স্পর্শ - পূরবী বসু

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪:৫২ |  আপডেট  : ১৮ মে ২০২৪, ১৬:৫৪

র সারা শরীরে সহাস্য মুখখানা ছাড়া আর যেন কিছু নেই। অন্তত চট করে অন্য কিছু চোখে পড়ে না। 

যেন শস্যক্ষেতে লাঠির ডগায় বসানো মাটির পাতিল দিয়ে বানানো কাকতাড়ুয়া। চুন-কালি দিয়ে আঁকা চোখমুখ সতত দৃশ্যমান। মাটিতে দন্ডায়মান লাঠির মাঝামাঝি উচ্চতায় আড়াআড়িভাবে আরেকটি লাঠি বেঁধে ছেঁড়া শার্ট আর ফেলে দেওয়া মাফলার জড়িয়ে কাকতাড়ুয়াকে যতই নকল মানুষ বানাবার চেষ্টা করা হোক না কেন, তার ক্ষীণকায় শরীরটার দিকে নয়, সকলেরই চোখ পড়ে পাতিলের ওপরে অঙ্কিত প্রচ্ছন্ন চোখমুখের ওপরেই।

আগাথার বেলাতেও তাই। কুচকুচে কালো কোঁকড়ানো চুল আর তৈলাক্ত মুখমন্ডলের মধ্যে দাঁত বের করা ওর হাসি হাসি মুখখানিই সবার আগে চোখে পড়ে। মুখ বলতে এখানে মুখমন্ডল নয়, ঈষৎ প্রশস্ত ঠোঁট আর দাঁতসহ যে গহবর, যা আহার, স্বাদগ্রহণ, চুম্বন, কথোপকথন কিংবা সংকেতে বিভিন্ন মনোভাব প্রকাশ করার মত জরুরী কাজে নিয়ত ব্যস্ত থাকে, অর্থাৎ চোখ, নাকের মতোই মুখমন্ডলের কেন্দ্রে গর্ত-সম যে ইন্দ্রিয়, ইংরেজিতে যাকে মাউথ বলে আর বাংলায় আক্ষরিক অর্থেই যা মুখ, তার কথাই বলছি। 

আর আগাথা তার মুখের ওপরের ও নিচের চওড়া দুই ঠোঁট ফাঁক করে বত্রিশটা না হলেও অন্তত দুই ডজন ঝকঝকে মসৃণ সাদা দাঁত মেলে যখন তখন, সময়ে অসময়ে কেবল হাসে। চাইলে সে হয়তো বিরতিহীন একটানা হেসে যেতে পারে! কখনো নিঃশব্দে, কখনো আওয়াজ করে। আমার মতো অনেকেই হয়তো কিছুটা বিরক্ত এই হাসির বাড়াবাড়িতে। কিন্তু মানুষের মুখের হাসির সঙ্গে জীবনের ইতিবাচক বহু বিষয়ের এতোটাই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ যে, কেউ বেশি হাসে বলে সাধারণত তাকে নিন্দা করে না কেউ। বেশি হাসার জন্যে কাউকে অপছন্দ করাকেও অন্যের কাছে দৃষ্টিকটু লাগে। কুচুটে বা জীবনযুদ্ধে পরাজিত, ত্যক্ত, বিরক্ত মানুষ বলে নিজেকেই পরিচিত করাতে হয় অন্যদের কাছে। 

আগাথা যখনই আমার ঘরে আসে, খাবার দিতে, বিছানা পাল্টাতে, শিয়রের কাছে রাখা মানিপ্ল্যান্টে বা ফুলদানির ফুলে জল দিতে কিংবা প্রতি রাতে শোয়ার আগে ধোয়া সূতি কাপড়ের রাতের পোশাক দিয়ে যেতে কিংবা সাদা, ভারি, ঈষৎ উষ্ণ কম্বলটা শায়িত ৬০৬ নম্বর ঘরের রোগী অর্থাৎ আমার গায়ের পাতলা চাদরের ওপর সযতেœ মেলে দিতে, আমি লক্ষ্য করি তার মুখে হাসি যেন স্থায়ী ভাবে লেপ্টে আছে। আগাথার সর্বাঙ্গে, মাথার কোঁকড়ানো কালো চুল থেকে শুরু করে ডিম্বাকৃতি মুখমন্ডলের ভেতর ছড়ানো-অন্নুচ্চ নাক, ছোট ছোট কিন্তু উজ্জ্বল দু’টি চোখ, ভরাট গাল আর সরু চিবুক, দুটি শক্ত পরিশ্রমী হাত, কোন কিছুরই তেমন আলাদা কোন বৈশিষ্ট্য নেই। তার তিরিশ বত্রিশ বছরের পূর্ণ যৌবনের ছোঁয়ায় উদ্ভাসিত সুউচ্চ স্তনজোড়া ও নিতম্বও যেন তেমন দৃশ্যমান হয় না। যেমন চট করে চোখে পড়ে এই খোলামেলা হাসিভরা মুখটি।

আগাথাকে সবসময় এমন হাসতে দেখে আমার কেন জানি ভীষণ রাগ ধরে মাঝে মাঝে। মনে হয়, আমার শরীরে সম্প্রতি যে মারাত্মক এক ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে, এইখানে এই রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে দিনে দুপুরে যখন তখন পড়ে পড়ে কিছুটা সময় ঘুমিয়ে টুমিয়ে যে ভয়াবহ অস্ত্রোপচারের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার সংশয় ভুলে থাকার চেষ্টা করি, মনে হয় সেসব যেন পুনঃপুনঃ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে আমার সঙ্গে তামাশা করে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, যৌবনবতী এই কৃষ্ণকায়া নারীটি, বয়সে যে আমার থেকে অন্তত বিশ বছরের ছোট। আমার শরীর থেকে খসে যাওয়া খানিকটা প্রিয় মাংসপিন্ড যাকে আমি প্রতিনিয়ত মিস করি, সহস্র গ্রæপ থেরাপি আর প্রাইভেট কাউন্সিলের পরেও যার অভাবে নিজেকে একজন পরিপূর্ণ নারী ভাবতে পারি না আর, ওর এই বাঁধনহীন হাসি যেন প্রতিনিয়ত আমাকে সেই হারানো প্রিয় বস্তুটির কথাই মনে করিয়ে দেয়। আমার সঙ্গে যেন মস্করা করে সে।

ওর যখন তখন ঘরে ঢুকে আমার কিছু লাগবে কিনা জানতে চাওয়া, বা প্রায় খালি ট্র্যাশ ক্যানের লাইনারের ব্যাগটি দিনের মধ্যে কয়েকবার তুলে নিয়ে নতুন একটা ব্যাগ গুঁজে দেওয়া কিংবা খাবার জলের জগে না চাইতেই মাঝে মাঝে বরফ যোগ করা দেখেও রাগে গা জ্বলে যায় আমার, বাড়াবাড়ি মনে হয়, যদিও মুখে কিছু বলি না। একেক সময় মনে হয়, ওকে ধরে কাছে টেনে এনে জোর করে ওর ঠোঁট দুটো নিজের দুই হাত দিয়ে একত্রে চেপে ধরে ওর দাঁতগুলো ঢেকে দিই, ওর সারাক্ষণের হাসি বন্ধ করে দেই। বলতে ইচ্ছা করে, ভালো করে চেয়ে দেখ মেয়ে। এতো হাসার মতো কিছু নেই চারদিকে। এরকম করে হাসা বোকার লক্ষণ। নিজের চারপাশে তাকাও। দেখ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কী ঘটে চলেছে সর্বত্র। কারো প্রতি কারো মায়া-মমতা নেই। সকলেই সারাক্ষণ ছুটছে আপন সুখ ও আনন্দের খোঁজে। এতো স্বার্থপর দুনিয়ায় বসে কেউ হাসে এমন করে? বোঝাতে চাই, চারপাশের সব দেখলে বুঝলে তারও হাসতে ইচ্ছা করবে না তখন। কিন্তু আমার এসব কথা বা চিন্তা ওকে বলা হয় না কখনো। আগাথার হাসিও থামে না। 

আগাথাকে দেখে মাঝে মাঝে পান্থপথে আমার সেই ডেন্টিস্টের অপেক্ষাকক্ষের দেয়ালে টাঙানো একটি পোস্টারের কথা মনে পড়ে যায়। সেই রঙিন পোস্টারটি জুড়ে অনেকগুলো মুখ। ঠাসাঠাসি। বৈচিত্র্যপূর্ণ একগাদা মানুষের মুখমন্ডলের সমাহার। সাদা-কালো-বাদামী নানা গায়ের রঙের, বিভিন্ন ধরনের চুল ও চোখের, সবরকম বয়সের, পুরুষ নারীর উভয়ের মুখমন্ডল। প্রত্যেকেই তাদের ঠোঁট প্রসারিত ও উন্মুক্ত করে দাঁত বের করে পরম সুখে হাসছে। একসঙ্গে হাসছে নানা দেশের, নানা জাতির, শহর-গ্রামের নানা বয়সের নারী পুরুষ। কয়েক মাসের শিশু থেকে শুরু করে শত বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত। তাদের চোখে আনন্দের দ্যুতি, হাসির দমকে কারো কারো নাক কুঁচকে গেছে, কারো কারো চোখ খুশীর আবেশে আধবোঁজা। পোস্টারটির নিচে লেখা, ‘ঊাবৎুনড়ফু ংসরষবং রহ ঃযব ংধসব ষধহমঁধমব’. হাসি সর্বজনীন। মানুষের হাসির ভাষা ও ব্যাকরণ অভিন্ন। কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে ভালো লাগলে, নিজের ইচ্ছা বা চাওয়া পূর্ণ হলে সেই পরিতৃপ্তি ব্যক্ত করতে অথবা নিজের ভালো লাগার কথা অন্যকে জানাতে জগতের সকল মানুষ একই পদ্ধতি ব্যবহার করে। একই রকম ভাবে তা প্রকাশ করে। তারা হাসে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসে। আগাথার হাসি আর ছোট্ট শিশুটি যে পেট পুরে খেয়ে ঘুমুতে যাবার আগে বিনা প্ররোচনায় এক ঝলক হাসি দিয়ে সকলকে বিমোহিত করে যায়, এই দুই হাসির মধ্যে মূলত কোন পার্থক্য নেই। আনন্দ বা তৃপ্তির অনুভূতি প্রাকৃতিকভাবেই মুখ ও তার আশেপাশে তরঙ্গায়িত হয়ে মুখমন্ডলের কাছাকাছি মাংশপেশির ভাঁজে ভাঁজে দৃশ্যত এক পরিবর্তন আনে- যাকে আমরা হাসি বলি। তবে আগাথার মুখের এই স্থায়ী হাসি কেন জানি আমার কাছে ভালো লাগে না। সহ্য হয় না।

আমি অনেক ভেবে দেখেছি সোমালিয়ায় জন্ম এই পরিশ্রমী নার্সেস এইড আগাথা, এই কালো মেয়েটিকে কেন আমি পছন্দ করি না। স্বাস্থ্যবতী, উন্নতবক্ষা, সুঠাম দেহের অধিকারী এই নারী আমাকে সেবাই তো করে কেবল। আর চেষ্টা করে আমার মনটা ফুরফুরে করে তুলতে। কোন অবহেলা বা দুর্ব্যবহার সে করেনি কখনো, যা আজকাল প্রায়ই পেতে হয় শুধু প্রিয়জনদের কাছে নয়, অর্থের বিনিময়ে সেবাদান যারা করে তাদের কাছেও। সুযোগ পেলেই তারা ফাঁকি দেয়। অথচ আগাথা তেমন নয়! তাহলে কি আমার মেয়ে ছোটবেলায় যা বলেছিল একবার, সেটাই সত্যি? আমি কি আসলেই একজন সংস্কারাচ্ছন্ন, অযৌক্তিক, রেসিস্ট মানুষ? কালো রঙের লোকদের আমি কি ছোট চোখে দেখি? বিনা কারণেই বা পূর্ব কোন অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার জন্যে ওদের ঘৃণা করি? 

মনে পড়ে, বহু বছর আগে ফিলাডেলফিয়ায় একটি কালো কিশোর আমার হাত থেকে দিনে দুপুরে হাতব্যাগটা কেড়ে নিয়ে দৌড়ে পালিয়েছিল। শতশত লোকের সামনে। আমার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি সেদিন, যদিও আমি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আমার ওপর আক্রমণের কথা বলে অপরাধী ছেলেটিকে পেছন থেকে তর্জনীর আঙ্গুল তুলে দেখাচ্ছিলাম সকলকে। কিন্তু কেউই আমার কথায় ছেলেটিকে ধাওয়া করেনি। রাগে দুঃখে আমি তখন নিজেই ঐ ছিচকে চোর কালো কিশোরটিকে বকাবকি করতে শুরু করি। কিছুক্ষণ পরেই তা শুধু এই ছেলের ওপর আবদ্ধ না থেকে গোটা ‘কাল্লু’ সম্প্রদায়ের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। বেশ বাজেভাবেই গোটা সম্প্রদায়কে দায়ী করে গালাগাল করেছিলাম সেদিন! আমার মেয়ে তখন জুনিয়র হাইস্কুলে পড়ে। চতুর্দশী। সঙ্গেই ছিল আমার। ঘরে ফিরে সে রাতে অনেকক্ষণ গোমড়া মুখ করে বসে থেকে শুতে চলে গেল সে। কিছুতেই খেল না কিছু। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর বাবাকে জানায় মায়ের এরকম রেসিস্ট মন্তব্যে সে খুবই মনোক্ষুণœ। কেননা তার বেস্ট ফ্রেন্ডও কালো। এছাড়া, তার আরো অনেক কাছের মানুষ- প্রিয় মানুষও তাই। যেমন শিক্ষক, সহপাঠী, বন্ধু। এর পর থেকে আমরা সাবধানী হই ছেলেমেয়েদের সামনে শব্দ ব্যবহারের ব্যাপাওে, বিশেষ করে কারো সম্পর্কে আড়ালে নেতিবাচক বিশেষণ যোগ করতে। কিন্তু ভাবি, এখনো কি মনে মনে আমার ক্রোধ বা ঘৃণা রয়ে গেছে কালোদের ওপর? নাকি অসময়ে নিজের অঙ্গহানি হয়ে এই যৌবনে ভরপুর সুঠাম দেহের অধিকারী উচ্ছল মেয়েটিকে আমি হিংসা করি? আমি জানি না।

আজ আমার স্নান করার দিন। এসেছি এই শুশ্রæষা কেন্দ্রে চারদিন হলো। এর মধ্যে স্নান করা হয়নি। স্নান না করার জন্য, নাকি নতুন, অপরিচিত জায়গায় এসেছি বলে, রাতে ঘুম খুব কম হয়; কেবল এপাশ ওপাশ করি। কখনো সচেতনে কখনো অসাবধানতায় বুকের ওপর হাতটা পড়লেই চমকে উঠি। কী যেন নেই। ছিল একদিন, আজ নেই। জীবন থেকে, শরীর থেকে বড় কিছু খোয়া গেছে- আর কখনো পাওয়া যাবে না। সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেছে। দিস্তাদিস্তা ব্যানডেজ আর তুলা সে জায়গা দখল করলেও শূন্যস্থান পূরণ হয় না। আমি ঠিকই শূন্যতাটা টের পাই। অস্থির লাগে। ছটফট করতে থাকি। একা। বিছানায়। 

আলোকের মলিন মুখটা চোখে ভাসে। এতোবড় সিদ্ধান্তটা একা নিতে পারতাম না আমি। পারলেও এতো সহজে পারতাম না আলোক সাহায্য না করলে- অভয় না দিলে। কিন্তু এ কেমন সান্ত¡না বা অভয়বাণী তার? একবার সিদ্ধান্ত নেবার পর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব যখন ঘটে গেল, সে কেমন নির্লিপ্ত, নির্মোহ হয়ে পড়লো পুরো ব্যাপারটিতে। ঐ সম্পর্কে কেবল কোন কথা বলা বা আলোচনায় অংশ নিতেই তার অনাগ্রহ রয়েছে তাই নয়, এতোবড় সার্জারীটার পর একবার শরীরের ঐ জায়গাটা দেখতেও চায়নি আলোক। যে বস্তু একদিন তার সবচেয়ে আনন্দের, সবচেয়ে প্রিয় ছিল, আজ তার অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে কী ধরনের শান্তি দিতে চায় সে আমাকে? আর এ জন্যেই কি বাসায় না নিয়ে এই শুশ্রæষাকেন্দ্রে আমাকে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে? যাতে এ ধরনের কোন প্রশ্ন, কোন ব্যাখ্যার মধ্যে যেতে না হয়? আমি জানি না।

আলোক আসে। প্রতিদিনই। নিয়ম করে। এই বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে। 

কিন্তু হাসপাতালে বা এই রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে এখন পর্যন্ত একবারও সে আমার গায়ে হাত দিয়ে ক্ষতস্থানটি দেখেনি বা অনুভব করার চেষ্টা করেনি। মৌখিকভাবে কখনো দেখার ইচ্ছা পর্যন্ত ব্যক্ত করেনি। যখনই আসে, যতক্ষণ থাকে, কেমন দূরে দূরে আলগা বসে থাকে। কথাও কম বলে। চুপচাপ বসে থাকে আলোক- ঘন্টার পর ঘন্টা। হাতল দেওয়া চেয়ারটাতে।

আশ্চর্য্যরে ব্যাপারই বটে। 

শরীরের অপারেশনের স্থানটি দেখা বা হাত দিয়ে তা অনুভব বা পরীক্ষা করা দূরে থাক, সে সম্পর্কে একটি কথাও বলে না আলোক।

এতো বড় সার্জারীর পরেও আমার বাঁচার, রোগমুক্তির নিশ্চয়তা কিংবা সম্ভাবনা কতটা বেড়েছে তা নিয়েও কথা তোলে না। এ সবই কি আমাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে? মনটা অন্যত্র সরাতে? কিন্তু তার এই নীরবতা যে এক ধরনের স্খলন- এক রকম অবজ্ঞার কথা, উপেক্ষার কথা মনে করিয়ে দেয় এ কি বোঝে না আলোক? সে প্রায়ই বলে নাটক করতে তার ভালো লাগে না। স্ত্রীর জীবন-মরণের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে সে সম্পর্কে আলোচনা করাও কি তার কাছে নাটকীয় মনে হয়? নাকি প্রসঙ্গটা উঠলে খারাপ লাগতে পারে, আমার বা তার, এ কথা ভেবেই এমন ব্যবহার করছে ইচ্ছাকৃতভাবেই? এই শেষোক্ত সম্ভাবনার কথাটা প্রায়ই আমার কাছে যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ মনে হয়, যদিও গ্রহণ করতে কোথায় বাঁধে। 

তবে ওর এই দূরে দূরে থাকা, সে আজ নতুন নয়। চার বছর আগে যখন রোগটা প্রথম ধরা পড়লো, যখন মাত্র সামান্য একটু অংশ কেটে ফেলে শুরুতেই অসুখটাকে নির্মূল করতে চাইছিল সার্জন, তখনো নিজ থেকে একবারও জায়গাটা দেখতে চায়নি আলোক। হয়তো সে ভয় পায়। জীবনে সব অপ্রীতিকর বস্তু, ঘটনা, সময়, ব্যক্তি সে বরাবর পরিহার করে চলতে ভালোবাসে আমি জানি। প্রকৃত অর্থেই সে একজন নির্বিবাদী, নির্বিরোধী, শান্তিপ্রিয় মানুষ। যতটা সম্ভব ঝুট ঝামেলা এড়িয়ে চলে। কাউকে দুঃখ দিতে যেমন বাঁধে তার, নিজেকেও সচেষ্টভাবে কষ্টমুক্ত রাখতে চায় সর্বদা।

কিন্তু তাই বলে এখন? এই অবস্থায়? তার কাছে আমার সুস্থ হয়ে ওঠাটাই যে কেবল জরুরী, অন্য কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না, এই ব্যাপারটাও তো আমাকে বুঝতে দেওয়া দরকার তার। 

 কিন্তু কার্যত সে পুরো আমাকেই যেন অগ্রাহ্য করে চলেছে।

 তা সত্তে¡ও আলোক আসে প্রতি সন্ধ্যায় বা বিকেলে। রুটিন বাঁধা। 

এসে বিছানার পাশে রাখা চেয়ারটাতে চুপচাপ বসে থাকে। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বাংলা গল্পের বই ও ম্যাগাজিনগুলো গুছিয়ে রাখে। নার্স বা ডাক্তারের কাছে আমার কুশল সংবাদ নেয়। কিন্তু ওকে দেখে বুঝি বাড়িতে সম্পূর্ণ একা থাকার যে কষ্ট, তার চেয়েও বড় কষ্ট সারাক্ষণ বিছানার লেপ্টে থাকা অসুস্থ কারো দেখাশোনা করা বা তাকে সে অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা। দিনের পর দিন অসুস্থ মানুষের পাশে থাকলে ধীরে ধীরে এক প্রগাঢ় ক্লান্তি ও অবসাদ এসে ভর করে শরীরে-মনে। তার থেকে মুক্তি পেয়ে আলোক বরং কিছুটা সতেজ, কিছুটা হাল্কাই বোধ করছে এখন। ওকে দেখে তাই মনে হয়। 

আজ ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। তারপর আর ঘুমুতে পারিনি। ঘুম ভাঙে অনেকবারই রাতে। তবু বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকি, এপাশ ওপাশ করি। কিন্তু আজ শুয়ে না থেকে বালিশে ঠেশ দিয়ে উঠে বসি। জানালার পর্দাটা বিছানায় বসে বসেই একদিকে সরাতে দেখি ফর্সা হয়ে আসছে বাইরেটা। আমার ঘরটা এই বিল্ডিং-এর পেছনের দিকে। এই দিক থেকে এই বিল্ডিং-এ ঢোকার কোন পথ নেই। ফলে আমার এই ঘরের জানালা থেকে পেছন দিকে কোন রাস্তা, পার্কিং লট বা লোকজনের আসা যাওয়া দেখা যায় না। কোলাহলময় এই বড় শহরে বিস্ময়কর এক নৈঃশব্দ বিরাজ করে এই দিকটায়।

ভবনের এই পেছনের দিকটায় সবটা জায়গা জুড়ে বিরাট এক স্টোরেজ প্লেস- ভিন্ন মালিকের। সারি সারি নিচু তলার কমলা রঙের গায়ে গা লাগানো অপেক্ষাকৃত নিচু ছাদের লম্বা দালান। এইসব একটানা দালানের কিছুক্ষণ পর পর একটা নম্বর লেখা। আর সেই সঙ্গে গ্যারাজের দরজার মতো কলাপ্সিবল দরজা- যেগুলো নিচ থেকে ওপরে খোলে। এই দরজাগুলোর রঙ সাদা। কমলা রঙের লম্বা দালানের একটু পর পর সাদা দরজার এই স্টোরেজ প্লেসে সারা দিন রাত্রে লোক চলাচল খুবই কম। কতো মানুষ এখানে তাদের প্রিয় জিনিসপত্র স্টোর করে রেখেছে! প্রত্যেকেরই আশা একদিন এসব আবার ঘরে নিয়ে যেতে পারবে। এই আশায় ভর করে মাসে মাসে স্টোরেজ ভাড়া দিচ্ছে তারা। কারো কারো কোনদিনই হয়তো সেসব আর ফেরত নেওয়া হয় না। কেউ নেয় নতুন বাসস্থানে উঠে গেলে কিংবা নতুন বাড়ি কিনলে। 

স্টোরেজ প্লেসের সুনসান, নিরিবিলি এই জায়গাটা আমার কাছে সমাধিক্ষেত্রের মতো শীতল ও শান্ত মনে হয়। মাঝে মাঝে ভাবি যারা তাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র এমন স্টোরেজ ভাড়া করে রেখে দেয় তারা হয়তো নিজেদের মৃত্যুর কথা ভাবে না কখনো। ভাবে না তাদের দিন চলে যাচ্ছে- জীবন ছোট হয়ে আসছে। আর কবে ভোগ করবে এসব জিনিস- তার চেয়ে বেছেটেছে কিছু ফেলে, কিছু দান করে বা ব্যবহার করে কেন ভারমুক্ত হয় না তারা? বাঁচার জন্যে- জীবন ধারণের জন্যে কতো জিনিস আর লাগে মানুষের? আমি বুঝি, আজ এ অবস্থায় আমি যা ভাবতে পারি, যেমন করে তা ভাবি- একজন সুস্থ, কর্মক্ষম, স্বাভাবিক মানুষ যার সত্যিকার দরদ বা টান আছে কোন নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের প্রতি, যার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা আছে, অথবা যখন তার কোন পুরনো স্মৃতি বা সেন্টিমেন্ট মাখানো থাকে কোন বিশেষ ফার্নিচার বা ঘরের কোন এক জিনিসের প্রতি, তখন সে কি এমন নির্মোহ হতে পারে সেইসব জিনিসপত্রের ব্যাপারে? 

হঠাৎ কানে আসে আগাথার গলার স্বর।

‘স্নান করার সময় হয়েছে। চল আমার সঙ্গে। তোমাকে এখন উঠে বসতে হবে হুইল চেয়ারে।’

‘এতো ভোরে?’

‘ভোরেই ভালো। স্নান করলে এতো ফ্রেশ লাগবে, দেখো সারাটা দিন কী ভালো লাগে। এখানকার ব্রেকফাস্টটাও কী দারুণ স্বাদের মনে হবে তখন।’ আগাথা প্রাণ খুলে হাসে।

আমার বিছানার কছে এগিয়ে আসে সে। আমি আমার ব্যান্ডেজ করা বাম বুকের দিকে তাকাই। আমার বাঁ দিকের বাহুটা বুকের সঙ্গে ব্যান্ডেজ দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। বগলের নিচে থেকেও দুটো লিম্ফ নোড তুলেছে বলে হাতটাকেও প্রাথমিকভবে বাঁ দিকের খোড়া বুকের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। আজ বিকেলে নার্স ড্রেসিং করার সময় হাতটা উন্মুক্ত করে দেবেন ডাক্তার বলে গেছেন গতকাল। 

আমি আগাথাকে অনুনয় করি। ‘আমাকে একটু বাথরুমে নিয়ে চল। আমি নিজেই চান করতে পারবো। আমি এমনিতেই অন্যের সামনে, হোক তা মেয়ে, কাপড় খুলতে পারি না। বিশেষ করে আমার এ অবস্থায় কিছুতেই নিজেকে দেখাতে পারবো না। তুমি বরং আমাকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যাও।’ 

‘উহু! তোমাকে তো একা ছাড়া যাবে না ডার্লিং।’ বলেই আগাথা সেই পিত্তিজ্বলা হাসিতে আবার তার মুখ উদ্ভাসিত করে। তারপর সংগে আনা তোয়ালে ও নতুন সাবানের প্যাকেট, শাওয়ার জেল, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার ও ময়েশ্চারাইজারের শিশি রাখে হুইল চেয়ারটার ওপর। নিজের ঠোঁটের ওপর ডান হাতের তর্জনী খাড়া করে দাঁড় করিয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে বলে সে আমার ঘরের দরজার কাছে ছুটে গিয়ে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আমি বুঝে উঠতে পারি না আগাথা কী করছে। ওর মনে কী আছে কে জানে? কিন্তু ওর চোখমুখের চঞ্চল ভঙ্গি, আর এমন হঠাৎ করে দরজা বন্ধ করে দেওয়া আমাকে হকচকিয়ে দেয়। আমি তাকিয়ে থাকি আগাথার দিকে। আমার বিছানার কাছে সরে এসে খুব ঘন হয়ে দাঁড়ায় আগাথা। তারপর আস্তে তার স্কার্টটা সামনের দিকের বাম পাশ থেকে কিছুটা তুলে ধরে ওপরে। আর সেই সঙ্গে বাঁ পায়ের হাঁটু অবধি লম্বা মোজাটা চটপট টেনে টেনে নিচের দিকে নামায় খানিকটা। পরম বিস্ময়ে আমি লক্ষ্য করি, সদা হাস্যময় আগাথার বাঁ পায়ে হাঁটুর নিচে কেবল লোহা লক্কর আর প্লাস্টিক। হাঁটুর ঠিক ওপরেই ওর কাটা পায়ের শেষ অংশটুকু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্টেইনলেস স্টিলের খাঁচার মতো তৈরি করা কৃত্রিম পায়ের গায়ে আটকে আছে। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যায় না, লম্বা মোজা আর ঈষৎ লম্বা স্কার্ট বা ড্রেস পরার জন্যে। আর প্যান্ট পরলে তো কিছুই বোঝা যাবার জো নেই। 

আগাথা বলে, ‘জীবনে যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি হয়তো তোমাদের, যার জন্যে নিজের এই সামান্য খোয়া যাওয়াকে এতো বড় করে দেখছো। আমি তো নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি আজো বেঁচে আছি বলে। আমার ছেলে-মেয়েও তাই মনে করে। ল্যান্ডমাইনে পা’টা হারিয়েছি। অথচ দেখ প্রকৃতির কি খেলা। এই কাটা পা-ই আমার আমেরিকায় আসার পাসপোর্ট হয়ে গেল। পা হারানোর জন্যই রেডক্রসের হাসপাতাল থেকেই ছেলেমেয়েসহ আমেরিকায় আসার সুযোগ পেয়েছি।’

 ‘আর তোমার স্বামী? সে আসেনি?’

আগাথা আবার হাসে। ‘তার কর্তব্য তো শেষ। দুটি ফুটফুটে সন্তান আমাকে দিয়েছে। আর কী? এরপরেও কি সে অপেক্ষা করতে পারে? বিশেষ করে আমার দীর্ঘ হাসপাতালে চিকিৎসার ঐ সময়ের একাকীত্ব সে সইবে কোন্ দুঃখে? সে শীঘ্রই অন্য মেয়েতে মজেছে।’

আগাথা একটু থামে। প্রাণ খুলে হাসে আরেকবার। বলে, ‘তবে আমেরিকায় আসার বিস্তর লোভ ছিল তার। অনেক কান্নাকাটি করেছে। অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়েছে। তাকে ফিরে আসতে দেবার জন্যে কতরকম অনুনয়! কিন্তু আমি ছেলেমেয়েদের নিয়ে সোজা চলে এসেছি।’

 আগাথা পায়ের মোজা টেনেটুনে আবার যথাস্থানে নিয়ে আসে। স্কার্টটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে দরজা খুলে দেয়। ফিরে আসতে আসতে বলে, ‘আমার মতো খেটে খাওয়া মানুষের জন্যে পা হারানো মানে না খেয়ে মরা। কিন্তু দেখ কী দিব্যি চলে ফিরে বেড়াচ্ছি। কাজ করছি ফুল টাইম। লোকে বুঝতেও পারে না কাপড়ের নিচে কী লুকিয়ে রেখেছি। কিন্তু আমার এখনো পায়ে, দুই পায়েই বেশ ব্যথা হয়। সেই তুলনায় তোমার অঙ্গহানি তো কিছু নয়। তোমার বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে। তোমার বুকের দুধ খেয়ে পুষ্ট হয়েছে ওদের শরীর। স্বামীকেও যথেষ্ট আনন্দ দিয়েছ সুন্দর শরীর আর প্রচুর সময় দিয়ে। এখন নিজেকে দেখ। ভালো করে বেঁচে থাকার চেষ্টা কর। দেখবে বাঁচার মতো বাঁচার জন্যে তোমার খোয়া যাওয়া অঙ্গটি জরুরী নয়। এটা তোমাকে ভেতর থেকে উপলব্ধি করতে হবে।’

ক্লজেট থেকে আমার পরনের জন্যে ধোয়া কাপড় জামা ও বাথ রোবটি বের করতে করতে আগাথা বলে, ‘এবার চল, চান করবে। তোমাকে আজ কাপড় খুলে যা দেখালাম, তা এখানে কাউকেই দেখাইনি, যদিও দু’একজন জানে। কিন্তু এই কাজ করতে এসে তোমার মতো সার্জারী করা বহু রুগী আমি দেখেছি। ফলে চান করার সময় ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকবো না তোমার দিকে, তোমার সার্জারীর জায়গাটার দিকে- প্রতিজ্ঞা করছি। এটা নতুন কোন দৃশ্য নয় আমার জন্যে।’ বলেই আগাথা আবার হাসে। অবিকল সেই হাসি। কিন্তু আজ, এখন এই হাসিতে উদ্ভাসিত আগাথাকে প্রথমবারের মতো আমার খারাপ লাগে না।

ওর কথার দৃঢ়তা বা সম্মোহনী শক্তিতে আমি বোধহয় কাবু হই। নিজেই বিছানা ছেড়ে হুইল চেয়ারে গিয়ে বসি। মনে মনে বলি, যুদ্ধ আমার দেশেও হয়েছে, ভয়াবহ যুদ্ধ। আমরা জিতেছি সেই যুদ্ধে। স্বাধীনতা পেয়েছি। আমার জন্মের আগে হয়েছে সেই স্বাধীনতা যুদ্ধ, কিন্তু অনুপুঙ্খ বর্ণনা শুনেছি মা-বাবা, দাদাদের কাছে। আমার এক আপন কাকা মুক্তিযুদ্ধে মারা গেছে। না, আমার দেশের সেই যুদ্ধ আমি চোখে দেখিনি। তবে নিজের জীবনে এক বিশাল ব্যক্তিগত যুদ্ধ আমি করে যাচ্ছি বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। জানি না এর শেষ কোথায় বা কবে। 

স্নানাগারে গিয়ে আমি নিজেই আমার গায়ের কাপড় খুলতে থাকি। বাম হাত বাঁধা বলে আগাথা আমাকে সাহায্য করে। এখন আগাথাকে আমার তেমন খারাপ লাগছে না আর। তাই তার সামনে নিরাভরণ হতে আমি দ্বিধা করি না। বøাউজটা খুলে আগাথা সবার আগে প্লাস্টিকের বড় বড় ব্যাগ দিয়ে আমার বুকের বাঁ দিক ও বাঁ বাহুটা ভালো করে মুড়িয়ে দিল মাস্কিং টেপ দিয়ে যাতে সে জায়গাগুলো না ভেজে। তারপর ওয়াশ ক্লথ ভিজিয়ে তাতে ভালো করে সাবান বা শাওয়ার জেল মাখিয়ে নিয়ে আমার ঘাড়, পিঠ, কোমর, হাত, পা, উরু, ডান বগলের নীচ, মুখ, চোখ, নাক, কানের পেছনটায়- ভেতরে পরম যতেœ, ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দেয়। এতো মনোযোগ দিয়ে, এতোটা সময় নিয়ে এতো দরদের সঙ্গে তা করে যে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। ছুটির দিনে দুপুরে খেলা শেষে ধূলাময়লা মেখে ঘরে এলে এমনি খুঁটিয়ে খুঁটিয় সারা শরীর পরিষ্কার করে চান করিয়ে দিতো মা। এরপর আর কোনদিন আর কেউ করেনি এমন। 

শাওয়ারের নিচে আসার আগেই মেনিকিউরের ছোট্ট গোল বাক্সটা খুলে আমার হাতপায়ের আঙ্গুলের বাড়তি নখগুলো কেটে সুন্দর করে ঘষে মসৃণ করে দিয়েছিল আগাথা। থুতনির নিচে বেয়ারা একখানা দাঁড়ির মতো চুল কিছুদিন পর পর-ই গজিয়ে ওঠে। তুলে ফেললেও এক-ই জায়গায় আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সেই কালো ছোট্ট চুলটা চিবুকের নিচে থেকে সতর্কতার সঙ্গে ফোরসেফ দিয়ে তুলে ফেলে আগাথা। একটুও ব্যথা না দিয়ে। নাক ও মুখের মাঝখান থেকেও ছোট ছোট লোম তোলে একটা একটা করে কয়েকটা। তারপর ঐ জায়গাগুলোতে আলতো করে একরকম মলম মেখে দেয়। 

হাত পায়ের আঙ্গুলের ডগা ও নখ, ঘাড়ের কাছটাতে ছোট ছোট চুল এসে মিশেছে যেখানে, তলপেটের শেষ সীমানা যা নিম্নাঙ্গের দিকে চলে গেছে, কোমরের নিচের দিকে-নিতম্বের ঠিক ওপরে শক্ত হাড়ের ওপর চামড়া বিছানো যে জায়গা, পিঠে মেরুদন্ডের ওপরে নিচু খাদের মতো লম্বাটে অংশ- এই ধরনের শরীরের যেই সব ছোটখাটো কঠিন জায়গাগুলো সহজে নিজের হাতের নাগালে আসে না, বিশেষ করে যখন মাত্র এক হাত দিয়ে তা করতে হয়, সেইসব জায়গাগুলো ভালো করে সে নরম ওয়াশ ক্লথ দিয়ে ঘষে ঘষে পরিস্কার করে দিতে থাকে। 

যা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম আমার সেই সার্জারী করা বক্ষ নিয়ে সে কোন কথাই বলেনি এতোক্ষণ। কিছু করেওনি সেখানে এ পর্যন্ত। এখন, সারা শরীরে সাবান দিয়ে পরিষ্কার করার পর সবশেষে সে ব্যান্ডেজ বাঁচিয়ে খুব সাবধানে আমার অবশিষ্ট ডান স্তনটিতে ও খোলা পেটে অতি যতেœর সংগে সাবান মাখিয়ে দেয়। আর আশ্চর্য। আমার সারা শরীর কুমারী মেয়ের প্রথম প্রেমিকের স্পর্শে রোমাঞ্চকর অনুভূতি টের পাবার মতো করে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় চোখ বুঁজে আসে আমার। মনে হয় এমন ভালোবাসায়, এতো যতœ করে, এতো সাবধানতায় আর কেউ আমাকে স্পর্শ করেনি আগে। এমন কেউ আসেনি আমার জীবনে বহুকাল যে এতো আদরে, সোহাগে, মমতায়, অথচ সমীহ সহকারে আমাকে এমন করে পরম নৈকট্যে নিয়ে গেছে গায়ে সাবান দিয়ে স্নান করিয়ে দেবার মতো এক সাধারণ স্পর্শ দিয়ে। 

বাথরুমের দেয়ালে সাঁটানো লম্বা আয়নায় নিজেকে চোখে পড়ে। আমার ঈষৎ হেলানো একমাত্র স্তনের কেন্দ্রের বৃন্তটি শাওয়ারের ক্রমাগত জলের পতনে, আর মমতাময় মানব-স্পর্শে আন্দোলিত হয়ে প্রস্ফুটিত ফুলের মতো সজাগ হয়ে উঠেছে। অসীম ভালোলাগায় আমি আবার আস্তে চোখ বুঁজি। টের পাই শুধু বুকের ডান পাশে নয়, বাম পাশে যেখানে স্পর্শকাতর অনুরূপ আরো একটি বস্তু বহু বছর ধরে আমার সঙ্গে ছিল, কিন্তু আজ আর যার অস্তিত্ব নেই, সেখানেও আমি একই রকম অনভূতি টের পাচ্ছি। ডানপাশের মতই একই ধরনের ভালোলাগায় নড়েচড়ে জেগে উঠেছে আমার বাম স্তনবৃন্ত যা কিনা বেশ কয়েকদিন আগেই পুরোপুরি উৎপাটিত হয়ে গেছে আমার শরীর থেকে। অনেকদিন আগে শুনেছিলাম, যুদ্ধে হাঁটু অবধি পা কেটে ফেলার পরেও সৈন্যরা কর্তিত পায়ের পাতায় অথবা গোড়ালিতে প্রচন্ড এবং তাজা ব্যথার অনুভূতিতে কাতরায়, রীতিমতো কান্নাকাটি করে। কেটে ফেলে দেওয়া পায়ের কোন্ আঙ্গুলে বিশেষ ব্যথা বোধ করছে, গোড়ালির কোন দিকটাতে দব দব করে জ্বলছে, যন্ত্রণা দিচ্ছে, শুয়ে শুয়ে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেয় ডাক্তার কিংবা নার্সের কাছে। 

সারা গা, মুখ ডলে ডলে পরিষ্কার করার পর আগাথা দুই হাত দিয়ে আমার চুলে শ্যাম্পু মাখাতে থাকে। তার মেদহীন লম্বা আঙ্গুলগুলো আমার চুলে, মাথায় ফেনা তুলে আলতোভাবে নড়াচড়া করে। আমি এখনো চোখ বুঁজে আমার ভালো লাগা অনুভব করছি। আমি জানি কোন কোন নারীতে নারীতে শারীরিক নৈকট্য ঘটে। আমি এও জানি জীবনে কখনো কোন নারীর প্রতি সেভাবে আকর্ষিত আমি হইনি। সেরকম কোন লক্ষণ, ঝোঁক বা আগ্রহই নেই আমার মধ্যে। কখনো ছিল না। থাকলে টের পেতাম। ফলে সেসবের কোন সম্ভাবনাই নেই। সবচেয়ে বড় কথা আগাথাকে আমি তেমন পছন্দ করি না বলেই জেনে এসেছি, এখানে আসার পর থেকেই। ফলে তার ছোঁয়ায় আপ্লুত হবার কথা নয় আমার। 

শ্যাম্পু করার সময় শাওয়ারটা বন্ধ করে রেখেছিল আগাথা। এখন আবার সেটা চালু করে সাবধানে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে ভালো করে স্নান করাবার আগে নিজের বাঁ তালুতে জল ছেড়ে তাপমাত্রাটা আবার পরীক্ষা করে নেয় একবার। তারপর সাবান মাখা ওয়াশ ক্লথটি আমার হাতে দিয়ে বলে, ‘তুমি হয়তো লক্ষ্য করনি তোমাকে হুইল চেয়ার থেকে যে শাওয়ার চেয়ারটিতে এনে বসিয়েছি ওটা তলাবিহীন। এই ওয়াশক্লথ দিয়ে নিজের প্রাইভেট পার্টটা পরিষ্কার করে নাও এবার। আমার কোন আপত্তি ছিল না ওটা নিজে করে দিতে। কিন্তু তোমার অস্বস্তি হতে পারে।’

আগাথা পরম স্নেহে ওয়াশক্লথ শুদ্ধ আমার হাতখানা চেয়ারের নিচে নিয়ে আসে। আমি নিঃসংকোচে তার হাত থেকে সাবান মাখা ওয়াশ ক্লথখানা নিয়ে নিজের নিম্নাঙ্গে সাবান দিতে থাকি। আগাথার হাতের শাওয়ার হেড থেকে আমার সারা গায়ে ঝরে পড়ছে নাতিশীতোষ্ণ জলের ধারা। শরীর-মন থেকে একে একে সব ক্লান্তি মুছে যাচ্ছে আমার। বহুদিন পর সারা দেহমন আরেকজন মানুষের আন্তরিক মমতা ও ভালোবাসার স্পর্শে সিক্ত হয়ে উঠছে। অসীম ভালোলাগার আবেশে চোখ বুঁজে আসতে চায় আমার। পান্থপথের ডেন্টিস্টের ঘরের সেই পোস্টারটির কথা মনে পড়ে। ঊাবৎুনড়ফু ংসরষবং রহ ঃযব ংধসব ষধহমঁধমব. 

স্নান শেষে বাথ রোবটা আমার গায়ে পেঁচিয়ে আমাকে বাথরুম থেকে ঘরে নিয়ে আসে আগাথা। বহুদিন পরে নিজেকে কেমন জীবন্ত মনে হয়। মনে হয়, সকল ঘুমিয়ে পড়া অথবা মৃত বোধগুলো যেন আড়মোড়া ভেঙে নড়েচড়ে জেগে উঠছে। বাথ রোব খুলে শুকনো কাপড় পরাতে পরাতে আগাথা বলে, ‘তুমি কি জান, কী অসাধারণ সুন্দর তুমি দেখতে?’

এই অতি পরিচিত প্রশংসা বাক্যটিও শুনলাম আজ বহুদিন পরে। নিজের চেহারা সম্পর্কে যে কথা একসময় অহরহ শুনতাম, আজ কোন মুখেই আর তা উচ্চারিত হয় না। বয়স এবং সময় এমনি জিনিস কাউকেই ছাড় দেয় না। চলে যাবার সাক্ষী ঠিকই রেখে যায় সর্বত্র।। আগাথা বলে, ‘এতো কাপড়চোপড় পরে নিজেকে এমন ঢেকেঢুকে রাখো বলে কেউ জানতেও পারে না, কী সুন্দর দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী তুমি। তোমার স্বামী একজন ভাগ্যবান পুরুষ।’ 

আমি হাসি। বলি, ‘আমার স্বামীর সৌভাগ্যের জন্যে আমার শরীর ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে। ওর পেশা, ওর শিকার করার নেশা, ওর রান্না করার শখ, ওর ব্রিজ আর দাবা খেলা। কত কী!’

আমাকে সারা গায়ে যতেœর সংগে ময়েশ্চারাইজার মেখে দেয় আগাথা। 

শুকনো তোয়ালে দিয়ে চুল থেকে আলগা জলটুকু মুছে ফেলে ঘষে ঘষে। 

তারপর ব্রাশ দিয়ে আমার চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আমার হাতে একখানা হাত আয়না ধরিয়ে দেয়। ‘দেখ, কী সুন্দর লাগছে তোমাকে।’

আমি নিজেকে একবার আয়নায় দেখে আয়না থেকে মুখ সরিয়ে আগাথার দিকে তাকাই। 

আমার ভেজা চুলে একটা ক্লিপ আটকাতে ব্যস্ত আগাথার মুখে প্রশান্ত হাসি। 

হাসিমুখী আগাথাকে আজ দেখতে বেশ লাগছে আমার।

আগাথা হাসছে। কী নিষ্পাপ, কী মধুর এ হাসি। 

আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তার দিকে।

 

সান

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত