আপনার জীবন নির্ভর করে আপনার মানসিকতায়

  সাদিয়া নওশিন

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২২, ১২:৪৪ |  আপডেট  : ১৬ মে ২০২৪, ১২:৫৪

ফাইল ছবি

টুশি ক্লাস এইটে পড়ে, চঞ্চল স্বভবের একটি মেয়ে। পড়াশোনায় মোটামুটি। একদিন ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করায় সে পড়া বলতে পারেনি। পড়া না পারলে সাধারণত শিক্ষক বেত দিয়ে প্রহার করেন, কান ধরে দাড়িয়ে থাকতে বলেন খুব বেশি হলে ক্লাস থেকে বের করে দেন। কিন্তু শিক্ষক তা না করে শুধুমাত্র একটি মন্তব্য করলেন যা পরবর্তী দিন গুলোতে টুশির জীবনে প্রভাব ফেলতে চলেছে। শিক্ষক বললেন, "তোমার দেহের মত স্থুল তোমার মাথা, পড়াশোনা কি করে হবে।" লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল টুশি। অন্য ছাত্রছাত্রীগুলো হো হো করে হেসে ওঠায় শিক্ষক ধমক দিল, সবাই  ততক্ষনাত সবাই চুপ হয়ে গেলেও মুখ চেপে হাসছিল। এরপর থেকে টুশিকে সবাই মাথামোটা বলে ডাকে।

অজপাড়া গায়ের ছেলে কৃষ্ণ। গায়ের রঙ বেশ কালো বলে বাবা নাম রেখেছে কৃষ্ণ। অসচ্ছল পরিবারের ছেলে, অন্যের ক্ষেতে কাজ করে দিন কাটে তার। অর্থাভাবে পড়াশোনা হয়নি। তবে খুব ভাল গান করতে পারে। ভদ্রস্বভাবের বলে লোকে তাকে পছন্দ করে। কিন্তু এইসব উপন্যাসে ঘটে তার গুণ ছেপে যায় তার কালো রং এর আড়ালে। লোকে তার সুন্দর নামটি বাদ দিয়ে কাইল্লা বলে ডাকে। অজপাড়াগায়ের ছেলে এই কালো রঙ কে তার দূর্ভাগ্য মেনে নিয়ে জীবন পার করে দিচ্ছে।

মাস্টার্স পাশ মেয়ে লাবনী, একটি কোম্পানিতে বেশ ভাল অংকের বেতনে চাকরি করছে। চালচলন বেশভূশায় রুচির ছাপ পাওয়া যায়। সদ্য বিবাহ করেছেন তার পরিবারের পছন্দে। তার স্বামী শাওন পেশায় একহন ইঞ্জিনিয়ার। তার শাশুড়ি ননদও তাকে আপন করে নিয়েছে। একদিন দূর সম্পর্কের এক আত্নীয় বেড়াতে এসেছে। সে এর আগে লাবনীকে দেখেনি। লাবনী ঘোমটা টেনে সালাম করতে এল, লাবনীকে দেখেই সেই আত্নীয় বলল, " বাড়ির ফ্যান গুলো ভালোভাবে মুছতে পারবে, বউ তো তালগাছ, আমাদের ছেলের থেকেও লম্বা, যাই হোক ভাল ভাবে থাকলেই ভাল।" 

বেশ কিছুদিন ধরে জ্বরে ভুগছিল জাহিদ। আজ সকাল থেকে একটু ভাল বোধ করছে সে। অনেকদিন ভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি তাই ভাবল আজ ভার্সিটিতে যাবে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা কিছু পড়াও হয়নি। বাসা থেকে বেরিয়ে বাসের জন্য দাড়িয়ে আছে । তখন এলাকার এক আংকেলের সাথে দেখা,
'আরে জাহিদ, কি অবস্থা'
'স্লামালিকুম আংকেল, এই তো ভাল।'
' তা এত শুকাচ্ছ কেন দিন দিন? মা খাবার দেয় না? ' কন্ঠস্বর নিচু করে 'নাকি নেশা টেশা ধরেছ/'

শায়লা আহমেদ একটি এড ফার্মে চাকরি করেন। আই সি টি নিয়ে পড়াশোনা আর সৃজনশীলতা থাকায় চাকরি পেতে তেমন কাঠঘর পোড়াতে হয়নি। তিনি ছয় মাসের মধ্যেই ভাল ভাল কিছু কাজ কোম্পানিকে দিয়েছেন। মালিকপক্ষ তার কাজ বেশ পছন্দ করছেন। এক বছরের মধ্যে তার বেতন হয় দ্বিগুন। শায়লা আহমেদ বেশ খুশি ছিলেন। তবে বেতন বাড়ার পর সহকর্মীদের আচরণে বেশ পরিবর্তন এসেছে। একদিন একজন বলেই ফেললেন, "রূপ থাকলে সবই সম্ভব, বাড়ি, গাড়ি, পয়সা।" 

উপরের ঘটনা গুলো আমরা আমাদের জীবনে প্রায় প্রতিদিনই দেখি। হয়তো আমরা স্বীকার হই হয়তো অন্যকে নিজের কথায় আহত করি। যারা আমরা অন্যকে আহত করি তাদের নিয়ে একটু কথা বলা প্রয়োজন। আমরা যারা অন্যকে আঘাত করে কথা বলি তারা আসলে তাদের ধারণাই নেই আমাদের সাধারণ কথা একটি মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। অনেকে সারাক্ষণ হীনমন্যতায় ভুগে, কারো সামনে যেতে চায়না, কথা বলেনা, কারো সাথে মিশেনা। মানসিক রোগী হয়ে যেতে পারে এমনকি বডি শেমিং এর কারণে আত্মহত্যার কথা ও আমরা শুনে থাকি। বাংলাদেশে ২০২২ সালের মার্চে প্রকাশিত এক জরীপ অনুযায়ী ৬৯.৯২ শতাংশ তরুণী শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন৷ ৩৭.২৪ শতাংশ তরুণী আত্মীয় স্বজনদের কথায় ও ইঙ্গিতে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন৷ বন্ধুবান্ধবের কাছে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ শতাংশ নারী৷  যখন আমরা অন্যকে হেয় করি তখন শুধু অন্যের ক্ষতি হয় তা নয় বরং নিজের মানসিকতার ব্যাপক ক্ষতি করে থাকি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে আপনি যত বেশি অন্যকে নেতিবাচকভাবে নিবেন আপনার মানসিক অবস্থা আরো কলুষিত হবে এবং মানসিক অবসাদ সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকবে। 

এখন যারা বডি শেমিং এর স্বীকার তাদের নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। যারা আপনাকে বডি শেমিং করছে তাদের নূন্যতম মানবিকতা নেই সেটা বুঝতে হবে। মানুষ তার কর্মে পরিচিতি পায় বাহ্যিক গঠনে নায় এই কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। অন্যের কথায় কান না দিয়ে নিজের লক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আপনি যখন সফল হবেন এই মানুষগুলোই আপনার প্রশংসা করবে। মাঝে মাঝে নম্রতার সাথে বডি শেমিং এর প্রতিবাদ করুন। তাহলে  এর প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে। দেশে অন্যান্য যৌন হয়রানির ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকলেও বডি শেমিংয়ের বিষয়ে আইন স্পষ্ট নয়৷ অন্য আইনগুলো দিয়ে মামলা করা বা থানায় অভিযোগ করা যায়। প্রয়োজনে আইনি শায়তা নিন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের দক্ষতা বাড়ান এবং আত্মবিশ্বাসী হন।

আমরা একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করছি। নিজেদের তথাকথিত আধুনিক বলে থাকি। আধুনিক শব্দটি ব্যাপক অর্থে বিশ্লেষণ করতে গেলে এর অর্থ দাঁড়ায় সমাজের তথাকথিত কাঠামো এবং গোড়ামি ভেঙ্গে মানবজাতির কল্যাণে জীবন গড়ে তোলা। কিন্তু আমরা তা না করে কেবল এক শ্রেণির গায়ের রঙ দেহ কাঠামো দেখে মানুষোকে বিবেচনা করি। আবার যখন তথাকথিত সেই কাঠামোর মধ্যে মানুষটি পরে যায় তখন তার চারিত্রিক ত্রুটি খোজার চেষ্টা করি। পৃথিবীতে নিখুত বলে কিছু নেই। পৃথিবীর সবই সুন্দর আবার সবই কুতসিত। সেটা নির্ভর করে আপনার মানসিকতার উপর আপনার জীবন কতটা সুন্দর হবে।

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত