বিক্রমপুরে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানো হয় ‘৭১ এর ১৩ মার্চ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৩, ১২:০৫ |  আপডেট  : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:০৮

বিক্রমপুরে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানো হয় ১৩ মার্চ এবং ২৯ মার্চে শ্রীনগর থানার রাইফেল গুলি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়।

৩ মার্চের দৈনিক পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে ডাকসুর ভিপি আ স ম রব কর্তৃক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের খবর পড়ে ও ছবি দেখে আমরা শ্রীনগর থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে পতাকা উত্তোলনের কথা চিন্তা করি। শ্রীনগর থানা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আবদুর রশীদ মিয়ার সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তিনি ৭ই মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু কি বলেন তা দেখে পতাকা উড়ানোর পরামর্শ দেন।৮ মার্চ সকালে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে আমরা নিশ্চিত হই যে,এর পরে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে আমাদের আর থাকা সম্ভব নয়।

আমরা পতাকা উড়ানোর বিষয়ে একমত হয়ে কর্মসূচি গ্রহনের জন্য ঢাকা যাই আওয়ামী লীগের সদ্য নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে আলাপ করতে।তিনি আমাদের কথা শুনে বলেন যে,বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের এ সময়ে ঢাকা ত্যাগ না করতে নির্দেশ দিয়েছেন।তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কোন নেতাকে নিয়ে পতাকা উড়াতে পরামর্শ দেন।আমরা তাঁর পরামর্শ মতো বিক্রমপুরের কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা আবদুস শহিদ খান সেন্টুর সাথে দেখা করি।তিনি১৩ মার্চ বিকেলে শ্রীনগরে এসে পতাকা উড়াতে সম্মত হন।

শ্রীনগরে ফিরে পতাকার জন্য সবুজ,লাল ও হলুদ কাপড় সংগ্রহ করি।কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় -বাংলাদেশের মানচিত্র নিঁখূত ভাবে সেলাই করে পতাকা তৈরি করার দক্ষ টেইলার না পাওয়া।অনেক চেস্টার পরে কাজী এমারত হোসেন নামক একজন টেইলার সম্মত হন পতাকা সেলাই করে দিতে। ১২ মার্চ রাত জেগে কাজী এমারত হোসেন গোপনীয়তা রক্ষা করে স্বাধীন বাংলার পতাকা সেলাই করে দেন।

১৩ মার্চ বিকেলে শ্রীনগর খেলার মাঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্ব্যোগে ছাত্র জনতার সভা অনুস্ঠিত হয়।আমার সৌভাগ্য হয় সে সভায় সভাপতিত্ব করার।কারন আমি তখন শ্রীনগর থানা ও শ্রীনগর কলেজ ছাত্র লীগ শাখার সভাপতি।সভায় ছাত্রলীগের আনোয়ার হোসেন খান(বেজগাঁও),ফজলুল হক সেলিম(শ্রীনগর),ইদ্রিস আলী মিয়া(হরপারা),শহীদ ভূইয়া(হরপারা),মোহাম্মদ আলী টুকু((মজিদপুরদয়হাটা),মোফাজ্জল হোসেন (বেজগাঁও)ও ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে মাহফুজুর রহমান রিপন(মাশুরগাঁও) বাংলাদেশ স্বাধীন করার আহবান জানিয়ে বক্তৃতা করেন।ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস শহিদ খান সেন্টু বক্তৃতার এক পর্যায়ে সকলকে বাম হাত বুকে ও ডান হাত উর্ধে তুলে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ করান।

সভা শেষ করে আমরা পতাকা উড়াতে নিদিষ্ট স্থানে যাই।ঠিক এ সময়ে শ্রীনগর বাজারের ঘড়ির মেকার ও ফটোগ্রাফার আনিসুল ইসলাম তালুকদার একটি পাকিস্তানি পতাকা আমার হাতে দিয়ে বলে, আগে এটিতে আগুন লাগিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াতে হবে। আনিসের কথা মতো আমি তাই করি।পাকিস্তানি পতাকা পুড়ে শেষ হলে আমরা জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে সবুজ জমিনের মাঝে লাল বৃত্তে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি।

রাতে বাড়ি গেলে বাবাকে খুব চিন্তিত দেখি। তিনি শুধু একবার বললেন, তুমি কেন নিজ হাতে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পোড়াতে গেলে?

এর পরে প্রতিদিন এ পতাকা শ্রীনগরে আমরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ অফিসে আর্মিদের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত উত্তোলন করতাম।স্বাধীনতার পন্চাশ বছর পরেও যখন একাত্তরের উত্তাল সংগ্রামের দিন গুলির কথা মনে হয় তখন এক অন্য রকমের শিহরণ অনূভব করি।

বিজ্ঞাপন

২৫ মার্চে দিবাগত রাতে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য বাহিনী নিরীহ বাঙ্গালীদের ওপর গণহত্যা চালায়।ক্যালেন্ডার ও ঘড়ির কাটায় তখন ২৬ মার্চ।বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের আক্রমণের খবর পেয়ে পূর্ব পরিকল্পনানুসারে টিএন্ডটির একজন প্রকৌশলীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন।

২৬ মার্চে সকাল ১০ চার পর থেকে শত শত মানুষ ঢাকা থেকে শ্রীনগরে আসতে থাকে।তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারি গত পারে ঢাকায় পাকিস্তানি বর্বর সৈন্যর নির্বিচার বাঙ্গালিদের হত্যা করেছে।অনেকে গোলাগুলি ও কামান দাদার শব্দ শুনেছে।আগুনের লেলিহাণ শিখা দেখেছে।প্রাণভয়ে তারা সংসারের সবকিছু রেখে ঢাকা ছেড়েছেন।শ্রীনগর হাই স্কুল ও কলেজের ক্লাসরুম খুলে দিয়ে বাজার থেকে হোগলা এনে ফ্লোরে বিছিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা আমরা করি।চিরা,মুরি ও গুঁড় দিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করা হলো।

২৭ মার্চে আরো বহু মানুষ ঢাকা থেকে আসে।গতকাল যারা এসেছিলেন তারা চলে গেলেন।রশীদ মিয়া,পরেশ পোদ্দার,মজনু শেখ ও অন্যান্যদের সাথে আলাপ করে চাউল,ডাল ও লাউ দিয়ে খিচুরি রান্না করে মানুষদের খাওয়ানো হলো।ওয়াজিউল্লাহ মাস্টার সাহেবের বোডিংএর ছাত্ররা সকলে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে গুরু দায়িত্ব পালন করে।

২৮ মার্চ আমরা জানতে পারি ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যর রমনা শীব বাড়ি কোয়ার্টারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের মালিক মধুসুদন দে কে তাঁর স্ত্রী,বড় পুত্র ,পুত্র বধূকে হত্যা করেছে। এ খবর পেয় আমরা মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ি।

২৯ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকা থেকে শ্রীনগর আসেন। আমাদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। তিনি জানান বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা গ্রেফতার করেছেন।তিনি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পরিপালন করার জন্য আমরা মোয়াজ্জেম ভাইর নেতৃত্বে শ্রীনগর থানায় গিয়ে ওসি সৈয়দ আহমদ সাহেবকে রাইফেল ও গুলি দিতে তিনি নির্দেশ দেন।ওসি গড়িমসি করায় আমি একটা চেয়ার উঠিয়ে তাঁর দিকে ছুঁড়ে মারি।খালেক নামক একজন এএসআই অস্র দিবে না বলায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন একটা চড় মেরে তাকে থানা থেকে বাহির করে দেন। শেষে ওসি রাইফেল গুলি দিতে সম্মত হন। আমরা রাইফেল পেয়ে আনন্দে জয় বাংলা শ্লোগান দেই। শ্রীনগর হাই স্কুল প্রাঙ্গনে মোয়াজ্জেম ভাই ও প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু মন্ডল বক্তৃতা করে দেশ স্বাধীন করার জন্য সকলের সাহায্য চান। আমরা রাইফেল নিয়ে সৈয়দপুরের দিকে যাই পাকিস্থানিদের প্রতিরোধ করতে।যদিও আমরা কেউ তখন রাইফেল চালাতে জানি ।শুধু দেশপ্রেম ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উদ্বোদ্ধ হয়ে এ কাজ করেছি।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের স্মৃতি পন্চাশ বছর পর মনে হলে অন্য রকম এক অনুভুতির জাগে- যা লিখে প্রকাশ অসম্ভব।

 

                        লেখক - 

           মো.জয়নাল আবেদীন

মুক্তিযোদ্ধা,লেখক-গবেষক,পরিচালক আইবিবিএল

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত