বিশ্ব তারকাদের নিয়ে রেড সি'র জমকালো উদ্বোধন, ছিল বাংলাদেশও
প্রকাশ: ৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০০ | আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:২৬
গত বৃহস্পতিবার সকালের জেদ্দা। লোহিত সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এই বন্দর নগরী তখন রৌদ্রোজ্জ্বল এক অপরূপ দৃশ্য। সেখানকার আবহাওয়া ঢাকার মতোই হালকা শীত। তবে বাতাসে ছিল এক অদ্ভুত স্বর্গীয় প্রশান্তি। শহরের রাস্তাগুলো ছিল সরগরম। কিন্তু একদিকে বিশেষ কিছু পথ বন্ধ রাখায় যানজট ছিল একটু বেশি। গাড়িচালক মোহাম্মদ হামজা জানালেন, সাধারণত এমন জ্যাম হয় না, তবে এবারের ‘রেড সি’ চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন উপলক্ষে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বন্ধ রাখা হয়েছে। এর ফলে গাড়ি চলাচলে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। তবে, উৎসবের আবহে শহরের প্রতিটি পথ যেন এক ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে।
এ দিন সন্ধ্যায় জেদ্দার পুরোনো শহর আল-বালাদের দিকে গিয়ে মনে হলো - এখানে যে কারোই অতীতের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি হবে। ২০১৪ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া আল-বালাদ, আজও তার ঐতিহাসিক গর্ব বহন করছে। এখানকার প্রতিটি প্রাচীন ভবন, কোরাল স্টোন দিয়ে তৈরি ঘর-বাড়ি এবং কাঠের মাশরাবিয়া উইন্ডো যেন এক অদ্ভুত গল্প বলে। ঢেউ খেলানো ছাদগুলো সৌদি স্থাপত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা প্রাচীন ইতিহাসের এক অবিনাশী অধ্যায়ে নিয়ে যায়। আর ঠিক সেই স্থানেই এবারের ‘রেড সি’ চলচ্চিত্র উৎসবের চতুর্থ সংস্করণের আয়োজন।
দুই বছর পর এই উৎসব আবার আল-বালাদে ফিরেছে। মাঝখানে দুই বছর জেদ্দার রিটজ-কার্লটন হোটেলে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। উৎসবের মূল আয়োজনটি তিনটি প্রধান স্থানে সাজানো হয়েছে: কাচারাল স্কয়ার, ফেস্টিভাল গার্ডেন এবং আল-বালাদ সুক (বাজার)। উজ্জ্বল আলোকরশ্মি আর জমকালো সাজসজ্জায় পুরো এলাকা যেন এক নতুন প্রাণ পেয়েছে। রাস্তায় যানবাহনের চাপ থাকলেও, দর্শকদের সুবিধার্থে শাটল বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে যে কেউ সহজেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছাতে পারেন।
উৎসবের প্রথম দিনে কালচারাল স্কয়ারে জমকালো রেড কার্পেট বা লাল গালিচা অভ্যর্থনার আয়োজন করা হয়। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রেড কার্পেটের ওপর হাঁটতে দেখা গেল বিশ্ব চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান তারকাদেরকে। এরপর উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় ঠিক রাত সাড়ে ৮টায়, আর তার পরেই সিনেমার প্রিমিয়ার প্রদর্শিত হয়। যদিও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি একটু দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায়, সিনেমার স্ক্রিনিং শুরু হতে কিছুটা বিলম্ব হয়। তবুও এটা দর্শকদের উত্তেজনাকে কোনোভাবে কমাতে পারেনি।
এবার উৎসবের থিম ‘দ্য নিউ হোম অফ ফিল্ম ’ অর্থাৎ সিনেমার নতুন বাড়ি। রেড সি চলচ্চিত্র উৎসবের নতুন বাড়িটি একটি কাস্টম-বিল্ট কমপ্লেক্স, যা স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং এটি বছরের পর বছর চলচ্চিত্র সম্পর্কিত কার্যক্রমের জন্য একটি স্থান হিসেবে তৈরি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রেড সি ফিল্ম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান জোমানা আল রশিদ আল-বালাদ বলেন, তিনি ও তার দল ‘ঐতিহ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং ইতিহাসের দায় অনুভব করেছেন। নতুন উৎসব বাড়ি সম্পর্কে আল রশিদ বলেন, এটি এমন একটি স্থান যেখানে নতুন চলচ্চিত্র গাছপালা রূপে রোপিত হচ্ছে। এটা বিশ্ব চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এ ফাউন্ডেশনের ঐতিহাসিক বছরের কথা উল্লেখ করেন। যার মধ্যে ছিল - কাওথার বেন হানিয়ার ‘ফোর ডটার’ চলচ্চিত্রের অস্কার মনোনয়ন এবং সৌদি আরবের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে কানে প্রদর্শিত নোরা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ব চলচ্চিত্রের বড় বড় তারকারা। যার মধ্যে রয়েছেন - হলিউডের মাইকেল ডগলাস, ক্যাথরিন জেটা-জোন্স, অস্কারজয়ী পরিচালক স্পাইক লি, অভিনেত্রী এভা লংগোরিয়া, মিশেল ইয়ো, সিনথিয়া এরিভো, উইল স্মিথ, মিশেল রদ্রিগেজ, ভিন ডিজেল, এমিলি ব্লান্ট এবং বলিউডের সুপারস্টার আমির খান, ক্যারিনা কাপুর খান আর বাংলাদেশের মেহেজাবীন চৌধুরীসহ আরও অনেকে।
অনুষ্ঠানে এবার আইকনিক ক্যারেকটার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ভিন ডিজেল। পুরস্কার গ্রহণের সময় তিনি বলেন, অনেক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের তুলনায় এখানে পরিচিত মুখের সংখ্যা বেশি মনে হচ্ছে। হলিউডের প্রোগ্রামেও ইদানীং এতোগুলো মানুষকে একসঙ্গে দেখা যায় না। নিজের অতীত স্মরণ করে ডিজেল জানান, ১৯৮০-এর দশকে স্পাইক লির সিনেমায় এক্সট্রা হিসেবে কাজ করার সময়, তিনি লির কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে এক্সট্রা হিসেবে কেউ কাজ করলে, তাকে আর কখনও বড় চরিত্রে দেখা যাবে না। এই কথা শুনে স্পাইক লি মঞ্চ থেকে উচ্চারণ করেন, ‘আমি এটা জানতাম না।’
স্পাইক লি এবার জুড়ি প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা, সম্পাদক ও প্রযোজক। কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৩ তম আসরে বিচারকদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার।
চার দশকের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্য ছবি বানিয়েছেন স্পাইক লি। সময়ের সঙ্গে যে ছবিগুলো পেয়েছে ধ্রুপদীর মর্যাদা। সমকালীন সিনেমায় নানান প্রশ্ন ও বিতর্কিত বিষয় তুলে ধরেছেন তিনি। জনসাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের একের পর এক ছবিতে যৌক্তিকতার সঙ্গে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন। কৃষ্ণাঙ্গদের চিরকালের দুঃখ, যন্ত্রণা আর বৈষম্যের কবিতা বলা যায় তার প্রতিটি কাজকে।
স্পাইক লি’র কাজে ও চলাফেরায় যেন চিরন্তন কিশোরের প্রতিফলন পাওয়া যায়। স্নিকার ও ক্যাপ ছাড়া কখনও তাকে দেখা যায়নি জনসমক্ষে। তিনি রসিক, অদম্য, বাকপটু ও বলিষ্ঠ। সিনেমার কাজ নিয়ে তিনি সব সময় ব্যস্ত থাকেন!
রেড সি’র মঞ্চেও তিনি সেভাবেই হাজির হয়েছেন। যেখানে তিনি সংক্ষেপে উল্লেখ করেন যে সম্প্রতি ‘হাইস্ট টু লয়েস্ট’ সিনেমার পোস্ট-প্রোডাকশন সম্পন্ন করেছেন।
জুরি প্রধান হিসেবে তার ভূমিকা সম্পর্কে লি বলেন, আমি এবার তৃতীয়বারের মতো সৌদি আরব আসছি। প্রথমবার এসেছিলাম ১৯৯২ সালে। তখন ‘ম্যালকম এক্স’ সিনেমার শুটিং করেছি মক্কায়। যদিও আমি মুসলিম নই, তবে ধর্মের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই কাজটি করতে পেরেছিলাম। তখনই আমার মনে হয়েছিল যে হলিউড যখন এটা করতে পেরেছে, অবশ্যই এখানে সিনেমার ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয়বার এসেছিলাম ২০২২ সালে।
উৎসবের উদ্বোধনীতে ছিল সিনেমা ‘দয়ে'স ফ্যামিলি’। সৌদি-মিসরের যৌথ প্রযোজনার এই সিনেমা পরিচালনা করেছেন ‘কারিম শেনাওয়ি’। এটি ১১ বছর বয়সী এক নুবিয়ান ছেলের গল্প। যার শরীরে আলবিনিজম রয়েছে। তার চমৎকার গলা থাকলেও তার অনন্য চেহারা কারণে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। তার বাবা তাকে ত্যাগ করেন এবং সহপাঠীরা তাকে বুলিং করে। এতকিছুর পরও সে তার প্রিয় সংগীতশিল্পী মোহামেদ মুনিরের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চায়। এক দিন সে ‘দ্য ভয়েস’ রিয়েলিটি শোতে অডিশন দেওয়ার সুযোগ পায়। তখন সে এবং তার পরিবার আসওয়ান থেকে কায়রো পর্যন্ত এক বিপজ্জনক যাত্রা শুরু করে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করেন ড্যানিয়েল রহমে ও হাকিম জামা এবং আয়োজনটি পরিচালনা করেন জোমানা আল-রশিদ, রেড সি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আসেরি, রেড সি ফিল্ম ফাউন্ডেশনের সিইও এবং শিভানি পান্ডিয়া মালহোত্রা। এবার উৎসবে ৮৫টি দেশের ৪৯ ভাষার ১২২টি সিনেমা প্রদর্শন করা হবে।
ছিল বাংলাদেশও
বিশ্বের খ্যাতনামা তারকাদের সঙ্গে উৎসবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী মেহজাবীনও। শাড়িতে বঙ্গ নারীর সাজেই এ দিন কালচারাল স্কয়ারে হাজির হয়েছিলেন তিনি। মাকসুদ হোসেন পরিচালিত ‘সাবা’ ছবিটি রয়েছে প্রতিযোগিতা বিভাগে। ৮ ডিসেম্বর কালচার স্কয়ার-সিনেমা ১-এ হবে প্রথম প্রদর্শনী।
এরপর ৯ ও ১৪ ডিসেম্বর একই স্থানে আরও দু’বার দেখানো হবে সিনেমাটি। এক পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা ও তার মেয়ের গল্প রয়েছে এই সিনেমায়। মা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তার দেখাশোনার পুরো দায়িত্ব পালন করে সাবা। মায়ের চিকিৎসার অর্থ জোগাড় করার জন্য তাকে কাজ নিতে হয় সিসা বারে।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত