখার প্রস্তাব দিয়েছি। এরপরও আশানুরূপ সাড়া পাইনি। বিদ্যুৎ বিল, স্টাফ বেতনসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে বছরে ৬০-৬৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। সরকারিসহ সব ধরনের অনুদান এখন বন্ধ। সরকারি অনুদান ছাড়া চালানোর অন্য কোনও উপায় নেই।’

খুলনা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মনিরুজ্জামান মনি বলেন, ‘জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে সরকারিভাবে গণহত্যা জাদুঘরটি পরিচালনা করা প্রয়োজন। ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিছু রাজনৈতিক কার্যক্রমের কারণে উদ্যোগটির গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা কমে গিয়েছিল। তারপরও মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরতে এটি দ্রুত চালু করা উচিত। বিষয়টি নিয়ে আমরা আগের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছি। তেমন সাড়া পাইনি। নতুন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলবো।’

এ ব্যাপারে খুলনার জেলা প্রশাসক আ স ম জামশেদ খোন্দকার বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। খোঁজ নিয়ে গণহত্যা জাদুঘরটি চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’

সৌজন্যে ঃ জাগো নিউজ

কা/আ 

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত