আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ থেকে অতীশ দিপঙ্কর

হাজার বছর আগের এক জীবন্ত বাঙালী

  সাহিত্য ও সংস্কৃতি ডেস্ক

প্রকাশ: ৯ অক্টোবর ২০২১, ১০:২৮ |  আপডেট  : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৭

শাশ্বত স্বপন
-----------


ভারতীয উপমহাদেশের পূর্বভাগে অবস্থিত বঙ্গ হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি সমুদ্রচারী প্রাচীন রাজ্য। মহাভারতে (৬।৯) অঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গ রাজ্য তিনটাকে ভারতবর্ষ বা প্রাচীন ভারতের নিকটবর্তী রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১২ বছর তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে অর্জুন বঙ্গ ও কলিঙ্গের সকল পবিত্র স্থানে এসেছিলেন।

বঙ্গ অঞ্চল এখন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা নামে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত । কিন্তু পূর্বে অবিভক্ত বাংলার বেশ কিছু অঞ্চল (ব্রিটিশ রাজের সময় কালে) বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্য বিহার, অসম ও ওড়িশা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই বাংলার অধিবাসীরা বাঙালী জাতি হিসেবে পরিচিত  এবং বাংলা ভাষা এই অঞ্চলের প্রধান ভাষা। হাজার বছর আগের কবি ভুসুক পা এর কবিতায় দেখতে পাই ‘‘বাজ ণাব পাড়ী পঁউআ খালে বাহিউ অদব বঙ্গালে দেশ লুড়িউ    আজি ভুসুক বঙ্গালী ভইলী...।’(পদ ৪৯) 

গবেষণা করে দেখা গেছে, বঙ্গ, বাঙ্গালী ও বাংলা ভাষার ইতিহাস অতি প্রাচীন| প্রাচীন বাঙ্গালীদের মধ্যে আমরা চর্যাপদ থেকে লুইপা, কুক্কুরিপা, চাটিল্লপা, ভুসুকপা, বিরুপা, সরপা, তিলুপা প্রমুখের নাম জানতে পারি।যদিও এঁরা বাঙালী কিনা তা নিয়ে যেমন বিতর্কআছে, তেমনি এদের প্রকৃত নাম নিয়ে্ও নানান বিতর্ক আছে। 

কিন্ত বিতর্কহীন সবচেয়ে প্রাচীন একজন বাঙ্গালীর নাম আমার বলতে পারি? হ্যাঁ, তিনি বিক্রমপুরের বজ্রযোগীনির গ্রামের আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ, বিশ্বব্যাপী অতীশ দিপঙ্কর নামে তিনি বিখ্যাত।অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ইতিহাসখ্যাত পণ্ডিত, যিনি পাল সাম্রাজ্যের দশম ও একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত হিসেবে স্বীকৃত। একইসঙ্গে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু, দার্শনিক ও ধর্ম প্রচারক।

সেই সময়ে বজ্রযোগীনি গ্রামটি ছিল পাল সাম্রাজের বঙ্গ রাজ্যের বিক্রমপুর পরগণাধীন।এই গ্রামে গৌড়ীয় রাজপরিবারে তিনি ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন। হাজার বছর আগের সেই স্থানটি বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগন্জের সদর উপজেলার রামপাল ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থান এখনও 'নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা' নামে পরিচিত।

মহা মহোপাধ্যায় সতীশ্ চন্দ্র বিদ্যাভূষণ ও রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতানুসারে, পালযুগে মগধের পূর্ব সীমান্তবর্তী প্রদেশ অঙ্গদেশের পূর্ব প্রান্তের সামন্তরাজ্য সহোর, যা অধুনা ভাগলপুর নামে পরিচিত, তার রাজধানী বিক্রমপুরীতে সামন্ত রাজা কল্যাণশ্রীর ঔরসে রাণী প্রভাবতী দেবীর গর্ভে ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে অতীশ দীপঙ্করের জন্ম হয়।

ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। তিন ভাইয়ের মধ্যে অতীশ ছিলেন দ্বিতীয়। তার অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। অতীশ খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেন। কথিত আছে, তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তবে পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায়। যদিও এসব তথ্যের যুক্তিযুক্ত কোন প্রমাণ মিলে না।

প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন মায়ের কাছে। তিন বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায় পড়তে শেখা ও ১০ বছর নাগাদ বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারার বিরল প্রতিভা প্রদর্শন করেন তিনি। মহাবৈয়াকরণ বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নালন্দায় শাস্ত্র শিক্ষা করতে যান।

বৌদ্ধ পন্ডিত, ধর্মগুরু ও দার্শনিক।  দশম-একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি পন্ডিত । মায়ের নিকট এবং স্থানীয় বজ্রাসন বিহারে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১২ বছর বয়সে নালন্দায় আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন । ১২ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বোধিভদ্রের গুরুদেব অবধূতিপাদের নিকট সর্বশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বিক্রমশীলা বিহারের উত্তর দ্বারের দ্বারপন্ডিত নাঙপাদের নিকট তন্ত্র শিক্ষা করেন।  তিনি বিখ্যাত বৌদ্ধ গুরু জেতারির(জেত্রির) নিকট  বৌদ্ধধর্ম ও শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। মতান্তরে মহাবৈয়াকরণ বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নালন্দায় শাস্ত্র শিক্ষা করতে যান।  এ সময় তিনি সংসারের প্রতি বিরাগবশত গার্হস্থ্যজীবন ত্যাগ করে ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের সঙ্কল্প করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গিয়ে রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং বৌদ্ধশাস্ত্রের আধ্যাত্মিক গুহ্যবিদ্যায় শিক্ষালাভ করে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে ভূষিত হন। মগধের ও দন্তপুরী বিহারে মহাসাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের নিকট  উপসম্পদা দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর নতুন নামকরণ হয় ‘দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।একত্রিশ বছর বয়সে তিনি আচার্য ধর্মরক্ষিত কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ ভিক্ষুদের শ্রেণিভুক্ত হন। পরে দীপঙ্কর মগধের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আচার্যদের নিকট কিছুকাল শিক্ষালাভ করে শূন্য থেকে জগতের উৎপত্তি এ তত্ত্ব (শূন্যবাদ) প্রচার করেন।

দীপঙ্কর ১০১১ খ্রিস্টাব্দে শতাধিক শিষ্যসহ মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপে (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ) গমন করেন এবং আচার্য ধর্মপালের কাছে দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করেন এবং ৪৩ বছর বয়সে মগধে ফিরে আসেন। মগধের তখনকার প্রধান প্রধান পন্ডিতদের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় ও বিতর্ক হয়। বিতর্কে তাঁর বাগ্মিতা, যুক্তি ও পান্ডিত্যের কাছে তাঁরা পরাজিত হন। এভাবে ক্রমশ তিনি একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী পন্ডিতের স্বীকৃতি লাভ করেন। এ সময় পালরাজ প্রথম মহীপাল সসম্মানে তাঁকে বিক্রমশিলা (ভাগলপুর, বিহার) মহাবিহারের আচার্যপদে নিযুক্ত করেন।  বিক্রমশিলাসহ ওদন্তপুরী ও সোমপুর বিহারে দীপঙ্কর ১৫ বছর অধ্যাপক ও আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। সোমপুর বিহারে অবস্থানকালেই তিনি মধ্যমকরত্নপ্রদীপ গ্রন্থের অনুবাদ করেন বলে কথিত হয়।এ সময় মহীপালের পুত্র নয়পালের সঙ্গে কলচুরীরাজ লক্ষমীকর্ণের যে যুদ্ধ হয়, দীপঙ্করের মধ্যস্থতায় তার অবসান ঘটে এবং দুই রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়।

আরেক তথ্য থেকে জানতে পারি, বজ্রযানী তন্ত্রের চর্যাগীতিগুঞ্জিত গণচক্রে সুরা ও সাধনসঙ্গিনীসঙ্গে উপবেশন করে তাঁর  উপাধী হয়েছিল ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’। তারপরও কী জানি কোন অজ্ঞাত কারণে তন্ত্রের সেই পিচ্ছিল পন্থা পরিত্যাগ করে গ্রহণ করেছিলেন বৌদ্ধ শ্রমণের জীবন।শ্রামণ্যদীক্ষার পর তিনি পরিচিত হয়েছিলেন দীপংকর শ্রীজ্ঞান নামে। 

তিনি একাধারে প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীও ছিলেন। তিব্বতের থোল নামক একটি জায়গায় প্রবল বন্যায় স্থানীয় জনগণ খুব কষ্ট করতো। নানা জ্ঞানে পন্ডিত অতীশ দীপংকর তাঁর প্রকৌশল  জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সেখানে একটি বাঁধ নির্মান করে বন্যা প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা করেন। খাল খনন করে কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা করেন,  ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তিনি জনস্বার্থে চিকিৎসা শাস্ত্রের উপরও কিছু গ্রন্থ  রচনা করেন। এর ফলে তিব্বতের সমাজে এক নব যুগের সূচনা হয়।   তবে প্রকৌশলী ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীর চেয়ে একজন দার্শনিক ও ধর্মীয় গুরু হিসাবেই বিশ্বে তিনি বেশী পরিচিত।

দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনী, স্তোত্রনামাসহ তান্জুর নামে বিশাল এক শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেন।  বৌদ্ধ শাস্ত্র, চিকিৎসা বিদ্যা এবং কারিগরি বিদ্যা বিষয়ে তিব্বতী ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে তিব্বতীরা তাকে অতীশ অর্থাৎ মহাপন্ডিত (great scholar) উপাধীতে ভূষিত করে। তাই অতীত তিববতের যেকোনো বিষয়ের আলোচনা দীপঙ্করকে ছাড়া সম্ভব নয়।এসব গ্রন্থ তিববতে ধর্ম প্রচারে সহায়ক হয়েছিল। তিববতে তিনি অনেক সংস্কৃত  পুঁথি আবিষ্কার করেন এবং নিজহাতে সেগুলির প্রতিলিপি তৈরি করে বঙ্গদেশে পাঠান। অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ তিনি ভোট (তিববতি), সংস্কৃত, পালি ভাষায় অনুবাদও করেন। তাঁর মূল সংস্কৃত ও পালি রচনার প্রায় সবগুলিই কালক্রমে বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু তিববতি ভাষায় সেগুলির অনুবাদ সংরক্ষিত আছে।দীপঙ্কর তিববতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনীগ্রন্থ, স্তোত্রনামাসহ ত্যঞ্জুর নামে এক বিশাল শাস্ত্রগ্রন্থ সঙ্কলন করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন।  তিব্বতি মহাগ্রন্থ ত্যঞ্জুরে তাঁর ৭৯টি গ্রন্থের তিববতি অনুবাদ সংরক্ষিত আছে। দীপঙ্করের রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে বোধিপথপ্রদীপ, চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ, সত্যদ্বয়াবতার, মধ্যমোপদেশ, সংগ্রহগর্ভ, হৃদয়নিশ্চিন্ত, বোধিসত্ত্বমণ্যাবলি, বোধিসত্ত্বকর্মাদিমার্গাবতার, শরণাগতাদেশ, মহযানপথসাধনবর্ণসংগ্রহ, শুভার্থসমুচ্চয়োপদেশ, দশকুশলকর্মোপদেশ, কর্মবিভঙ্গ, সমাধিসম্ভবপরিবর্ত, লোকোত্তরসপ্তকবিধি, গুহ্যক্রিয়াকর্ম, চিত্তোৎপাদসম্বরবিধিকর্ম, শিক্ষাসমুচ্চয় অভিসময় ও বিমলরত্নলেখনা উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ইতালির বিখ্যাত গবেষক গ্যুসেপ তুচ্চি দীপঙ্করের অনেকগুলো বই আবিষ্কার করেন। বিমলরত্নলেখ মূলত মগধরাজ নয়পালের উদ্দেশে লেখা দীপঙ্করের একটি সংস্কৃত চিঠি। চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ নামক গ্রন্থে দীপঙ্কর রচিত অনেকগুলি সংকীর্তনের পদ পাওয়া যায়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিস্টীয় দশম শতকে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজা যোশেও ধর্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিক্রমশীলায় দূত প্রেরণ করেন। বহু চেষ্টার পর দূত বিফল হয়ে ফিরে যায়। তারপরও রাজা ক্ষান্ত হলেন না। রাজা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু আশা পূরণ হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আরেক সুত্র থেকে জানতে পারি, গুজ রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ নাগ-ত্শো-লো-ত্সা-বা-ত্শুল-খ্রিম্স-র্গ্যাল-বা সহ কয়েক জন ভিক্ষুর হাতে প্রচুর স্বর্ণ উপঢৌকন দিয়ে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বত ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানালে দীপঙ্কর সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ সীমান্ত অঞ্চলে সোনা সংগ্রহের জন্য গেলে কারাখানী খানাতের শাসক তাঁকে বন্দী করেন ও প্রচুর সোনা মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করেন। ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ তাঁর পুত্র ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদকে মুক্তিপণ দিতে বারণ করেন এবং ঐ অর্থ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর জন্য ব্যয় করতে বলেন। ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ গুজ রাজ্যের রাজা হয়ে গুং-থং-পা নামে এক বৌদ্ধ উপাসককে ও আরো কয়েক জন অনুগামীকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর দায়িত্ব দেন। এরা নেপালের পথে বিক্রমশীলা বিহারে উপস্থিত হন এবং দীপঙ্করের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্ত সোনা নিবেদন করে ভূতপূর্ব রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদের বন্দী হওয়ার কাহিনী ও তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অভিভূত হন। আঠারো মাস পরে ১০৪০ খ্রিষ্টাব্দে বিহারের সমস্ত দায়িত্বভার লাঘব করে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন। তিনি বারো জন সহযাত্রী নিয়ে প্রথমে বুদ্ধগয়া হয়ে মিত্র বিহারের উদ্দ্যেশে  নেপালের রাজধানীতে উপস্থিত হন । অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকগণ এ দলকে অভ্যর্থনা জানান; পথেও বহু স্থানে তাঁরা অভ্যর্থিত হন। নেপালের রাজা অনন্তকীর্তি দীপঙ্করকে বিশেষভাবে সংবর্ধিত করেন। নেপালরাজের আগ্রহে এক বছর সেখানে কাটান। তিনি সেখানে ‘খান-বিহার’ নামে একটি বিহার স্থাপন করেন এবং নেপালের রাজপুত্র পদ্মপ্রভকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন। এরপর নেপাল অতিক্রম করে থুঙ বিহারে এলে তাঁর সঙ্গী র্গ্যা-লো-ত্সা-বা-ব্র্ত্সোন-'গ্রুস-সেং-গে অসুস্থ হয়ে মারা যান। ১০৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতের পশ্চিম প্রান্তের ডংরী প্রদেশে পৌছন। সেখানে পৌছলে ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ এক রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করে তাঁকে থোলিং বিহারে নিয়ে যান। এখানে দীপঙ্কর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বোধিপথপ্রদীপ রচনা করেন। ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুরঙে, ১০৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সম-য়ে বৌদ্ধ বিহার ও ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দে বে-এ-বাতে উপস্থিত হন।[ তিববতরাজ চ্যাং চুব দীপঙ্করের শুভাগমন উপলক্ষে এক রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করেন, যার দৃশ্য সেখানকার একটি মঠের প্রাচীরে আজও আঁকা আছে। সংবর্ধনা উপলক্ষে শুধু দীপঙ্করের উদ্দেশেই ‘রাগদুন’ নামক এক বিশেষ ধরনের  বাদ্যযন্ত্র নির্মিত হয়েছিল। এ সময় রাজা চ্যাং চুব প্রজাদের উদ্দেশে ঘোষণা করেন যে, দীপঙ্করকে তিববতের মহাচার্য ও ধর্মগুরু হিসেবে মান্য করা হবে এবং বাস্তবে দীপঙ্কর এ চেয়ে বেশি সম্মান পেয়েছেন।

তিববতে থো-লিং বিহার ছিল দীপঙ্করের মূল কর্মকেন্দ্র। এ বিহারে তিনি দেবতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এখান থেকেই তিনি তিববতের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিববতে বৌদ্ধধর্মের ব্যভিচার দূর হয় এবং বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মাচার প্রতিষ্ঠিত হয়। তিববতে তিনি মহাযানীয় প্রথায় বৌদ্ধধর্মের সংস্কার সাধন করেন এবং বৌদ্ধ ক-দম্ (গে-লুক) সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিববতবাসীরা তাঁকে বুদ্ধের পরেই শ্রেষ্ঠ গুরু হিসেবে সম্মান ও পূজা করে এবং মহাপ্রভু (জোবো ছেনপো) হিসেবে মান্য করে। তিববতের রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ক্ষমতার অধিকারী লামারা নিজেদের দীপঙ্করের শিষ্য এবং উত্তরাধিকারী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। তিববতের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে দীপঙ্করের প্রভাব অদ্যাপি বিদ্যমান। তিববতে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে তিনি তিববতের একটি নদীতে বাঁধ দিয়ে বন্যা প্রতিরোধের মাধ্যমে জনহিতকর কাজেও অংশগ্রহণ করেনে।

 তিব্বতে গমনের আগে তিনি ইতিহাসখ্যাত বিক্রমশীলা, দন্তপুরী ও সোমপুর বিহারে দীর্ঘ দিন অধ্যাপনা ও আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন।দীপঙ্কর তিব্বতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে প্রবিষ্ট তান্ত্রিক পন্থার অপসারণের চেষ্টা করে বিশুদ্ধ মহাযান মতবাদের প্রচার করেন। বোধিপথপ্রদীপ রচনাকে ভিত্তি করে তিব্বতে ব্কা'-গ্দাম্স নামে এক ধর্ম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়।

দীপঙ্কর সুদীর্ঘ প্রায় ১৩ বছর তিব্বতে অবস্থান করেন।তিনি যখন তিব্বতে রওনা করেন তখন তাঁর বয়ষ ঊনষাট। এই বয়সে নিরাপদে বিশ্রামে  না থেকে তিনি তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মে সংস্কারের মতো শ্রমসাধ্য কঠিন কাজ করতে করতে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরের কাছে চে-থঙের দ্রোলমা লাখাং (লেথান পল্লী)তারা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর সমাধিস্থল লেথান তিববতিদের তথা সারা বিশ্বের বৌদ্ধ জাতিদের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুন দীপঙ্করের পবিত্র চিতাভস্ম চীন থেকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে আনা হয় এবং তা বর্তমানে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে সংরক্ষিত আছে।  

তথ্যসূত্র
১.  "Portrait of Atisha [Tibet (a Kadampa monastery)] (1993.479)"। Timeline of Art History। New York: The Metropolitan Museum of Art, 2000–। October ২০০৬। 
২.  "চন্দ্রগর্ভ থেকে শ্রীজ্ঞান" - ত্রৈমাসিক ঢাকা, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা ১২
৩.  অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের খোঁজে,অদিতি ফাল্গুনী, দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা থেকে প্রকাশের তারিখ: ২৬-০৯-২০১১ খ্রিস্টাব্দ।
৪.  দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ, বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর ১৯৭৫, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। প্রথম খণ্ড। জানুয়ারি ২০০২।
৫.   তিব্বতে সওয়া বছর - রাহুল সাংকৃত্যায়ন, অনুবাদ - মলয় চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক - চিরায়ত প্রকাশন প্রাইভেট লিমিটেড, ১২ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩, ISBN 81-85696-27-6
 ৬.   মুন্সিগঞ্জের বজ্রযোগিনী গ্রামে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের বাস্ত ভিটা, মো: রুবেল, বাংলাদেশ বার্তা ডট কম। ঢাকা থেকে প্রকাশের তারিখ: ৮ মার্চ, ২০১২ খ্রিস্টাব্দ। 
৭.  স্বামী অভেদানন্দের কাশ্মীর ও তিব্বত ভ্রমণ - প্রকাশক- শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলকাতা ৭০০০০৬, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৮৮৪৪৬-৮৩-৪
৮.অতীশ দীপঙ্করের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং জন্মসূত্র মতভেদ ফেরদৌস জামান ঃ রাইজিংবিডি ডট কম 
৯. Shantarakshita (author); Jamgon Ju Mipham Gyatso (commentator); Padmakara Translation Group (translators)(2005). The Adornment of the Middle Way: Shantarakshita's Madhyamakalankara with commentary by Jamgön Mipham. Boston, Massachusetts, USA: Shambhala Publications, Inc. আইএসবিএন ১-৫৯০৩০-২৪১-৯ (alk. paper)
 

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত