অস্বীকার করলেও পৃথিবী কিন্তু ঘুরতেই থাকে

  লেলিন চৌধুরী

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৩০ |  আপডেট  : ১ মে ২০২৪, ১২:৩৭

মাঘের তীব্র শীত আর কনকনে ঠাণ্ডায় জনজীবন কম্পমান। এই হিমশীতল আবহাওয়ায় বিতর্কের উত্তাপ ছড়িয়েছে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকের একটি লেখা নিয়ে। নতুন পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে রচিত হয়েছে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান নামের বইটি। বইটিতে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’ শিরোনামের একটি অধ্যায়ে ‘শরীফার গল্প’ নামে একটি লেখা রয়েছে। বাংলাদেশের তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করার উদ্দেশে রচনাটির অন্তর্ভুক্তি হয়েছে।

শরীফার গল্প লেখাটি সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী অর্থাৎ ১৩-১৪ বছরের কিশোর-কিশোরীরে জন্য। এই বয়সটি হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকালের প্রাথমিক ধাপ। এ সময় শিশুদের মানবশরীর, বয়ঃসন্ধিকালীন মনো-দৈহিক পরিবর্তন, নারী-পুরুষের লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত সঠিক জ্ঞানদান করা হয়। এ বিষয়ে পৃথিবীর তাবৎ শিক্ষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা কমবেশি একমত। শরীফার গল্পের শরীফা নিজেকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলে পরিচয় দেন। বাংলাদেশের আইনে মানুষের লিঙ্গীয় পরিচয় তিনটি পুরুষ, নারী ও তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া। সরাসরি নারী ও পুরুষের পরিচয়ের বাইরে যারা, তারে সবাই তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে আন্তঃলিঙ্গীয় বা ইন্টার সেক্স, অতি নারী, অতি পুরুষ, ক্লাইনফেল্টার, অযৌন ইত্যাদিসহ বিস্তর ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নারী-পুরুষ পরিচয়ের বাইরে মানুষ কেন তৃতীয় লিঙ্গীয় হয়? এ রকম প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো গ্রহণযোগ্য একটিমাত্র মতবাদ বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনো নির্মিত হয়নি। তবে জিনগত, হরমোনের প্রভাব, মস্তিষ্কের বিন্যাস, পরিবেশের প্রভাব ইত্যাদির জটিল মিথস্ক্রিয়ায় তৃতীয় লিঙ্গের উদ্ভব হয়ে থাকে বলে বিজ্ঞানীরা মতপ্রকাশ করেছেন।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের যৌন আচরণ সম্পর্কে ঢালাওভাবে বলার ন্যূনতম কোনো সুযোগ নেই। তৃতীয় লিঙ্গের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো আন্তঃলিঙ্গীয় মানুষ। জন্মগতভাবে যেসব মানুষের শরীরে পুরুষ ও নারীর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কমবেশি উপস্থিতি থাকে, তারা হচ্ছে আন্তঃলিঙ্গীয়। এদের শরীরে অণ্ডকোষ ও ডিম্বাশয়ের পূর্ণ, আংশিক বা অতি-আংশিক উপস্থিতি থাকে। অন্যান্য অন্তস্তঃ ও বহির্জননাঙ্গের কমবেশি অংশ থাকে। সাধারণত ১.৭% মানুষ আন্তঃলিঙ্গীয় হয়ে জন্মগ্রহণ করে। তবে অধিকাংশের ক্ষেত্রে একটি লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য জোরালোভাবে প্রকাশিত হলে মৃদু বা দুর্বল অন্য বৈশিষ্ট্যটি চাপা পড়ে যায়। কারও ক্ষেত্রে দুটি বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হলেই শুধু সেটি দৃশ্যমান হয়। দুটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তার মনোগত যৌনবোধ ও শারীরিক সুবিধাদি বিবেচনা করে নারী বা পুরুষে রূপান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। যদিও চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আন্তঃলিঙ্গীয়দের সাধারণত কোনো ধরনের চিকিৎসা বা সার্জারির দরকার হয় না।

শরীফার গল্পে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই সমকামিতা ও রূপান্তরকামিতা (ট্রান্সজেন্ডার) প্রসঙ্গ আসেনি। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যে নারী ও পুরুষ পরিচয়ের বাইরে আরেকটি, শুধু সেটাই উল্লিখিত হয়েছে। কথিত সমালোচকরা ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মতো করে এখানে সমকামিতা ও রূপান্তরকামিতা টেনে এনে বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার পরিচয় দিয়েছেন। একজন ক্লাইনফেল্টার মানুষের অণ্ডকোষ অকার্যকর/ প্রায় অকার্যকর এবং শিশ্ন ক্ষুদ্র/ অবিকশিত থাকে। এরা সাধারণত নিষ্কামী বা মৃদুকামী হয়। এদের সমকামী বা রূপান্তরকামী বললে জনসাধারণকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়। যারা মনো-দৈহিকভাবে শতভাগ অযৌন তাদের কি সমকামী বা রূপান্তরকামী বলা যায়? আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনা মেঠো বক্তৃতা বা স্ট্যান্টবাজি নয়। এখানে তথ্য, উপাত্ত ও গবেষণানির্ভর হতে হয়। শরীফার গল্প লেখাটি আদৌও সপ্তম শ্রেণির উপযুক্ত কি না, লেখাটি আরও সুসম্পাদিত হতে পারত, এ-জাতীয় আলোচনা-সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু ভুল প্রেক্ষিত তৈরি করে মানুষকে ভিন্ন বার্তা দেওয়া অগ্রহণযোগ্য।

এ-বিষয়ক চলমান বিভিন্ন আলোচনা, বিতর্কে অনেকে কিছু ভুল তথ্য-উপাত্ত দিচ্ছেন। বলা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০% মানুষ সমকামী। গ্যালাপ সংস্থার জরিপ অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ৭.১% এবং পিউ রিসার্চের জরিপ অনুযায়ী ৭% মানুষ নারী-পুরুষ এই দ্বি-লিঙ্গীয় সম্পর্কের বাইরে যৌন আচরণ করে থাকে। যার মধ্যে অযৌনতা, স্বকাম, সমকাম, বিষমকাম ইত্যাদি নানা সম্পর্কের যৌনতা রয়েছে। যুক্তরাজ্য সম্পর্কে ধর্মীয় অনুভূতি বিশ্বাস নিয়ে আরও ভয়াবহ তথ্যও দিতে দেখা গেছে। এই তথ্যদাতারা হয়তো ভুলে যান, আজকের দিনে ঢাকা থেকে লন্ডন অনেক দূরের বিষয় নয়। এ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ লন্ডন/যুক্তরাজ্যে যাতায়াত করে থাকেন। প্রচুর মানুষের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা ছেলেমেয়ে যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী অনেক স্বজনের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলাম। ইন্টারনেটের যুগে এটি মোটেই কোনো কঠিন কর্ম নয়। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে অধিকাংশই হেসে লুটোপুটি খায়। কেউ কেউ প্রকাশের অযোগ্য ভাষায় কিছু মন্তব্য করে বসে।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও নানা গবেষণার পর বললেন, ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে।’ এই নতুন আবিষ্কারটি পবিত্র গ্রন্থ বাইবেলের বিরোধী হওয়ায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো। বিচারসভা বসেছে। অভিযোগকারীরা ক্ষিপ্তভঙ্গিতে ভুল তথ্য উল্লেখ করে গ্যালিলিওকে অভিযুক্ত করে। বিচারে গ্যালিলিওকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারক যখন রায় ঘোষণা করছিলেন, তখনো পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছিল। ঢাকার কাকরাইলের ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াবিষয়ক লেখা বাদ দেওয়ার জন্য অপ্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে যখন নাটকীয়তাসমৃদ্ধ কথাবার্তা, বক্তৃতা চলছিল; ঠিক সে সময় সামনের রাস্তা দিয়ে একজন নারী তার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া শিশুকে নিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন। একদল হিজড়া মানুষ তখন রাস্তায় যাতায়াত করা লোকজনের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে টাকা জোগাড়ে ব্যস্ত ছিল। শিশু মাকে জিজ্ঞেস করল ‘মা, ওরা কারা?’ মা জানালেন ‘ওরা হিজড়া’। শিশুর কৌতূহল ‘মা হিজড়া কী?’ শিশুর এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সঠিক সময় হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকাল। অস্বীকার করলেও কিন্তু পৃথিবী ঘুরতেই থাকে।

লেখক : চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও শিশু সংগঠক

 

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত