১৫ আগস্ট আমাদের কাছে কী দাবি করে?
প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০২২, ১২:২৬ | আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:৪৫
প্রতি বছর ১৫ আগস্ট আমাদের মাঝে শোকের মাতম নিয়ে উপস্থিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ভক্তকূল এক বুক বেদনা ও হাহাকার নিয়ে সেদিনকার সেই বিয়োগান্তক ট্র্যাজেডিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মরণ করে। ঘটনার পর প্রায় অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও শোকে বিহ্বল মানুষ নানা আঙ্গিকে বিচার বিশ্লেষণ করে আজও বোঝার চেষ্টা করে, কেন ঘটেছিল সেদিনকার সেই ট্র্যাজেডি? কী ছিল এর কার্য-কারণ? এ ঘটনা কি ঠেকানো যেত? এ ঘটনা কি এই ইঙ্গিত বহন করে যে, সেদিন বঙ্গবন্ধুর জন্য নেয়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতি ছিল? নাকি তাকে স্রেফ নিজ জনগণের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও শিশুসুলভ অন্ধ বিশ্বাসের বলি হতে হয়েছিল? দেশি-বিদেশি কী ধরনের ষড়যন্ত্র নিহিত ছিল এ ট্র্যাজেডির অন্তরালে? সর্বোপরি, এ ঘটনার ফলে বাংলাদেশ নামের সদ্য-স্বাধীন এই দেশটির ভাগ্যাকাশ কতটুকু ও কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিল?
ক্ষমতার ইতিহাসের মানদন্ডে ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির বিচার করতে গিয়ে ঐতিহাসিক ও রাজনীতিকগণ হয়তো নিজ নিজ অবস্থান থেকে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ হাজির করবেন, তবে বাংলাদেশ নামের এ ভূখন্ডটি যতদিন তার স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকবে ১৫ আগস্ট এ দেশের মানুষের কাছে ফি বছর বিশেষ ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু, কেন? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চিতরূপে এটাই যে, এ দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার সুতীব্র আকাক্সক্ষা জাগরিত করে বঙ্গবন্ধু যেভাবে ’৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তুলেছিলেন, তা তাকে বাঙালি জাতির সহস্র বছরের ইতিহাসে এক অবিসংবাদিত মহানায়কে পরিণত করে।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচনে এক শ্রোতা জরিপের আয়োজন করে এবং শীর্ষ ২০ জনের একটি তালিকা তৈরি করে, যাতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে শীর্ষ স্থান লাভ করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধু তার পরে তালিকায় ২য় স্থান পাওয়া রবি ঠাকুরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পয়েন্ট লাভ করেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রে এ ভূভাগের মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর মতো অনেক বড় মাপের নেতার দেখা পেয়েছে, যাদের প্রত্যেকেই ছিলেন নিজ নিজ কীর্তিগুণে এক একজন মহীরুহ।
কিন্তু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির এক মাহেন্দ্রক্ষণে তার সময়োচিত কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে যেভাবে এ ভূভাগের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে ভাষা দিতে পেরেছিলেন তা তাকে জনপ্রিয়তার এমন এক উচ্চ শিখরে উন্নীত করেছিল, যা এ দেশের মানুষ এর আগে কখনো দেখেনি, ভবিষ্যতেও হয়তো দেখবে না।
পাকিস্তানের কারাগারে অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯টি মাস শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তার নেতৃত্বকে সামনে রেখেই এ দেশের মানুষ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং অবশেষে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করে মুক্তির সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল। ৭ মার্চের সেই অগ্নিঝরা ভাষণ, তার সেই বজ্রকণ্ঠে তেজোদ্দীপ উচ্চারণ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ - যুদ্ধের ময়দানে তাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছে নিরন্তর। যুদ্ধ শেষে মুক্ত বঙ্গবন্ধু যখন তার পর্বতপ্রমাণ জনপ্রিয়তা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন, তার ওপর যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটিতে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে এটিকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়। এই গুরু দায়িত্ব পালনে তার দুঃখজনক হত্যাকান্ডের আগ পর্যন্ত তিনি সাকুল্যে সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মতো। ইতিহাসের বিস্তারিত বিশ্লেষণে যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই, তবে কিছু সমালোচনা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও এটুকু বললে অত্যুক্তি হবে না যে, মোটা দাগে তিনি সঠিক পথেই এগুনোর চেষ্টা করেছিলেন।
সদ্য স্বাধীন এই দেশের গতিধারা ঠিক করে দিতে বঙ্গবন্ধু প্রয়োজন মাফিক সব ক্ষেত্রেই হাত দিয়েছিলেন। এ দেশের মানুষ বিশ্বের দরবারে গর্বিত বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে, এটাই ছিল তার নিরন্তর কামনা। তবে, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে রাতারাতি পাল্টে দেয়ার মতো কোন আলাদীনের চেরাগ তার হাতে ছিল না। কিছু লোকের দুর্নীতি ও ক্ষেত্রবিশেষে সমন্বয়ের অভাবও তার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে।
বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুবাদে দেখা দিতে শুরু করে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কিছু সশস্ত্র গ্রুপ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। এমতাবস্থায়, বঙ্গবন্ধু সব দলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বাকশাল গঠন করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। সন্দেহ নেই, তার উদ্দেশ্য মহৎ ছিল, কিন্তু সমালোচকেরা এখানে গণতন্ত্রের ইতি দেখতে শুরু করে এবং তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এই ইস্যুটিকে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগানোর প্রয়াস পায়। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ১৫ আগষ্টের দুঃখজনক ঘটনায় তার কর্মময় জীবনের অকাল পরিসমাপ্তি ঘটে, ফলে তার এ উদ্যোগ কতটুকু ফলবতি হতো তা দেখার মতো যথেষ্ট সময় মিলেনি।
এ কারণে এটা নিয়ে হয়তোবা প্রশ্ন থেকেই যাবে। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে নেই। রেখে গেছেন অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত ও গুণগ্রাহী। আর রেখে গেছেন এ দেশ ও জাতিকে নিয়ে তার সেসব স্বপ্নগাঁথা, যা তিনি পূরণ করে যেতে পারেননি। ফি বছর ১৫ আগস্ট আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয় আর ভক্ত-অনুরক্তদের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখে, বঙ্গবন্ধুর সেসব অপূর্ণ স্বপ্নসাধ পূরণে তারা কী করেছে এবং করছে? শোক ও দুঃখ নিয়ে তাকে ও তার পরিবারবর্গকে স্মরণ শুধু তখনই অর্থবহ হতে পারে, যখন তিনি যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আমাদের দেখিয়েছিলেন, তা অর্জিত হবে। গত ৫০ বছরে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেশের প্রভূত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীন, স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, তার কতটুকু অর্জিত হয়েছে?
এজন্যে যে মতপার্থক্য কমিয়ে এনে সর্বস্তরের জনতার মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, তার মতো সেই উপলব্ধি কি আমাদের মধ্যেও কাজ করে?
[লেখক : অধ্যাপক ও সভাপতি, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
কৃতজ্ঞতায় :দৈনিক সংবাদ
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত