শোকবহ আগষ্ট, মার্কিন যোগসাজশ ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২২, ০৮:২৮ | আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৫
জন্মলগ্ন থেকে মার্কিন ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র স্বাধীন হয়েছিলো। ১৯৭০-৭১ সালে এই অঞ্চলের রাজনীতির সমীকরণের পরিবর্তন আসে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে সূচনা হয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। সেই সময় ইন্দিরা গান্ধী সরাসরি আমেরিকার বিরোধিতা করে বাংলাদেশকে সর্মথন ও সহযোগীতা করে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডি ৩২-এর বাসভবনে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সবাইকে ব্রাশ ফায়ারে নির্মম ভাবে হত্যা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সদস্য সামরিক অভ্যুত্থানে। এর জন্য মার্কিন যোগসাজশের দিকে ইঙ্গিত করে এমন অজস্র প্রমাণ রয়েছে। কতটুকু নিষ্ঠুর হলে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা যায়। মার্কিন যোগসাজশে নৃশংস ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা, জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামালকে হত্যা করে। জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধু শেখ নাসেরের ভাই, এসবি সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক, প্রায় একই সাথে ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বাসভবনে হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হককে হত্যা করে। মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, বঙ্গবন্ধুর শ্যালক আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা চালিয়ে সেরনিয়াবাত ও তার মেয়ে বেবী, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, সেরনিয়াবাতের বড় ভাই সজিব সেরনিয়াবাতের ছেলে ও আত্মীয় বেন্টু খানকে হত্যা করে। কি নিষ্ঠুরতা, যে মহান মানুষটা সারা জীবন ত্যাগ করে গেলো এই দেশের জন্য, তার প্রতিদান এই ভাবে দিলো, সবাইকে হত্যা করে? ছেলেদের, গর্ভবতী পুত্রবধুদের। গর্ভবতী মা-দের গুলি করার সময় একবারের জন্য বুক-হাত কাপঁলো না। ছোট্ট শিশু, বঙ্গবন্ধুর ছোট্ট ছেলে, তাকেও কি, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা খুবই প্রয়োজন ছিলো? কি বুঝতো ও রাজনীতি?
১৯৬৯ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পাকিস্তান ছিল ব্যাক-চ্যানেল। যার ফলে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে হেনরি কিসিঞ্জার বেইজিংয়ে গোপন সফর করে। ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়েরই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সবাইকে ব্রাশ ফায়ারে নির্মম ভাবে হত্যার পর থেকে বাংলাদেশে মার্কিন সামরিক সহায়তা শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং সামরিক শক্তিশালী ব্যক্তি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বিপরীতমুখীতা শুরু হয়। জিয়া বাংলাদেশকে ইন্দো-সোভিয়েত কক্ষপথ থেকে বের করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি নিয়ে আসতে সফল হন। জিয়ার অধীনে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মার্কিন ও বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গির মিল ছিল। কার্টার প্রশাসন বাংলাদেশে জিয়ার আধুনিকীকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় সমর্থন করেছিল। মার্কিনদের পরামর্শে ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের অগণতান্ত্রিক সরকার বা সামরিক শাসন এবং বিএনপি-জামাত জোট সরকারগুলি রাজনৈতিক ক্ষমতার দখল স্থায়ী করার জন্য পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক পেক্ষাপটে বা সমর্থনে ভারত বিরোধিতা এবং ভারত বিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠি গুলোকে সহায়তা এবং ভারতীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন অব্যাহত রাখে। কিন্তু জিয়া হত্যার অভ্যুত্থানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল অবাক করার মতন। এরপর রাষ্ট্র ক্ষমতায় জেনারেল এরশাদ এসে জিয়ার নির্দেশিত বৈদেশিক নীতি অব্যাহত রাখেন, যা মার্কিনদের সন্তুষ্ট করেছিল।
এমনকি ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে, যখন সেনাবাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঢাকায় ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন এই শাসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদ ছিল । ১১ জানুয়ারী ২০০৭ সালের ঘটনাগুলি ছিল 'একটি আন্তর্জাতিকভাবে অনুপ্রাণিত সামরিক অভ্যুত্থান।' একটি প্রতিবেদনে একজন সিনিয়র বাংলাদেশি সামরিক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে দাবি করা হয়েছে যে 'ব্রিটিশ, আমেরিকা , অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী আনার জন্য ব্যাপকভাবে জড়িত ছিল এবং এটির (অভ্যুত্থান) জন্য [ইউ.এন] সদর দফতর থেকেও সমর্থন ছিল। অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের দক্ষিণ এশিয়া সংবাদদাতা, পিটার লয়েড, ৮ জুন ২০০৭, প্রভাবশালী বাংলাদেশী সংবাদপত্রের সম্পাদককে উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, “পশ্চিমা দেশগুলি শুধু সামরিক হস্তক্ষেপই করেনি, জানুয়ারিতে বেসামরিক রাজনীতিবিদদের এটি গ্রহণ করার জন্য প্রচারণা চালায়।”
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতায় প্রায় একই সাথে আসার সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতির তিনটি পরিবর্তন আসে, গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং সন্ত্রাসবাদের দমন। যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাবকে স্বাগত জানায় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। ২রা সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে ঢাকায় এক ভাষণে তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তার দেশের ভূমিকাকে একটি 'দুঃখজনক ভুল' হিসেবে বর্ণনা করেন। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির ওয়াশিংটন সফরের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হিলারি ক্লিনটন জোর দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এখন গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালীকরণ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচার এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় মনোনিবেশ করছে। যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক মার্চ ২০০০-এ আরো শিক্তিশালী হয়েছিল যখন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, এটি কোনও মার্কিন রাষ্ট্রপতির প্রথম সফর।
ভারত আমেরিকার সম্পর্ক উন্নয়ন হয়। নতুন মেরুকরণ চীন ঠেকাও। ভারতের সাথে আমেরিকা জোটের সুসম্পর্ক শুরুর পরপর পাকিস্তান আর বাংলাদেশের ভারত বিরোধী সরকারের প্রয়োজনীতা আমেরিকা জোটের কাছে কমে আসে। পূর্বের ভারতবিরোধী রাজনৈতিক সরকারের পরিবর্তে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজনীয়তা আমেরিকা জোটের কাছে প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বর্তমান সরকার ছিলো উপযুক্ত পছন্দ।
কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশের সাথে চীনের ও রাশিয়ার সম্পর্ক দৃঢ় হতে থাকে। যা ভারত ও আমেরিকার কাছে চিন্তার বিষয় হয়ে উঠে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপরিবারে খুনীদের আশ্রয়, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে না দেয়ার নীতি বর্তমান সরকার খুব একটা ভালভাবে গ্রহণ করে নি। এরসাথে অধ্যাপক ডঃ ইউনুসের বিষয়ে আমেরিকার তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন পক্ষপাত এবং বিশ্ব ব্যাংকের পদ্মা সেতু বিষয়ের মতন বিভিন্ন বিষয়ের ফলে আমেরিকা ও বর্তমান সরকারের সম্পর্কে শৈথিল্য পরিলক্ষিত হতে থাকে। আর এর বিপরীতে চীন রাশিয়া জোটের সাথে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সুসম্পর্ক এগিয়ে যেতে থাকে। ভারত সরকারের বিভিন্ন বিষয়, তিস্তা নদী, প্রতিশ্রুতি দিয়েও উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ ও অর্থায়ন না করা ও ভারতের বিভিন্ন কোম্পানীর ভূমিকা, মায়ানমার বিষয়ে ভারতের ভূমিকার ফলে বর্তমান বাংলাদেশ সরকার, ভারত সরকারের উপর বিরক্ত হতে শুরু করে।
১০ ডিসেম্বর ২০২১ - আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের [র্যাব] বিরুদ্ধে। ০৯-১০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে গণতন্ত্রের শীর্ষ সম্মেলন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়। এটি বাংলাদেশের উপর চীনের ক্রবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধির কারণে হয়েছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ও চীনের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গ্রহণীয় নয়। যেমন গ্রহণীয় ছিলো না পাকিস্তানের ইমরান খানের চীন রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক। বাংলাদেশের প্রতি আমেরিকার বিভিন্ন বিধিনিষেধ আর কিছু নয় বর্তমান সরকারকে আজ্ঞাবহ, নতজানু করার চেষ্টা। পাকিস্তানে ইমরান খানের পতনে খান অভিযোগ করেন, তিনি পাকিস্তানে "শাসন পরিবর্তন" প্রভাবিত করার জন্য মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টার শিকার। আমেরিকার কুটকৌশলের সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান, রাশিয়া আর শ্রীলংকার বর্তমান অবস্থা বিবেচ্য। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতার জন্য মার্কিন যোগসাজশের দিকে ইঙ্গিত করে এমন অজস্র প্রমাণ রয়েছে। এর পেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন মনোভাব অভিন্ন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য বাইরের দেশের চক্রান্তে (মার্কিন) অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারানো হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০১ সালের ওই নির্বাচনে বিএনপির কাছে হারের দিকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি তো চেয়েছিলাম আমার দেশের সম্পদ আগে আমার দেশের মানুষের কাজে লাগবে। আমার ৫০ বছরের রিজার্ভ থাকবে। তারপর, আমরা ভেবে দেখব বিক্রি করব কি, করব না। …ফলাফল কী ? ……….. আমেরিকা অ্যাম্বাসির লোক, হাওয়া ভবনে বসেই থাকত। এই নির্বাচনটা.. ২০০১-এ সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে হারাবে, আর এখান থেকে গ্যাস নেবে।”
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র জোরদার হচ্ছে। “২০১৪–এর নির্বাচনের আগে চক্রান্ত করেছে, ২০১৮–এর নির্বাচনের আগে করেছে, আবার এখন নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসছে, তখন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে।” আমেরিকার অতীত ইতিহাস হতে আশঙ্কা জাগে, মার্কিন-চীন শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্রমবর্ধমান উত্তাপে বর্তমান সরকারকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাতের তৎপরতা শুরু হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেত্রীত্বে এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ শক্তিশালী অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমেরিকার বিরোধিতা করার রাষ্ট্রগুলোর বা রাজনৈতিক দল গুলোর পরিণতি কারো ভাল নয়। তাদের হয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে, নয়তো অর্থনৈতিক অবরোধে পড়তে হয়েছে।
লেখক :
কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত