হাতকড়ায় লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০:৪৬ |  আপডেট  : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:৪৮

আদালত প্রাঙ্গণে আসামি আনা-নেওয়ার সময় হাতকড়া পরানো নিয়ে সবসময়ই সমালোচনা করে থাকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিকদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় পিছে হাত দিয়ে হাতকড়া পরানোর ছবি প্রকাশিত হলে নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তারা এমন ভয়াবহ আসামি কিনা যাদের এভাবে পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে আনতে হবে। মানবাধিকারকর্র্মীরা বলছেন, হাতকড়া পরানো মানে আসামিকে শাস্তি দেওয়া। এতে বন্দির অধিকার লঙ্ঘিত হয়।

আইনজীবীরা বলছেন, পুলিশ রেগুলেশনের ৩৩০ থেকে ৩৩২ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আসামির পলায়ন রোধের জন্য তাদের হাতকড়া পরানো যাবে। আসামির ন্যাচার ও ক্যারেক্টারের আলোকে হাতকড়া পরানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে পুলিশ। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, আসামিদের ও আদালতের নিরাপত্তার জন্যই এটা করতে হয়।

গত ২৮ আগস্ট রাজধানীর সেগুনবাগিচার রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষার দাবিতে ‘মঞ্চ ৭১’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের আয়োজন ছিল। ওই আয়োজনে মব সৃষ্টি করে সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন ও সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নাসহ ১৬ জনকে মারধর করে আটক রাখা হয়। পরে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় পরের দিন ১৬ জনকেই হাতকড়া পরিয়ে আদালতের কাঠগড়ায় তোলা হয়। আবার নেওয়ার সময় পিছমোড়া করে বাধা হয় সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নার হাত।

এ সময় তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, এই দেখেন আমার হাতে হাতকড়া। তার পেছনে পিছমোড়া করে হাত বাঁধা, সেটা দেখানোর চেষ্টা করেন। পুলিশ সদস্যরা তাকে বাধা দেন। তখন আবারও পান্না চিৎকার করে বলেন, ‘হাতকড়া পরাবেন, দেখাতে দেবেন না, এটা কোন ধরনের কথা।’ এ কথা তিনি বার বার বলতে থাকেন। আর দুই জন পুলিশ সদস্য তার দুই বাহু শক্ত করে ধরে নিয়ে যান। 

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংগঠনগুলো যেকোনও ধরনের অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয়ভাবে শারীরিক বাঁধনের বিরোধিতা করে। শুধু পালানোর ঝুঁকি বা ক্ষতি প্রতিরোধের জন্য যখন কঠোরভাবে প্রয়োজন তখনই ব্যবহার করা যেতে পারে। হাতকড়া শাস্তি বা অপমানের জন্য ব্যবহার করা হলে সেটিকে অবমাননাকর আচরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটির মতে, আইসিসিপিআর’র ধারা ৭ অনুযায়ী, যেকোনও নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ নিষিদ্ধ। হাতকড়া পরা ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করাকে অপমানজনক হিসেবে সমালোচনা করে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।   

হাতকড়া পরানোর বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী এহসানুল হক সমাজীর জুনিয়র অ্যাডভোকেট তাওহিদুল ইসলাম সজিব বলেন, পুলিশ রেগুলেশনের ৩৩০ থেকে ৩৩২ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আসামির পলায়ন রোধের জন্য তাদের হাতকড়া পরানো যাবে। আসামির ন্যাচার ও ক্যারেক্টারের আলোকে পুলিশ হাতকড়া পরানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। সেটা রশি বা ডান্ডাবেড়ি যাই হোক, বিষয়টা পুলিশ দেখবে।

৮৫ বছর বয়সী আমির হোসেনসহ বয়স্ক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাতকড়া পরানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনে তাদের বিশেষ কোনও সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব এ বিষয়ে খেয়াল রাখা।

এটাকে সুস্পষ্টভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অবহিত করে মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, হাতকড়া পরানো আসামিদের জন্য এক ধরনের শাস্তি। এতে একজন বন্দির অধিকার লঙ্ঘিত হয়। আমাদের দেশে পুলিশি আইনে হাতকড়ার কথা বলা আছে। আসামির ধরনের আলোকে পুলিশকে হাতকড়া পরাতে দেখা যায়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাফিজুল ইসলাম কার্জন ও সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্নার মতো মানুষদের হাতকড়া পরানো ঠিক নয়। একজন মানুষের জন্মগত কিছু অধিকার আছে। রাষ্ট্রের উচিত, তার সে অধিকারগুলো নিশ্চিত করা।

তিনি আরও বলেন, আমরা বিগত ১৫ বছর, আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের মধ্যে ছিলাম। এখনও যদি সেদিকে যেতে হয়, তাহলে সেটি বিবেকবর্জিত হবে। 

হাতকড়া পরানোর বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আদালতে আসামিরা এসে স্লোগান দেয়। অনেকে কাগজ ছুঁড়ে মারে। অনেকে হ্যান্ডশেক করে। এসব করে আদালতের পরিবেশ নষ্ট করছে। এতে একদিকে আসামিরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। আবার নিজেদের জীবনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করছে। হাত পিছমোড়া করে না রাখলে এসব বন্ধ হবে না। গত কয়েকদিন আগে, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে লতিফ সিদ্দিকীসহ অন্য আসামিরা যে পরিবেশ তৈরি করেছে, এছাড়া আর উপায় নেই। আদালতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হলে এটার দায়ও রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।

এভাবে হাতকড়া পরানো মানবাধিকারবিরোধী কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে। আদালতের নিরাপত্তা প্রথমে দেখতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটা আইনের শাসনের পরিপন্থি। আমরা বৈষম্যহীন সমাজের যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ভেবেছিলাম সবাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারবো। কিন্তু এ ধরনের মামলায় আসামিদের অপমানজনকভাবে যেভাবে আদালতে তোলা হচ্ছে এবং আমাদের কিছু আইনজীবী শারীরিকভাবে পুলিশের উপস্থিতিতে আসামিদের সঙ্গে যা করছেন তা থেকে আমি মনে করি, গত ১৫ বছর সময়কাল থেকে আমরা শিক্ষা নেইনি, সেই জায়গা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তাদের এসব মামলায় জড়ানো, তাদের আসামি হিসেবে হাতকড়া পরানোসহ বিভিন্ন অসঙ্গতি সমাজে জরাজীর্ণ অবস্থার তৈরি করছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার। আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ও আমাদের কিছু আইনজীবীও বাণিজ্য করছে। সেগুলো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। উচ্চ আদালতসহ সবার উচিত দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া, যেন কারও ক্ষেত্রে কোনও সাংবিধানিক অধিকার ভঙ্গ না হয়। আমরা সুশাসন চাই। 

সৌজন্যে : বাংলা ট্রিবিউন

কা/আ 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত