পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গার রেলপথে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু
প্রকাশ: ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৬ | আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:১৪
ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে ট্রেনের প্রথম হুইসেল বেজেছে। এর মাধ্যমে পদ্মাপাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা ৭ মিনিটে লোকমোটিভসহ ৬টি কোচের পরীক্ষামূলক ট্রেন একটি লম্বা হুইসেল দিয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন ছাড়ে। আর এর মধ্যে দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা যুক্ত হলো রেলপথে। এতে উচ্ছ্বসিত ওই অঞ্চলের জনসাধারণ।
পরীক্ষামূলক যাত্রার প্রথম এই ট্রেনটি লোকোমাস্টার হিসেবে এনামুল হক এবং সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে এম এ হোসেন ট্রেন চালাচ্ছেন। আর গার্ড হিসেবে ট্রেন পরিচালনা করছেন আনোয়ার হোসেন। পরীক্ষামূলক ট্রেনের যাত্রী হিসেবে পর্যবেক্ষণ করছেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। আরও উপস্থিত আছেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী, রেলপথ সচিব ড. হুমায়ুন কবীর, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসান, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন, রেলপথ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং রেলওয়ের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প আগামী ১০ অক্টোবর উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী তারিখ দিয়েছেন। এই রেললাইন উদ্বোধনের ফলে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ জীবনযাত্রা সহজ হবে।
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যশোর পর্যন্ত নতুন ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায়। কিন্তু পুরো এই পথটি এখনও নির্মাণ না হওয়াতে আপাতত ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ উদ্বোধন করতে চায় সরকার। আজকের এই পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল সফল হওয়ার পর চলতি মাসে আরও কয়েকটি পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হবে নতুন এ রেলপথে। এরপর আগামী ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই রেলপথের আংশিক উদ্বোধন করবেন। তারপরের সপ্তাহ থেকে এই পথে চালানো হবে যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক ট্রেন।
এই পথে ট্রেন চলাচলের খবরে মাওয়া-ভাঙ্গা এলাকাবাসীদের মনে উচ্ছ্বাসের জোয়ার বইছে। তাদের অনেকে বলছেন, এবার বুঝি ট্রেনে চড়ার সাধ মিটবে।
গত বছর পদ্মা সেতু যখন সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়, তখন থেকে রেলওয়ে বাড়তি গুরুত্ব দেয় মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের কাজে। এরপরও পুরো ঢাকা-যশোর অংশের কাজ শেষ করতে না পারায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে কর্তৃপক্ষ। পরে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন বলেন, শুরুতে ৩টি স্টেশনের (মাওয়া, পদ্মা (জাজিরা) ও শিবচর) সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু করে ঢাকা-ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করা হবে। এর বাইরে নিমতলা স্টেশনটিও চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে উদ্বোধনের এক সপ্তাহ পরে। শুরুতে একটি ট্রেন নিয়মিত পরিচালনা করা হবে। প্রকল্প কার্যালয় থেকে ঢাকা-পদ্মা সেতু-রাজবাড়ী রুটে ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে রাজশাহী থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি ট্রেন চালানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া মধুমতি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভাঙ্গা পর্যন্ত আসে। এ ট্রেনটি ঢাকা পর্যন্ত আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, উদ্বোধনের তিন মাসের মধ্যে প্রধান প্রধান স্টেশনগুলো চালু হয়ে যাবে। ট্রেনের সংখ্যাও বাড়ানো হবে।
ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ডসহ প্রকল্পের মেয়াদ আরও দেড় বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্প কার্যালয় থেকে এ সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব এরই মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়েতে পাঠানো হয়েছে। তবে মেয়াদ বাড়লেও প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ছে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।
স্বল্পমেয়াদি ওই বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ রেলপথটির ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে প্রতিদিন ১৩ জোড়া ট্রেন চলবে। একইভাবে ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে প্রতিদিন ৭ জোড়া ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে প্রতিদিন চলবে ৫ জোড়া ট্রেন। এ সময়ের মধ্যে ঢাকা-ভাঙ্গা অংশে বছরে ৪০ লাখ, ভাঙ্গা-কাশিয়ানী অংশে বছরে ১৭ লাখ ও কাশিয়ানী-যশোর অংশে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ যাত্রী পরিবহন করা হবে। ‘ওয়ান ডিরেকশন’ বা একমুখী চলাচলের ওপর ভিত্তি করে এ প্রাক্কলনটি তৈরি করেছে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ (সিআরইসি)।
একইসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ে ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পুরো রেলপথটি চালুর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণের জন্য পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ২০১৬ সালে অনুমোদন করে সরকার। প্রকল্পের আওতায় ১৭২ কিলোমিটার মূল রেলপথের বাইরে ৪৩ কিলোমিটার লুপ লাইন (স্টেশনের আগে-পরে বাড়তি লাইন) নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ১০০ আধুনিক যাত্রীবাহী বগিও কেনা হয়েছে। এগুলো দিয়ে রেক সাজিয়ে নতুন ট্রেন চালু করা হবে। বর্তমানে পুরো প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে ঢাকা-যশোর রুটে ট্রেন চালানোর টার্গেট রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।
পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে তৈরি নতুন ব্রডগেজ রেলপথে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারবে। এ পথে থাকবে না কোনো রেলক্রসিং। কারণ, যেখানেই রেললাইন ও সড়ক মিলেছে, সেখানেই পাতালপথ তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত মোট ২০টি স্টেশন থাকবে, যার মধ্যে ১৪টি নতুন এবং ৬টি আগে থেকেই রয়েছে। আগের স্টেশনগুলোরও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে।
প্রকল্পটি যখন ২০১৬ সালে অনুমোদন করা হয়, তখন এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ২২ মে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এই রেলপথ জিটুজির (সরকারের সঙ্গে সরকারের) ভিত্তিতে চীনের অর্থায়নে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ করছে সিআরইসি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের এক্সিম ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ২৬৬ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। বাকি অর্থ ব্যয় করছে বাংলাদেশ সরকার।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত