প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী : মিতা হক স্মরণে, কিছু কথা 

  কেশব মুখোপাধ্যায়

প্রকাশ: ২৪ মে ২০২১, ১০:৪৬ |  আপডেট  : ৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩৮

আমাদের শৈশবে রেডিও ছিল বিনোদনের এক প্রধান মাধ্যম । আজ কালের বিবর্তনে যা ডাকবাস্কের মতো প্রায় অকেজো এবং অব্যবহৃত বস্তুতে পরিণত। 

রেডিও ছাড়া বাড়িতে গ্রামাফোন (কলেরগান) থাকায় পছন্দের রেকর্ড বাজিয়ে নানা গান শোনার ব্যবস্থা ছিল । রেডিওর মিডিয়াম ওয়েভের আকাশবাণী কলকাতা 'ক' কেন্দ্রের পাশেই ছিল ঢাকা বেতার কেন্দ্র । সামান্য চুল পরিমাণ নব ঘোরালেই, ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনা যেত। অবশ্য মাঝে মাঝে এমন হতো ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনছি, কিন্তু ঢাকা কেন্দ্রের অনুষ্ঠান ক্রমশ ক্ষীণ হতে হতে শূন্যে মিলিয়ে পাশের কলকাতা কেন্দ্রের অনুষ্ঠন তার উপর চেপে বসে সোচ্চারে নিজেকে জাহির করতো। কিছু পরে অবশ্য আবার আকাশবাণী কলকাতা ক্ষীণ হয়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান নিজস্ব মহিমায় ফিরে আসতো । এইভাবেই কৈশোরে শুনেছি ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত নানা সময়ের নানা অনুষ্ঠান ।

ঢাকা রেডিও শোনার মূল আকর্ষণ ছিল দুটি । (এক) মা-বাবা, ঠাকুমা-দাদুর ফেলে আসা জন্মভূমিকে জানা-বোঝা। (দুই) আমাদের কৈশোরে পূর্ব বাংলা ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং পাকিস্তান সরকারের চোখে ভারত ছিল এক নিষিদ্ধ দেশ। দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন । যোগাযোগের একমাত্র মাত্র বাহন ছিল ইথার তরঙ্গে ভেসে আসা ঢাকা রেডিও । ঢাকা রেডিও থেকে কোনদিন, কোন সময় নাটক, কোন সময় রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান, কোন সময় নজরুলগীতি, কোন সময় পল্লীগান, কোন সময় সাহিত্য-সংস্কৃতি এ সব আমাদের জানা ছিল ।

বাংলাদেশের শিল্পীদের গান সামনাসামনি বসে প্রথম শোনার সুযোগ হয় ১২৫-তম রবীন্দ্র-জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে । ওই উপলক্ষে ১৯৮৬ -র জুন মাসে বাংলাদেশের একদল শিল্পী আমন্ত্রিত হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন ।  বাংলাদেশের শিল্পীদের আমন্ত্রণের প্রশ্নে পশ্চিমবাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু-র বিশেষ আগ্রহের কথা তখন শুনেছিলাম । এমনিতে শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কোনো কালেই জ্যোতি বসু মাথা ঘামাননি । এই প্রশ্নে কোনো ভনিতা না করে সোজাসুজি বলতেন, এ সব তিনি বোঝেন না, ... । ১৯৮৬-র জুন মাসে কলকাতার রবীন্দ্রসদন মঞ্চে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের শিল্পীদের অনুষ্ঠানে জ্যোতি বসু হাজির হয়ে অনুষ্ঠান শুনেছেন, এবং আমন্ত্রিত শিল্পীদের সঙ্গে হাসিখুশি মুখে আলাপ করেছেন । শুনে ছিলাম ওই দিন দিল্লি থেকে কলকাতা বিমান বন্দরে নেমে, তিনি সোজা রবীন্দ্রসদন মঞ্চে চলে এসেছিলেন, বাংলাদেশের শিল্পীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, তাঁদের অনুষ্ঠান দেখতে ও শুনতে । সেই প্রথম কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে জ্যোতি বাবুকে এমন হাসিখুশি মেজাজে দেখা যায় ।

রবীন্দ্রনাথের ১২৫-তম জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানে কলকাতায় আমন্ত্রিত  বাংলাদেশের শিল্পী দলের নেতৃত্বে ছিলেন, আমানুল্লা চৌধুরী । এসেছিলেন আবদুল আহাদ, কলিম শারাফী এবং একঝাঁক তরুণ শিল্পী । বাংলাদেশের শিল্পীদের অনুষ্ঠান শেষে, বাংলাদেশের প্রবীণ শিল্পীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে,  কলকাতার 'একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপন কমিটি'র পক্ষ থেকে নানা প্রচারপত্র  এবং কিছু কাগজপত্র তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে ছিলাম ।  ওই সূত্রে ওইদিন আলাপ হয় বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী কলিম শারাফী-র সঙ্গে । পরবর্তী সময়েও শিল্পী কলিম শারাফী-র সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ ছিল । 

(দুই)
রবীন্দ্রনাথের  ১২৫-তম  জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে আগত শিল্পীদের সঙ্গে কি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মিতা হক ছিলেন ? কবির ১২৫-তম জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠানেই কি  মিতা হক-এর গান প্রথম শুনেছিলাম, না পরবর্তী সময়ে ? ঠিক স্মরণ করতে পারছিনা । তবে মনে আছে  রবীন্দ্র-সদন মঞ্চেই প্রথম শুনি শিল্পী মিতা হক-এর গান । তখন ওই শিল্পীর নামও শোনা ছিল না । যখন মিতা হকের গান রবীন্দ্রসদন মঞ্চে প্রথম শুনি, সেদিন বেশ কয়েকজন শিল্পীর মধ্যে তরুণী মিতা হকও ছিলেন একজন । দুটি অথবা তিনটি একক রবীন্দ্রসংগীত তিনি সেদিন পরিবেশন করেছিলেন । তাঁর কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান যেন হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে এসে প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল ।  কলকাতার রবীন্দ্রসদন মঞ্চে প্রথমবার তাঁর গান শোনার দিন থেকেই, তাঁর গানের আগ্রহী শ্রোতা হয়ে যাই । এখন যেমন ইউ টিউব বা অন্য মাধ্যমে গান শোনার নানা সুযোগ, ব্যবস্থা আছে, সেই সময়‌ আগ্রহ থাকলেও বাংলাদেশের শিল্পীদের গান শোনার সুযোগ বা সুবিধা তেমন ছিল না । 

মিতা হক তাঁর গানের চর্চা ইত্যাদি বিষয়ে নিজেই বলেছেন, পারিবারিক পরিবেশের কারণেই মাতৃগর্ভ থেকেই তাঁর  সঙ্গে সংগীতের পরিচয়। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে । তাঁর জেঠু ছিলেন স্বনামধন্য ওয়াহিদুল হক এবং জেঠিমা সনজিদা খাতুন । নানা অপপ্রচার, কুৎসা এবং বিরোধিতার মধ্যে দাঁড়িয়ে এই দুজন আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে পূর্ববাংলায়, বর্তমান বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের গান এবং রবীন্দ্রদর্শন প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে  উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন, এখনও রেখে চলেছেন সনজিদা খাতুন । ওয়াহিদুল হক এবং সনজিতা খাতুনদের প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'ছায়ানট'-এর উদ্যোগে ১ বৈশাখ ১৩৭৪ (১৯৬৭) ঢাকায় রমনার বটমূলে  বাংলা নববর্ষ পালনের যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, তা পূর্ববাংলায় বর্তমান বাংলাদেশে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় এক বড় ভূমিকা ও অবদান রেখেছে, রেখে চলেছে ।

জেঠু ওয়াহিদুল হককে মিতা হক ডাকতেন 'বড়দা কাকা' । এ সম্পর্কে মিতা হক জানিয়েছেন, তাঁর বাবা ওয়াহিদুল হককে বড়দা ডাকতেন, সেই সূত্রে মিতা হকের  বড়দা কাকা ছিলেন ওয়াহিদুল হক ।

বিখ্যাত তবলা বাদক ওস্তাদ মহম্মদ হোসেন খান-এর কাছে নারাবেঁধে মিতা হকের গান শেখা শুরু । ওই গুরুর কাছে ছয় বছর শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা নেন মিতা হক । এরপর ওয়াহিদুল হক এবং সনজিদা খাতুন-এর কাছে সংগীতের তালিম নিয়েছেন ।

শুধু সংগীত শিক্ষা নয়, ওই দুজনকে  শিক্ষক হিসেবে পেয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে মিতা হক আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন বাঙালির জীবন দর্শন । তাঁর নিজস্ব জীবন চর্চা এবং দর্শনে তা তিনি গ্রহণ করেছেন । মিতা হক-এর কাছে তাঁর বাঙালি পরিচয়টাই ছিল প্রধান এবং রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর কাছে এক অনন্ত আকাশ ।

ছায়ানট-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক যতদিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, প্রান্তিক অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে রবীন্দ্রনাথের গান ও তাঁর জীবন দর্শন প্রচার ও প্রসার ঘটাতে সমস্ত  উদ্যোগে অংশ নিয়েছেন 'জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন পরিষদ'-এর ব্যনারে । রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, মানবিকতা, সততা, মনুষ্যত্ব সব কিছুর সন্ধান পেয়ে তিনি সমৃদ্ধ হয়েছেন। এবং আমৃত্যু তিনি সেই সম্পদ তাঁর সংগীতের শ্রোতা এবং তাঁর  ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে সদা সচেষ্ট থেকেছেন । আন্তরিক  নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করেছেন বাঙালিকে সংস্কৃতি মনস্ক জাতি হিসেবে গডে তুলতে ।  এবং সেই লক্ষ্যে শুধু ঢাকায় নয়, সারা বাংলাদেশ জুড়ে নানা কর্মকান্ডে অংশ নিয়েছেন ।

(তিন)
১৯৬২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান আমলে মিতা হকের জন্ম  ।  তাঁর জন্মের সময় কালকেই তিনি আদর্শ বাঙালি সমাজ মনে করতেন । সেই সময়ের বাঙালি সমাজ ছিল বাঙালি জাতি পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ। সেই সময়ের বাঙালি সমাজ  মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে আপসহীন নানা সংগ্রামে অবতীর্ণ । তখন পূর্ববাংলার বাঙালি সমাজের ছিল এক এবং অভিন্ন লক্ষ্য ও একমুখী চিন্তা । তা ছিল বাঙালির স্বাধীনতা ও  মুক্তি অর্জন । সেইসব দিনে ঔপনিবেশিক পাকিস্তান শাসন -শোষণ বিরোধী বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল মুক্তি সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক বড় প্রেরণা ও শক্তি। ওই পটভূমিতে কেটেছে মিতা হকের শৈশব । শৈশব পেরনোর আগেই দেখেছেন জাতি মুক্তি এবং বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন। ওই সময়টাকে মিতা হক আদর্শ বাঙালি সমাজ বলে মনে করতেন ।

পরবর্তী সময়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তি বিদেশি অপশক্তির দ্বারা মদতপুষ্ট হয়ে, এক গভীর ষড়যন্ত্র সংগঠিত করে ১৯৭৫-এর ১৫ অগস্ট বাঙালি সমাজের দিক দর্শন পাল্টে উল্টো তা পিছন দিকে ঘুরিয়ে দেয় ।  ফলে পরিবর্তন ঘটে যায়  বহু রক্ত ও বাংলার মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাঙালির নিজস্ব জাতীয় চরিত্রের। এই প্রসঙ্গে মিতা হক দুঃখ করে বলেছেন, 'এখন বাংলাদেশের কোনো পাবলিক প্লেসের ছবি যদি কোথাও ছাপা হয়, তবে বোঝা মুশকিল যে এটা তুরস্ক, সৈদী আরব না বাংলাদেশ' ! 

চার)
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যিনি প্রথম শান্তিনিকেতনে এসে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তিনি শিল্পী পাপিয়া সারোয়ার । তাঁর পরে অবশ্য অনেকেই শান্তিনিকেতনে এসে সংগীতের তালিম নিয়ে তাঁদের সংগীত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন ।‌ এই দিক থেকে শিল্পী মিতা হক এক ব্যতিক্রম । কারণ তাঁর সংগীত শিক্ষা এবং বিকাশ সম্পূর্ণটাই ঘটেছে বাংলাদেশের নিজস্ব পরিমন্ডল এবং পরিবেশে । অবশ্য কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন যখন আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশে গিয়েছেন, মিতা হক সেখানে তাঁদের বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নিয়ে তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন  । মিতা হককে 'ছায়ানট' থেকে উত্তীর্ণ শিল্পী বলা যায় না । কারণ তিনি ছায়ানটে ভর্তি হলেও তিন-চারটির বেশি ক্লাস তিনি সেখানে করেননি । তবে তিনি যাদের কাছে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তাঁদের সবাই ছায়ানটের সংগীত শিক্ষক । 

প্রয়াত অর্থনীতিবিদ (বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী) একবার তাঁর কলকাতার আলিপুর পার্ক রোডের ফ্ল্যাটে বসে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাংলাদেশের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের গান ঠোঁট দিয়ে নয়, হৃদয় ও সত্তায় রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মবাণীকে ধারণ করে গান । যা কলকাতার অনেক শিল্পীর মধ্যেই অনুপস্থিত । অশোক মিত্র-র ওই মন্তব্যের যথার্থতা যাদের গান শুনে অনুভব করা যায়, প্রয়াত শিল্পী মিতা হক ছিলেন তাদের অন্যতম ।  এক্ষেত্রে তাঁর সংগীত শিক্ষাগুরু ওয়াহিদুল হক এবং গুরু মা সনজিদা খাতুনের অবদান সর্বাধিক । কারণ তাঁরা শুধু সংগীত শিক্ষাগুরু নয়, ছিলেন জীবনবোধের গুরু, ছিলেন পথপ্রদর্শক ।

অভিনেতা ও পরিচালক খালেদ খান ছিলেন মিতা হক-এর স্বামী। ২০১৩ সালে তিনি প্রয়াত হন। এই শিল্পী দম্পতির একমাত্র ফারহিন খান জয়িতা একজন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী।

করোনা আক্রান্ত হয়ে শিল্পী মিতা হক-এর অকাল প্রয়াণ (১১ এপ্রিল ২০২১)শুধু সংগীতে নয়, রবীন্দ্রচর্চায় এক বড় ক্ষতি ।

কেশব মুখোপাধ্যায়, কলকাতা

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত