প্রজন্মের ভাবনা: নির্বাচন ও ভোট

  অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

প্রকাশ: ৩ আগস্ট ২০২৩, ১৬:০৭ |  আপডেট  : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:১৭

যে প্রজন্ম ১৯৭১ সালের পরে জন্ম নিয়েছে ও জেনারেশন জেড, তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারের হত্যাকাণ্ড দেখেনি। কিন্তু তারা দেখেছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা এবং উনাদের পরিবারের কান্নার রোল। দেখেছে হ্যাঁ না ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বীর মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে কি নির্মমভাবে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য হত্যা করলো। এরপর জেনারেল এরশাদ যুগ। লুটতরাজ, লুট-পাট। বিএনপি, আওয়ামী লীগ সহ সকল বিরোধীদল, সুশীল, দুঃশীল, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, প্রগতিশীল, সাংবাদিক, জ্ঞানী, পণ্ডিত, শিল্পীর অভিযোগ এরশাদ স্বৈরাচার। আঁকলো স্বৈরাচারের কাটুন। প্রজন্ম দেখলো স্বৈরাচার প্রশাসনের সাহায্যে চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার সভায় গুলি করলো ও বোমা হামলায় ৫০ জন আহত হয়, হত্যা করলো ডা. শামসুল আলম খান মিলন ও নুর হোসেনকে। প্রজন্ম আস্থা রাখলো বিএনপির উপর। জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচার যেন হয়, আপোষহীন খালেদা জিয়ার অধীনে দেশ হবে সোনার বাংলা। কিন্তু হলো ভিন্ন। কিছু উন্নয়ন ছাড়া (যেমনঃ মুক্তবাজার অর্থনীতি, ভ্যাট প্রবর্তনসহ সহ নানামুখী সংস্কারমূলক কাজ, গার্মেন্টস শিল্প ও প্রবাসী আয়) দুইবারের শাসনে দেশ পেল দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার, আগষ্টের বোমা হামলা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জনগণকে হত্যা, জঙ্গি, রাজাকারের আস্ফালন, সংখ্যালঘুদের উপর অমানুষিক নির্যাতন, হিন্দুদের দেশ ত্যাগ, চট্টগ্রামের বৌদ্ধ পরিবারকে বাড়িতে বন্দি করে পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া, পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্তি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মদদে সন্ত্রাসীরা হত্যা, গুম, হাত-পা-রগ কেটে দেওয়া, চাঁদাবাজি, লুটপাট, ডাকাতি, নারীর শ্লীলতাহানি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ধর্মান্তরকরণের মত জঘন্য কর্মকাণ্ড শুরু করে। সংখ্যালঘুদের উপর অমানুষিক নির্যাতন, ধর্ষন, জমি সম্পত্তি দখল, মন্দিরের জমি দখল মত জঘন্য কর্মকাণ্ডর কারণে  সংখ্যালঘুরা ছিল দিশাহারা। নাশকতা করে সরকার উৎখাত করতে চেয়েছিল বিএনপি, বলে রায় দিয়েছে কানাডার আদালত।

এরপর প্রজন্ম আস্থা রাখলো আওয়ামী লীগের উপর। জনগণ চাইলো সকল হত্যার বিচার হোক, রাজাকারের বিচার হোক, দুর্নীতি বন্ধ হোক, সংখ্যালঘুরা নিরাপদ থাকুক, বিএনপির সময়ে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের বিচার হবে, দখল হওয়া সমত্তি ফিরে পাবে সংখ্যালঘুরা, উন্নয়ন হোক, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হোক, দেশ হোক সুখী সমৃদ্ধ। আওয়ামী লীগ কথা রাখলো, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হলো, রাজাকারের বিচার হলো, জঙ্গি দমন হলো, দুর্নীতির বিচার হলো। উন্নয়ন হলো। স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঈর্ষণীয় সাফল্য এলো। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে সামনের সারিতে পৌঁছালো বাংলাদেশ। এই সাফল্যের নেপথ্যে কৃষি, গার্মেন্টস এবং রেমিট্যান্স। শুধু অর্থনীতি নয়, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন হলো। বর্তমানে বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। সারা পৃথিবীতে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাতি দিয়েছে এই পণ্য। এ খাত থেকে রপ্তানি আয় দেশে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ। আইএমএফের হিসাবমতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৫ সালেই আমাদের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের ফলে তৈরি পোশাক, খাদ্য-পানীয়-তামাক, ইস্পাত, সিমেন্ট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, ভোজ্যতেল, রাবার ও প্লাস্টিক পণ্য, ইলেকট্রনিকস, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল প্রভৃতির উৎপাদন বেড়েছে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো ও রপ্তানি উভয়ই সম্ভব হচ্ছে। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হবে। গোল্ডম্যান স্যাক্স এর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চায়না এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও বিশ্বেও সম্ভাবনাময় ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ ম্যাকেনজি/ইউএসইউড রিপোর্টে বলা হচ্ছে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কারণে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমার বর্তমান হার হ্রাস পাওয়ায় আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থনের সম্ভাবনা রয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাংক "গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পরের অর্থ বছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার ৬. ২ হতে পারে। নিঃসন্দেহে, আজকের বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মতোই গতিময় এক প্রবৃদ্ধির পথরেখায় রয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ড ১৯৮০-৯০ দশকে মাথাপিছু আয় ২,৪০০ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর যে পথে এগিয়ে ওই মাথাপিছু আয়কে ৪,০০০ ডলারের ওপর নিয়ে গেছে, এই দশকে বাংলাদেশও সে পথে এগোনোর সম্ভাবনা তৈরি করেছে (বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২,৮০০ ডলার ছাড়িয়েছে)। এ পথে এগিয়ে যেতে পারলে ২০২৬-এর মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৪,০০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি সরকারি নথিতে বলা হয়েছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে ১ ট্রিলিয়ন ডলার (ইউএস)। যদি বর্তমান ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি অব্যাহত থাকে এবং প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের বেশি হলে ২০৩০ সাল নাগাদ তা অর্জিত হবে। প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেলেও ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করবে।

কিন্তু প্রজন্ম হারালো ভোট দেয়ার অধিকার। রাতে ভোট হলো, ভোট কেন্দ্রে গিয়ে পুলিশের বাঁধায় ভোট কেন্দ্র ত্যাগ করতে হলো, ঘুষ, বিচার বহির্ভূত হত্যা, র্র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নীতি, কূটনীতিকদের অমর্যাদাকর খবরদারি, অর্থ পাচার, সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, মন্দিরে হামলা, বৌদ্ধ বিহারে হামলা, বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যা, মন্ত্রীর কাছের লোকজনের কারণে বৌদ্ধ ভিক্ষুর উপর হামলা, রামুর বৌদ্ধ বিহার জ্বালিয়ে দেয়া, ভূমিমন্ত্রীর সকল অসামান্য সফলতার পরেও তার পাশের লোকজনের সংখ্যালঘুদের জমি বেনামে ক্রয় করে অর্থ পরিশোদ না করে দখল, সংখ্যালঘুরা হলো অনিরাপদ, বিএনপির সময়ে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের বিচার হলো না, দখল হওয়া সমত্তি ফিরে পেলো না সংখ্যালঘুরা। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয়-সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হলো। আটটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশের মধ্যে দ্বিতীয়-নিম্ন অবস্থান এবং ৩২টি এশিয়া-প্যাসিফিক দেশের মধ্যে চতুর্থ-নিম্ন। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। দুর্নীতি বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে । জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মতে, বাংলাদেশে অবৈধ সম্পদের পরিমাণ মোট জাতীয় আয়ের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ । বিশ্বব্যাংকের ‘ সাহায্য স্মারক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলোদেশে আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে শতকরা সাত ভাগ অর্থ ঘুষ দিতে হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় , স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে তার মাত্র ২৫ ভাগ প্রকৃতপক্ষে সংশ্লিষ্ট খাতে কাজে লাগানো হয়েছে , বাকি ৭৫ ভাগই লুটপাট হয়েছে।  জাতীয় অর্থনীতির ৫০ শতাংশ ব্ল্যাক মানি। দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়ার পরও সার্বিকভাবে বিচার বিভাগে দুর্নীতি বেড়েছে। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণায় বলছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) উদ্যাক্তাদের ৭৭.৯ ভাগকে ব্যবসা পরিচালনা করতে কোথাও না কোথাও ঘুস দিতে হয়। সরকারি দপ্তরের ঘুষ-দুর্নীতি এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। কেরানি থেকে শুরু করে শীর্ষ কর্মকর্তা অনেকেই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ মাদকদ্রব্যের ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে অবৈধ আয়ের প্রাথমিক উৎস হলো মাদক পাচার, ঘুষ, জালিয়াতি, জাল টাকা, সোনা চোরাচালান এবং মানব পাচার। টিআইবি জানিয়েছে, ২০২১ সালের জরিপে দেখা গেছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭৪.৪ শতাংশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে; এর পরেই রয়েছে পাসপোর্ট ৭০.৫ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮.৩ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬.৮ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্য সেবা ৪৮.৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৪৬.৬ শতাংশ এবং ভূমি সেবা ৪৬.৩ শতাংশ। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকে ২০২১ সালে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২২ সালে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থজমার পরিমাণে কমে ৫৫.২ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ বা প্রায় ৫৪০ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্র্যাংক। বর্তমানে অনিশ্চয়তার কারণে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও বিত্তবানরা সুইস ব্যাংককে নিরাপদ মনে করছেন না, তারা বেছে নিচ্ছেন লুক্সেমবার্গ, পানামা, বৃটিশ ভার্জিন, বার্মুডা, দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরকে।

প্রজন্ম ৭১ ও জেনারেশন জেডকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রজন্ম সাংবিধানিক ভোটের অধিকার চায়, দল নয় সৎ যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে চায়, বিরোধীদলের উপর নির্যাতন চায় না, অগ্নি সংযোগ বোমা হামলা চায় না, ইরান কম্বোডিয়া পাকিস্তান শ্রীলংকার পরিণতি চায় না, ভিসা নিষেধাজ্ঞা চায় না, কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সংঘাত চায় না। প্রজন্ম জেড এখন অনেক তথ্য রাখে। এখন প্রজন্মের প্রশ্ন: ভোট কাকে দেবো?

লেখকঃ অভিজিৎ বড়ুয়া অভি

কথা সাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত