শ্যামবাজার নাট্যসমাজ থেকে ন্যাশনাল থিয়েটার
প্রকাশ: ৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪:০৩ | আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৮
১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে দিকে কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের যুবক সম্প্রদায়ের গঠিত একটি বাগবাজার এমেচার থিয়েটার, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে নাম পাল্টে 'শ্যামবাজার নাট্যসমাজ' নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মে, শ্যামবাজারের রাজেন্দ্রলাল বাড়িতে দীনবন্ধু মিত্রের 'লীলাবতী' নাটক মঞ্চস্থ হলে, রাতারাতি বিখ্যাত দলে পরিণত হয়। প্রথম রাত্রির সফল অভিনয়ের পর নাটকটির এতটাই প্রশংসিত হয়েছিল যে, পরপর কয়েকটি শনিবার তা একই মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল। পরে দর্শকদের জায়গা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দর্শক নিয়ন্ত্রণের জন্য এঁরা ইউনিভার্সিটি সার্টিফিকেট' দেখে প্রবেশপত্র দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় এই নাটক দেখার জন্য টিকেট বিক্রয়ের কথা ভাবা হয়েছিল। এই ভাবনা থেকে এঁদের উদ্যোগে ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্ভব হয়েছিল। এই নতুন দল তৈরির সময় টিকিট বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। গিরিশচন্দ্র এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর মতে উপযুক্ত সাজসরঞ্জাম ব্যতীত ন্যাশনাল থিয়েটারের নামে টিকিট বিক্রয় করাট যথার্থ হবে না। কিন্তু দলের অন্যান্য সদস্যরা গিরিশচন্দ্র এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ মত দিলে তিনি দলত্যাগ করেন।
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্বোধন হয়। এই থিয়েটার প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তাদের ভিতরে বাগবাজার এমেচার থিয়েটার (শ্যামবাজার নাট্যসমাজ)-এর গিরিশচন্দ্র ব্যতীত সকলেই ছিলেন। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁরা হলেন- নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল সুর, রাধামাধব কর, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসু, ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যকার মধ্যস্থ পত্রিকার সম্পাদক মনোমোহন বসু, অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শিশিরকুমার ঘোষ, হিন্দুমেলার উদ্যোক্তা ও ন্যাশনাল পেপার পত্রিকার সম্পাদক 'ন্যাশনাল” নবগোপাল মিত্র।
প্রথমাবস্থায় কলকাতার ৩৬৫ নম্বর আপার চিৎপুরের শ্রীকৃষ্ণ মল্লিকের বাড়ির সম্মুখের অংশ মাসিক চল্লিশ টাকায় ভাড়া নিয়ে একটি অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করা হয়। এই বাড়ির সামনে একটি বড়ো ঘড়ি লাগানো ছিল। এই কারণে স্থানীয় লোকেরা একে 'ঘড়িওয়ালা বাড়ি' নামে অভিহিত করতো। ধর্মদাস সুরের তত্ত্বাবধানে মঞ্চনির্মিত হয়েছিল। তাঁর সহকারী ছিলেন ক্ষেত্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়। অর্ধেন্দুশেখর ছিলেন 'জেনারেল মাষ্টার' এবং নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সেক্রেটারী।
দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' নাটক দিয়ে এদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাস নাগাদ নীলদর্পণ প্রস্তুতির সময়েই দলের নান পালটে ন্যাশনাল থিয়েটার' রাখা ঠিক হয়। 'ইংলিশম্যান' পত্রিকার ২০-১১-১৮৭২ সংখ্যার বিজ্ঞাপনে নাম লেখা হয়েছিল- “দি ক্যালকাটা ন্যাশনাল থিয়েট্রিক্যাল সোসাইটি'। আবার 'সুলভ সমাচার' পত্রিকার ১০-১২-১৮৭২' নীলদর্পণ অভিনয়ের বিবরণে নাট্যদলের নাম লেখা হয়েছিল “কলকাতা ন্যাসনযাল থিয়েট্রিকেল সোসাইটি"। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে 'ন্যাশনাল থিয়েটার' ছিল এই দীর্ঘ নামেরই সংক্ষিপ্ত রূপ। ধনীদের সখের নাটাশালায় অভিনয় দেখা ছিল আমন্ত্রমূলক। ফলে সেখানে সকলের প্রবেশাধিকার ছিল না। ন্যাশনাল থিয়েটারে টিকিট বিক্রির ফলে যে কেউ টিকিট কেটে অভিনয় দেখার সুযোগ পাবে। শুরু দিকে টিকিটের মূল্য ছিল- প্রথম শ্রেণি-১ টাকা। দ্বিতীয় শেনি-আট আনা এবং সংরক্ষিত আসন ২ টাকা। এছাড়া মূল বাড়ির দালানের সিঁড়িতে বসার মূল্য ছিল ৪ আনা।
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর (শনিবার), ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্ধোধন হয়েছিল দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' নাটক দিয়ে। নাটকটি মঞ্চস্থ করার সময় কমিটিতে ছিলেন- বেণীমাধব মিত্র প্রেসিডেন্ট, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সেক্রেটারী। স্টেজম্যানেজার ধর্মদাস সুর। অভিনয় প্রশিক্ষক ছিলে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। এই নাটকে যাঁর অভিনয়ে করেছিলেন, তাঁর হলেন- অর্ধেন্দুশেখর (উড সাহেব, সাবিত্রী, গোলোক বসু, একজন চাষা রায়ত), নগেন্দ্রনাথ (নবীনমাধব), কিরণ (বিন্দুমাধব), শিকচন্দ্র চট্রোপাধ্যায় (গোপীনাথ দেওয়ান), মতিলাল সুর (তোরাপ ও রাইচরণ), মহেন্দ্রলাল বসু (পদী ময়রাণী), শশীভূষণ দাস (আমিন, পণ্ডিত মশাই, কবিরাজ), পূর্ণচন্দ্র ঘোষ (লাঠিয়াল), গোপালচন্দ্র দাস (আদুরী, একজন রায়ত), অবিনাশচন্দ্র কর (রোগ সাহেব), ক্ষেত্রমোহন গাঙ্গুলি (সরলা), অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় (ক্ষেত্রমণি), তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় (রেবতী) ও অমৃতলাল বসু (সৈরিন্ধী)।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত